গাজীপুরের শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে গত বছর ২৪টি শ্বাসকষ্টের রোগীদের চিকিৎসায় অত্যন্ত জরুরি যন্ত্র হাই ফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলা কেনা হয়। বছর না ঘুরতেই সেগুলোর মধ্যে ১৯টিই অচল হয়ে পড়েছে। তার মধ্যে সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান জোড়াতালি দিয়ে দুটি সচল করতে পারলেও বাকিগুলো সম্পূর্ণ মেরামত অযোগ্য বলে জানা গেছে। অভিযোগ উঠেছে, এসব ক্যানুলার প্রতিটির বাজারমূল্য তিন লাখ টাকা হলেও কেনা হয়েছিল ১৪ লাখ টাকায়।
তৎকালীন প্রকল্প পরিচালক একক সিদ্ধান্তে নিম্নমানের ওই যন্ত্র কিনেছিলেন।
এ ছাড়া রি-এজেন্ট সংকটে তিন মাস ধরে বন্ধ রয়েছে ওই হাসপাতালের ল্যাবে আট ধরনের গুরুত্বপূর্ণ প্যাথলজি পরীক্ষা। বাধ্য হয়ে তিন-চার গুণ বেশি ফি দিয়ে রোগীদের বেসরকারি হাসপাতাল বা ডায়াগনস্টিক সেন্টারে পরীক্ষা করাতে হচ্ছে।
হাসপাতাল সূত্র জানায়, চড়া দামে ২০২০-২১ অর্থবছরে আইসিইউর জন্য ২৪টি হাই ফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলা কেনেন শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিক্যাল কলেজের তত্কালীন অধ্যক্ষ ডা. মো. আসাদ হোসেন। তিনি হাসপাতাল ও কলেজ স্থাপন প্রকল্পের পরিচালকও ছিলেন। প্রতিটি প্রায় ১৪ লাখ টাকা করে ২৪টি ক্যানুলা কেনা হয় তিন কোটি ৩৬ লাখ টাকায়। গত জুলাই মাসে সারা দেশে করোনার সংক্রমণ অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পাওয়ায় রোগীদের চিকিৎসায় হাই ফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলার প্রয়োজনীয়তা তীব্র হয়ে ওঠে। ক্যানুলা সংকটের কারণে অক্সিজেন না পেয়ে বহু মানুষ মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। ওই সময় শহীদ তাজউদ্দীন হাসপাতালের করোনা ওয়ার্ডের জন্য ছয়টি এবং আইসিইউ ও সিসিইউর জন্য বাকি ক্যানুলাগুলো চালু করতে গিয়ে ধরা পড়ে যে পাঁচটি ছাড়া সব ক্যানুলাই অচল। বিষয়টি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে জানানো হলে তারা এসে জোড়াতালি দিয়ে নষ্টগুলোর মধ্যে মাত্র দুটি সচল করতে পারে। বর্তমানে ওই দুটিও অচল। বহু চেষ্টাও বাকিগুলো আর সচল করা যায়নি। বিষয়টি এত দিন গোপন থাকে। গত মাসের শুরুর দিকে দেশে নতুন করে করোনার সংক্রমণ বৃদ্ধি পাওয়ায় রেড জোন গাজীপুরেও লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে থাকে শনাক্তের সংখ্যা। এরই মধ্যে গত সপ্তাহে হাই ফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলার নষ্টের বিষয়টি জানাজানি হয়।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে হাসপাতালের একজন সাবেক পরিচালক জানান, যেসব হাই ফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলা কেনা হয়েছে সেগুলো ছিল খুবই নিম্নমানের। বাজারে এসব ক্যানুলার দাম তিন লাখের বেশি নয়।
