একাদশ জাতীয় সংসদ চার বছরে পদার্পণ

একাদশ জাতীয় সংসদ চার বছরে পদার্পণ

রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে যাত্রা শুরু করা চলমান একাদশ জাতীয় সংসদ চার বছরে পদার্পণ করল আজ (রবিবার)। ২০১৯ সালের ৩০ জানুয়ারি প্রথম বৈঠক করার মধ্য দিয়ে আনুষ্ঠানিক পথচলা শুরু হয় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন এই সংসদের। মহামারী করোনার ভয়াবহ থাবায় সব কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়লেও সাংবিধানিক ব্যত্যয় ঘটেনি গত তিন বছরে। মাত্র দেড় ঘণ্টার জন্য ইতিহাসের সবচেয়ে স্বল্পকালীন অধিবেশন অনুষ্ঠান করে রেকর্ড গড়া এই সংসদ এরই মধ্যে ১৫টি অধিবেশন সম্পন্ন করেছে।

স্বল্প পরিসরে সীমিত সদস্যদের নিয়ে সংসদ পরিচালিত হলেও জনগুরুত্বপূর্ণ ৭৭টি আইন পাস ও প্রশ্নোত্তর পর্বের মাধ্যমে স্বকীয়তা ধরে রাখার প্রচেষ্টা ছিল। এ ছাড়া বিভিন্ন ইস্যুতে সরকারি ও বিরোধী দলের সদস্যদের মধ্যে বিতর্ক করোনায় কাবু নিষ্প্রাণ সংসদে করে প্রাণের সঞ্চার। তবে এই ক’বছরে ২২ জন এমপির মৃত্যুতে সংসদে ফেলেছে বিষাদের ছায়া। সহকর্মীদের মন ভারাক্রান্ত করে রেখেছে নিত্যদিন।

সংসদ সচিবালয় সূত্রে জানা গেছে, একাদশ জাতীয় সংসদ তিন বছরে মোট ৭৭টি আইন পাস করে রাষ্ট্রের আইন সভার দায়িত্ব কার্যকরভাবে পালন করেছে। এসব আইনগুলোর মধ্যে অনেক নতুন, মৌলিক ও সংস্কারমূলক আইনও রয়েছে। তিন বছরে ১৫টি অধিবেশনে আইন প্রণয়ন ছাড়াও পাস করা হয়েছে ৩টি মেগাবাজেট। পাস হওয়া আইনগুলোর মধ্যে প্রথম বছরে ১৯টি, দ্বিতীয় বছরে ২৭টি এবং তৃতীয় বছরে ৩১টি আইন পাস করা হয়। এসব আইন ইতোমধ্যে কার্যকরও করা হচ্ছে।

সংসদ সংশ্লিষ্টদের দেয়া তথ্যমতে, ২০১৯ সালের ৩০ জানুয়ারি শুরু হওয়া ২৬ কার্যদিবসের প্রথম অধিবেশনে ৫টি বিল পাস করা হয়। অধিবেশন শুরুর দিন নিয়মানুযায়ী সংসদে ভাষণ দেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ। পরে এই ভাষণের ওপর আনা ধন্যবাদ প্রস্তাবে ১৯৪ জন সংসদ সদস্য ৫৪ ঘণ্টা ৫৭ মিনিট আলোচনা করেন। ওই অধিবেশনে দশ কার্যদিবসের মধ্যে ৫০টি সংসদীয় কমিটি গঠন সংসদীয় ইতিহাসে রেকর্ড।

প্রথম অধিবেশনে ৭১ বিধিতে পাওয়া ৩২১টি নোটিসের মধ্যে ৩০টি নোটিস গ্রহণ করা হয়। যার মধ্যে আলোচনা হয়েছে ১৮টি। ৭১(ক) বিধিতে ১৫৫টি নোটিস আলোচিত হয়েছে। অধিবেশনে প্রধানমন্ত্রীর উত্তর দেয়ার জন্য প্রশ্ন জমা পড়ে ১১৪টি। যার মধ্যে সংসদ নেতা জবাব দেন ৪৬টি প্রশ্নের। এ ছাড়া অন্যান্য মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীদের জন্য দুই হাজার ৩২৫টি প্রশ্ন জমা পড়ে; মন্ত্রীরা উত্তর দেন এক হাজার ৭৩০টি।

দ্বিতীয় অধিবেশন ২৪ এপ্রিল শুরু হয়ে ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত মোট পাঁচ কার্যদিবস চলে। এ অধিবেশনে তিনটি সরকারি বিল পাস করা হয়। একটি বিল উত্থাপিত হয়। এ অধিবেশনে কার্যপ্রণালি বিধির ১৪৭ (১) বিধিতে সাধারণ আলোচনা শেষে সন্ত্রাস-যৌন নিপীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ার প্রস্তাব সর্বসম্মতিক্রমে গ্রহণ করা হয়।

