মুজিব জন্মশতবর্ষ ও স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীতে দেশের সবচেয়ে বড় অর্জন শতভাগ বিদ্যুৎ। দুর্গম চরাঞ্চল থেকে শুরু করে প্রত্যন্ত পার্বত্য অঞ্চলে পৌঁছে গেছে বিদ্যুতের আলো। নদ-নদীর তলদেশ দিয়ে সাবমেরিন কেবল টেনে সংযোগ দেওয়া হয়েছে বিদ্যুৎ লাইনের। আবার পার্বত্য অঞ্চলের যেসব স্থানে বিদ্যুতের লাইন নেওয়া দুঃসাধ্য, সেখানে সোলার প্যানেল বসিয়ে দেওয়া হচ্ছে বিদ্যুৎ সংযোগ। এভাবে বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় এরই মধ্যে দেশের ৯৯.৮৫ শতাংশ মানুষ বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায় চলে এসেছে।
বিদ্যুৎ পেয়ে পাল্টে যাচ্ছে দুর্গম চর কিংবা প্রত্যন্ত পার্বত্য অঞ্চলের অনগ্রসর মানুষের জীবনযাত্রা। জাতীয় গ্রিডের বাইরে পার্বত্য চট্টগ্রামের ০.১৫ যে দুর্গম এলাকাগুলো রয়েছে, সেখানেও সোলার প্যানেলে বিদ্যুৎ সংযোগ দিতে পৌঁছে গেছে প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম। দ্রুত বিদ্যুৎ সংযোগ দিতে সেখানেও এগিয়ে চলছে কর্মযজ্ঞ। চলতি মাসের মধ্যেই শেষ হবে দেশে শতভাগ বিদ্যুৎ সংযোগের কাজ। এর পরই দেওয়া হবে দেশজুড়ে শতভাগ বিদ্যুতের ঘোষণা।
জানা গেছে, আগামী ফেব্রুয়ারি মাসের শুরুতে দেশে শতভাগ বিদ্যুতের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গত শনিবার বিষয়টি কালের কণ্ঠকে জানিয়েছেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ।
মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন পটুয়াখালীর দুর্গম চর রাঙ্গাবালী ও পদ্মায় জেগে ওঠা চরগুলোতে পৌঁছে গেছে বিদ্যুৎ। একইভাবে বিদ্যুৎ পৌঁছে গেছে বঙ্গোপসাগরে ভোলার দুর্গম চর কুকরিমুকরি ও মনপুরায়। সাবমেরিন কেবলের মাধ্যমে এসব বিচ্ছিন্ন এলাকায় নেওয়া হয়েছে বিদ্যুতের লাইন। এসব দুর্গম এলাকায় বিদ্যুৎ যাওয়ার পর পাল্টে গেছে সেখানকার দরিদ্র মানুষের জীবনযাত্রা। বিদ্যুৎ যাওয়ার পর সেখানকার মানুষের জীবিকা অর্জনে খুলে গেছে নতুন নতুন পথ।
দক্ষিণ এশিয়ায় ভারত ও পাকিস্তানের মতো প্রভাবশালী দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশই হতে যাচ্ছে প্রথম দেশ, যেখানে শতভাগ মানুষের ঘরে পৌঁছে দেওয়া হয়েছে বিদ্যুৎ। এ ছাড়া ভুটান সাড়ে সাত লাখ মানুষের ছোট দেশ হিসেবে শতভাগ বিদ্যুৎ পৌঁছে দিয়েছে।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা এই অনন্য অর্জনের কৃতিত্ব দিচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারকে। ২০০৯ সালের আগে বিদ্যুত্সংকটে দেশের অর্থনীতি ছিল ভঙ্গুর, শিল্প-বাণিজ্য ছিল স্থবির। লোডশেডিংয়ে জনজীবন ছিল অসহনীয়। তাঁরা বলছেন, বর্তমান সরকারের দূরদর্শী সিদ্ধান্তের ফলে বিদ্যুৎ খাতে এই অভাবনীয় সাফল্য অর্জিত হয়েছে।
বিদ্যুৎ বিভাগ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, শতভাগ বিদ্যুতের লক্ষ্য অর্জনে অনেক প্রতিবন্ধকতাও ছিল। এর মধ্যে অন্যতম দুর্গম চরাঞ্চলে বিদ্যুতের লাইন নেওয়া। আবার মানুষ নিজের গ্রাম, আদিনিবাস ছেড়ে ‘মাঠে-প্রান্তরে’ কিংবা নতুন সড়কের পাশে বাড়িঘর তৈরি করছে। ফলে বিদ্যুতের বাড়তি চাহিদার জোগান দিতে সঞ্চালন ও বিতরণ লাইন স্থাপনসহ নানা চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হয়েছে বিদ্যুৎ বিভাগকে। এসব প্রতিকূলতা মোকাবেলা করেই সাফল্যের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে বিদ্যুৎ বিভাগ। বিদ্যুৎ খাতে মাত্র ১২ বছরে যে অভাবনীয় বিপ্লব ঘটেছে, সেটি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শিতায় সম্ভব হয়েছে।
পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক মোহাম্মদ হোসাইন বলেন, ‘২০০৮ সালে বর্তমান সরকারের রূপকল্পেই ছিল ২০২১ সালের মধ্যে সবার জন্য বিদ্যুৎ নিশ্চিত করা। প্রধানমন্ত্রীর দিকনির্দেশনায় আমরা গত ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশের ৯৯.৮৫ শতাংশ এলাকায় বিদ্যুতায়নের কাজ শেষ করতে পেরেছি। বাকি রয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রামের কিছু দুর্গম এলাকা। ওই এলাকাগুলোতে সোলার প্যানেল ছাড়া অন্য কোনো উপায়ে বিদ্যুৎ নেওয়া সম্ভব না। সেখানে কাজ করছে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন পরিষদ। একটি আলাদা প্রকল্পের মাধ্যমে সেখানে কাজ হচ্ছে। এরই মধ্যে সেখানকার বেশির ভাগ এলাকায়ও বিদ্যুৎ পৌঁছে গেছে।’
তিনি বলেন, ‘এরই মধ্যে দেশে শতভাগ বিদ্যুৎ বাস্তবায়িত হয়েছে বলে আমরা মনে করি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দ্রুত সময়ের মধ্যে এই সাফল্যের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেবেন। আমরা এখন সেই অপেক্ষায় রয়েছি।’
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেন, ‘এ মুহূর্তে আমরা বলতে পারি, পুরো দেশ শতভাগ বিদ্যুতায়নের আওতায় এসে গেছে। বিশেষ করে দুর্গম চরাঞ্চল ও বিচ্ছিন্ন কিছু এলাকা, যেখানে শুরুতে সৌরবিদ্যুৎ ও জেনারেটরের মাধ্যমে বিদ্যুৎ পৌঁছানো হয়েছিল, সেখানে এখন সাবমেরিন কেবলের মাধ্যমে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সুবিধা পৌঁছে গেছে। গ্রিড-অফগ্রিড মিলিয়ে দেশের সব এলাকা এখন শতভাগ বিদ্যুতের আওতায়। আশা করছি, আগামী ফেব্রুয়ারি মাসের শুরুতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই সাফল্যের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেবেন।’
পাওয়ার সেলের তথ্যানুসারে, ২০০৯ সালে দেশে বিদ্যুৎকেন্দ্রের সংখ্যা ছিল ২৭। বর্তমানে বিদ্যুৎকেন্দ্রের সংখ্যা ১৪৬। ২০০৯ সালে বিদ্যুতের উৎপাদনক্ষমতা ছিল চার হাজার ৯৪২ মেগাওয়াট। বর্তমানে উৎপাদন সক্ষমতা ২৫ হাজার ২৩৫ মেগাওয়াট। তখন দেশে বিদ্যুতের গ্রাহকসংখ্যা ছিল এক কোটি আট লাখ। বর্তমানে গ্রাহকসংখ্যা চার কোটি ১৪ লাখ। সঞ্চালন লাইন ছিল আট হাজার সার্কিট কিলোমিটার, বর্তমানে বেড়ে হয়েছে ১২ হাজার ৯৯৬ সার্কিট কিলোমিটার। মাথাপিছু বিদ্যুৎ উৎপাদন ছিল ২২০ কিলোওয়াট ঘণ্টা, বর্তমানে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫৬০ কিলোওয়াট ঘণ্টা।
বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, শতভাগ বিদ্যুতায়নে সবচেয়ে বড় কাজটি করেছে বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (আরইবি)। দেশে বর্তমানে চার কোটি ১৪ লাখ গ্রাহকের মধ্যে আরইবির গ্রাহকসংখ্যা তিন কোটি ২৫ লাখ। ২০০৯ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে আরইবি দুই কোটি ৫১ লাখ গ্রাহকের ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছে দিয়েছে।
ভোলার ১০টি বিচ্ছিন্ন চরে বিদ্যুতের আলো : মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন ভোলার সাত উপজেলার চরাঞ্চলে ২০২০ সালে নদীর তলদেশ দিয়ে সাবমেরিন কেবলের মাধ্যমে বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়ার কাজ শুরু করে ভোলা পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি। এরই মধ্যে সেখানকার ১০টি চরের বেশির ভাগ এলাকায় শতভাগ বিদ্যুৎ পৌঁছে গেছে। বাকিগুলোর কাজও শেষ পর্যায়ে।
বিদ্যুৎ সংযোগ পাওয়া চরগুলোর মধ্যে রয়েছে সদর উপজেলার চর চটকি মারা, মাঝের চর, দৌলতখান উপজেলার মদনপুর, তজুমদ্দিন উপজেলার চর মোজাম্মেল, চর শাওন, চর নাসরিন, চর লাদেন, চর জহির উদ্দিন, মলমচোরা, লালমোহন উপজেলার চর কচুয়াখালী ও চর শাহজালাল, চরফ্যাশন উপজেলার চর কুকরিমুকরি, মুজিবনগর ও শিকদার চর।