এদিকে রি-এজেন্ট না থাকায় চার মাস ধরে ওই হাসপাতালের ল্যাবে হার্ট, লিভারসহ নানা রোগের প্রায় আট ধরনের পরীক্ষা বন্ধ রয়েছে। রোগীরা তিন-চার গুণ বেশি টাকা দিয়ে পরীক্ষাগুলো বেসরকারি হাসপাতাল বা ডায়াগনস্টিক সেন্টারে করাতে বাধ্য হচ্ছে। অভিযোগ উঠেছে, সুযোগ বুঝে শহরের কয়েকটি নামি ডায়াগনস্টিক প্রতিষ্ঠান একচেটিয়া ব্যবসা করছে।
শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিক্যালের টেকনোলজিস্ট মোমেন হোসেন মোল্লা বলেন, রি-এজেন্ট না থাকায় প্রায় চার মাস ধরে সোডিয়াম ও পটাশিয়াম নির্ণয়ের সিরাম ইলেক্ট্রোলাইট, ট্রপোনিন আই এবং হরমোন নির্ণয়ের টিএসএইচ, এফটি-৩, টি-৩, টি-৪, এফএসএইচ, এলএইচসহ গুরুত্বপূর্ণ আটটি পরীক্ষা করা বন্ধ রয়েছে। বন্ধ রয়েছে এসএলজিই, ব্লাড সিএস, ইউরিন ফর সিএস, এবং জন্ডিস নির্ণয়ের গুরুত্বপূর্ণ এইচবিএসএজির মতো সাধারণ পরীক্ষাও।
জানা গেছে, হাসপাতালে ট্রপোনিন আই পরীক্ষার ফি ৩০০ এবং ইলেক্ট্রোলাইট পরীক্ষার ফি ২০০ টাকা। একই পরীক্ষার ফি বেসরকারি ডায়াগনস্টিকে যথাক্রমে ১৩০০ ও ১২০০ টাকা।
শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক তপন কান্তি সরকার বলেন, শ্বাসকষ্টে অক্সিজেন স্যাচুরেশন কমে যাওয়া রোগীদের জন্য হাই ফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলা জীবন রক্ষায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কলেজের তত্কালীন অধ্যক্ষ ডা. আসাদ হোসেন হাই ফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলাগুলো কিনে হাসপাতালের স্টোর রুমে রেখেছিলেন। কেনার বিষয়টি তিনি হাসপাতালের কাউকে জানাননি। আইসিইউ এবং করোনা ওয়ার্ড চালু করতে গিয়ে ২০টি ক্যানুলা নষ্টের বিষয় ধরা পড়ে। ঘটনাটি সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানকে জানানো হলে তারা অনেক চেষ্টা করে সাময়িকভাবে দুটি ক্যানুলা চালু করলেও এখন তা আবার নষ্ট। বাকিগুলো মেরামতযোগ্য নয় বলে জানিয়েছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান আর্ডেন সিস্টেম লিমিটেড।
বিভিন্ন ধরনের পরীক্ষা বন্ধ প্রসঙ্গে পরিচালক বলেন, হাসপাতালের ল্যাবে পরীক্ষার যন্ত্রপাতি, সরঞ্জাম ও রি-এজেন্টও কিনেছিলেন অধ্যক্ষ আসাদ। যন্ত্রটি হাসপাতালকে দেওয়ার সময় জানানো হয়েছিল, প্রকল্প থেকে তিন বছর রি-এজেন্ট সরবরাহ করা হবে। সাত-আট মাস আগে তাঁকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে বদলি করা হয়েছে। রি-এজেন্ট শেষ হওয়ার আগে কলেজকে সরবরাহ করার জন্য চিঠি দেওয়া হয়। কিন্তু বাজেট না থাকার কথা উল্লেখ করে কলেজের বর্তমান অধ্যক্ষ রি-এজেন্ট সরবরাহ করা সম্ভব নয় বলে জানান। হাসপাতালে বছরে প্রায় ১০-১২ লাখ টাকার রি-অ্যাজেন্টের প্রয়োজন পড়ে। এই পরিমাণ টাকা হাসপাতালের নেই। তাই রি-এজেন্ট ক্রয় করতে না পারায় প্রায় চার মাস ধরে ল্যাব পরীক্ষা করা যাচ্ছে না।
শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষ ডা. আব্দুল কাদের বলেন, সাবেক অধ্যক্ষ ও প্রকল্প পরিচালক মো. আসাদ হোসেন মেডিক্যালের নামে হাই ফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলাসহ ল্যাব যন্ত্রপাতি এবং রি-এজেন্ট নিজ উদ্যোগে ক্রয় করেন।