প্রথম বাজেট (তৃতীয়) অধিবেশন ১১ জুন শুরু হয়ে চলে ২১ কার্যদিবস। বাজেট পাস ছাড়াও সাতটি বিল পাস হয় এই অধিবেশনে। এছাড়া ৭১ বিধিতে পাওয়া ২৩৫টি নেটিশের মধ্যে ১২টি নোটিশ গ্রহণ করা হয়। যার মধ্যে আলোচনা হয়েছে পাঁচটি। ৭১(ক) বিধিতে ৭৫টি নোটিস আলোচিত হয়েছে। অধিবেশনে প্রধানমন্ত্রীর উত্তর দেয়ার জন্য প্রশ্ন জমা পড়ে ৯৩টি। যার মধ্যে সংসদ নেতা জবাব দেন ৪১টি প্রশ্নের। এ ছাড়া অন্যান্য মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীদের জন্য দুই হাজার ২৭৪টি প্রশ্ন জমা পড়ে, মন্ত্রীরা উত্তর দেন এক হাজার ৬৫৮টির।

চতুর্থ অধিবেশন ৮ সেপ্টেম্বর শুরু হয়ে চলে ১২ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত। ৪ কার্যদিবসের এ স্বল্পকালীন অধিবেশনে মোট ৫টি বিল উত্থাপন করা হয়। আর একটি গুরুত্বপূর্ণ বিল পাস করা হয়। এ ছাড়া এ অধিবেশনে প্রধানমন্ত্রী ৭০টি প্রশ্নের মধ্যে ১৮টির উত্তর দেন। আর মন্ত্রীদের জন্য ১ হাজার ৫৫৩টি প্রশ্নের মধ্যে ৪৫২টির উত্তর দেয়া হয়। এ ছাড়া ৭১ বিধিতে ১৫৮টির নোটিসের মধ্যে গৃহীত ৩টি নোটিস আলোচিত হয়। আর ৭১ক বিধিতে ৩০টি নোটিস আলোচিত হয়।

পঞ্চম অধিবেশন শুরু হয়েছিল ৭ নভেম্বর। ওই অধিবেশনে বিদেশি জাহাজের আধিপত্য কমাতে বাংলাদেশ পতাকাবাহী জাহাজ সুরক্ষায় বিল পাস করে জাতীয় সংসদ। এ ছাড়া দেশের মিষ্টি জাতীয় ফসলের গবেষণা অব্যাহত রাখতে বাংলাদেশ সুগারক্রপ গবেষণা ইনস্টিটিউট আইন, ২০১৯ (বিএসআরআই) এবং বাংলাদেশ শিল্প কারিগরি সহায়তা কেন্দ্র (বিটাক) বিল, ২০১৯ পাস হয় এই অধিবেশনে।

দ্বিতীয় বছরের শুরুর অধিবেশনটি ৯ জানুয়ারি থেকে চলে ২৮ কার্যদিবস। শুরুর দিন সরকারের বিভিন্ন উন্নয়ন তুলে ধরে রাষ্ট্রপতি সংবিধান অনুযায়ী ভাষণ দেন। সেই ভাসন সম্পর্কে আনীত ধন্যবাদ প্রস্তাবের ওপর আলোচনায় সরকারি ও বিরোধীদলীয় ২২৭ জন এমপি অংশ নেন। তারা মোট ৫৪ ঘণ্টা ২৪ মিনিট আলোচনা করেন। এই ২৮ কার্যাদিবসে ৭টি বিল পাস হয়। এই সময়ে প্রধানমন্ত্রীর জন্য ১২৪টি প্রশ্ন জমা পড়ে। এর মধ্যে প্রধানমন্ত্রী ৫৫টি প্রশ্নের জবাব দেন। সপ্তম অধিবেশন শুরু হয় ১৮ এপ্রিল।

মহামারী করোনায় সারা দেশে অচলাবস্থার মধ্যে সংবিধানের ‘নিয়ম রক্ষায়’ দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে কম সময়ের সংসদ অধিবেশন হয় এটি। বিকাল ৫টায় অধিবেশন শুরু হয়ে চলে দেড় ঘণ্টারও কম সময়। ১০ জুন শুরু হওয়া অষ্টম (বাজেট) অধিবেশনে বাজেট পাসসহ ১৬টি সরকারি বিলের মধ্যে ৫টি সরকারি বিল পাস হয়। আইন প্রণয়ন সম্পর্কিত কাজ সম্পাদনের পাশাপাশি কার্যপ্রণালি বিধির ৭১ বিধিতে ১২টি নোটিস পাওয়া যায়। এ অধিবেশনে প্রধানমন্ত্রীর উত্তরদানের জন্য সর্বমোট ২৬ টি প্রশ্ন পাওয়া যায়, এর মধ্যে তিনি সম্পূরকসহ ১১টি প্রশ্নের উত্তর দেন। বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীদের উত্তরদানের জন্য প্রাপ্ত মোট ৪১০টি প্রশ্নের মধ্যে ১৫৬টি প্রশ্নের জবাব দেয়া হয়।

৬ সেপ্টেম্বর শুরু হওয়া নবম অধিবেশন চলে পাঁচ কার্যদিবস। এই অধিবেশনে ৬টি বিল পাস হয়। আর উত্থাপন হয় দুটি বিল। এ ছাড়া একটি বিল প্রত্যাহার করা হয়। ৭১ বিধিতে ৩৮টি নোটিস পাওয়া যায়। প্রধানমন্ত্রীর উত্তর দেয়ার জন্য ২৭টি প্রশ্ন পাওয়া যায়। যার মধ্যে তিনি সাতটি প্রশ্নের উত্তর দেন। অন্য মন্ত্রীদের জন্য ৬৬১টি প্রশ্ন পাওয়া যায় তার মধ্যে ১৮২টির উত্তর দেয়া হয়।

দশম অধিবেশন ৮ নভেম্বর শুরু হয়ে ১০ কার্যদিবস চলে। এ অধিবেশনে মোট ৯টি সরকারি বিল পাস করা হয়। কার্যপ্রণালি-বিধির ৭১ বিধিতে ৩৫টি নোটিস পাওয়া যায়। এ অধিবেশনে প্রধানমন্ত্রীর উত্তরদানের জন্য সর্বমোট ৩১টি প্রশ্ন পাওয়া যায়। তার মধ্যে তিনি ১৭টি প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন। মন্ত্রীদের উত্তরদানের জন্য মোট ৬৪২টি প্রশ্ন পাওয়া যায়। এর মধ্যে ৩০১টি প্রশ্নের উত্তর দেয়া হয়।

তৃতীয় বছরের প্রথম (একাদশ) অধিবেশন ১৮ জানুয়ারি শুরু হয়ে ১২ কার্যদিবস চলে। মোট ১৩৩ জন সংসদ সদস্য রাষ্ট্রপতির ভাষণের ওপর ধন্যবাদ প্রস্তাবের আলোচনায় অংশ নেন। মোট ২৫ ঘণ্টা ২৫ মিনিট আলোচনা হয়। এ অধিবেশনে মোট ছয়টি আইন পাস করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর উত্তর দানের জন্য মোট ৮৪টি প্রশ্ন পাওয়া যায়। এর মধ্যে তিনি ২৮টি প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন। বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীদের জন্য ১ হাজার ৬৮৯টি প্রশ্ন পাওয়া যায়। এর মধ্যে ৮২০টি প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন তারা।

মাত্র তিন কার্যদিবসের দ্বাদশ অধিবেশন শুরু হয় গতবছরের ১ এপ্রিল। সংক্ষিপ্ত এ অধিবেশনে পাঁচটি সরকারি বিল উত্থাপন করা হয়। এরপর ২ জুন শুরু হওয়া ত্রয়োদশ (বাজেট) অধিবেশনও করোনা মহামারীর কারণে মাত্র ১২ কার্যদিবস চলে। বাজেট পাসসহ এ অধিবেশনে সাতটি সরকারি বিল পাস হয়। আইন প্রণয়ন সম্পর্কিত কার্যাবলি সম্পাদনের পাশাপাশি কার্যপ্রণালি বিধির ৭১ বিধিতে ৪০টি নোটিস পাওয়া যায়। এ অধিবেশনে প্রধানমন্ত্রীর উত্তরদানের জন্য সর্বমোট ৭৩টি প্রশ্ন পাওয়া যায়। এর মধ্যে তিনি ৩০টি প্রশ্নের উত্তর দেন। বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীদের উত্তরদানের জন্য প্রাপ্ত মোট ১০৫৮টি প্রশ্নের মধ্যে ৭০০টি প্রশ্নের জবাব দেয়া হয়।

মাত্র সাত কার্যদিবসে নয়টি বিল পাসের মধ্য দিয়ে শেষ হয় একাদশ জাতীয় সংসদের চতুর্দশ অধিবেশন। ১৩ নভেম্বর শুরু হওয়া পঞ্চদশ অধিবেনও চলে ৯ কার্যদিবস। এই অধিবেশনে ৯টি বিল উত্থাপন হয়, পাসও হয় ৯টি বিল। ৭১ বিধিতে ৪২টি নোটিস পাওয়া যায়। যার মধ্যে একটিও আলোচনা হয়নি। প্রধানমন্ত্রীর উত্তর দেয়ার জন্য মোট ৪১টি প্রশ্ন এসেছিল, এর মধ্যে তিনি ১০টির জবাব দেন। অন্য মন্ত্রীদের জন্য প্রশ্ন জমা পড়ে ১ হাজার ১২টি। তার মধ্যে ৫৬৬টি উত্তর তারা দিয়েছেন। যেগুলোর উত্তর টেবিলে উপস্থাপিত হয়।

জাতীয়