অগ্রণী ব্যাংকের এমডির বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিং মামলার তদন্ত শুরু

অগ্রণী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মোহাম্মদ শামস-উল-ইসলামের বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিং মামলার তদন্ত শুরু করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। আর এই তদন্তের অংশ হিসেবে তার ও তার স্ত্রী নাসরিন হাসান চৌধুরীর ব্যাংক হিসাবও তলব করা হয়েছে। আজ বুধবারের (২৩ ফেব্রুয়ারি) মধ্যে ব্যাংক হিসাবের তথ্য জানাতে ব্যাংকগুলোকে অনুরোধ জানানো হয়েছে।

সূত্র জানিয়েছে, অগ্রণী ব্যাংকের এমডি শামস-উল-ইসলাম ঘুষ ও অবৈধ সুবিধা নিয়ে ঋণ প্রদানসহ নিয়োগ ও বদলি বাণিজ্য করে কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন। আত্মসাত্কৃত টাকা মানি লন্ডারিংয়ের মাধ্যমে বিদেশে পাচার করেছেন। অন্যদিকে, জ্ঞাত আয়বহিভূ‌র্ত সম্পদ অর্জনের অভিযোগও রয়েছে এই ব্যাংকারের বিরুদ্ধে।

এদিকে, গত সোমবার মহান ভাষা দিবসে শ্রদ্ধা জানাতে গিয়ে জুতা নিয়েই তিনি ও তার সহযোগী কয়েক জন শহীদ মিনারের বেদিতে ওঠেন। তাদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নিষেধ করা সত্ত্বেও জুতা পায়েই শহীদ মিনারের বেদিতে ওঠেন এবং পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন। বিষয়টি নিয়ে গতকাল মঙ্গলবার ব্যাংকপাড়ায় চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। সমালোচনার ঝড় ওঠে অগ্রণী ব্যাংকেও। বিষয়টি ছিল ‘টক অব দ্য সিটি’। সূত্রগুলো বলেছে, তিনি জুতা নিয়ে শহীদ মিনারে গিয়ে শ্রদ্ধা জানানোর বদলে শহীদদের অবজ্ঞা করেছেন।

এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) ড. মুহাম্মদ আব্দুস সামাদ বলেন, জুতা পায়ে শহীদ মিনারের বেদিতে ওঠা শহিদদের প্রতি অশ্রদ্ধা ও অবমাননা। এ বিষয়ে হাইকোর্টেরও নির্দেশনা রয়েছে, যাতে শহীদদের প্রতি যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করা হয়। আশা করি ভবিষ্যতে সবাই এ বিষয়ে সতর্ক থাকবেন।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অগ্রণী ব্যাংকে একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছেন মোহাম্মদ শামস-উল-ইসলাম। এই ব্যাংকে এসে বাংলাদেশ ব্যাংকও সঠিকভাবে কোনো কাজ করতে পারে না। ফলে বাংলাদেশ ব্যাংকের পর্যবেক্ষকেরাও শুধু সাক্ষী গোপাল হয়ে থাকেন। আর যারা এমডির কথা অনুযায়ী কাজ করেন না, তাদের নানাভাবে অসুবিধায় ফেলা হয়। এমনকি পদত্যাগ করতে বাধ্য করা হয় বা কাউকে উচ্চ পর্যায়ের নির্দেশে সরিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। এর আগে বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন পদত্যাগ করেছেন। গত ডিসেম্বরে এক পরিচালককে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। এমন উদাহরণ অহরহ। আর সফটওয়্যার ক্রয় থেকে শুরু করে নিয়োগ-বদলি বাণিজ্যের সঙ্গে তিনি জড়িত বলে জানা গেছে।

কোর ব্যাংকিং সফটওয়্যারের আড়ালে মানি লন্ডারিংয়ের ঘটনা ঘটেছে রাষ্ট্রায়ত্ত এই ব্যাংকে। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শক দল অগ্রণী ব্যাংকে সরেজমিন তদন্ত করে কোর ব্যাংকিং সফটওয়্যারের আড়ালে মানি লন্ডারিংয়ের বিষয়টি উদ্ঘাটন করে। পুরো প্রক্রিয়ায় অগ্রণী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা কতৃ‌র্পক্ষের দায় রয়েছে বলেও তদন্তকারী দল তাদের প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে। শুধু মুদ্রা পাচারই নয়, নিম্নমানের সফটওয়্যারে অগ্রণী ব্যাংককে ঝুঁকির মধ্যে ফেলে রাখার বিষয়টিও তদন্তে স্পষ্ট হয়। কোর ব্যাংকিং সফটওয়্যারের মাধ্যমে সংঘটিত মানি লন্ডারিংয়ের বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে দেশের আর্থিক গোয়েন্দা সংস্থা বিএফআইইউকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করা হয় ওই প্রতিবেদনে।

সূত্রমতে, উচ্চ আদালতের নির্দেশে বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যাংকিং প্রবৃদ্ধি ও নীতি বিভাগ অগ্রণী ব্যাংক কতৃ‌র্ক ব্যবহূত কোর ব্যাংকিং সলিউশন নিয়ে বিশেষ তদন্ত ও অনুসন্ধান শুরু করে। অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে চাঞ্চল্যকর সব তথ্য। অগ্রণী ব্যাংকের কোর ব্যাংকিং সফটওয়্যার (সিবিএস) আপগ্রেডেশন না হওয়ায় ব্যাংকটি ঝুঁকির মুখে পড়ে। অগ্রণী ব্যাংকের একজন উপ-মহাব্যবস্থাপকের স্বাক্ষর জালসহ সফটওয়্যার আপগ্রেডেশনে নানা জালিয়াতির আশ্রয় নেওয়া হয়। শুধু জালিয়াতিই নয়, বরং মানি লন্ডারিংয়ের বিষয়টিও সামনে চলে আসে। এ সংক্রান্ত মোট ব্যয়ের হিসাবেও অসামঞ্জস্য পরিলক্ষিত হয়েছে। তদুপরি সময়মতো আপগ্রেডেশন না করায় শাখা পর্যায়ে নানা সমস্যাও উদ্ঘাটিত হয়।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন মতে, অগ্রণী ব্যাংক কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কোর ব্যাংকিং সলিউশনের ১ হাজার ১৩৭টি কন্ট্রোল পয়েন্টের মাত্র ৫৩৪টি বাস্তবায়ন করে। এমনকি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সব শাখায়ও কোর ব্যাংকিং সলিউশন (সিবিএস) বাস্তবায়ন করা হয়নি। এ ব্যাপারে ব্যাংক কতৃ‌র্পক্ষ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে সঠিক তথ্য সরবরাহ না করার প্রমাণ মিলেছে। সিবিএস বাস্তবায়ন না হওয়ার পেছনে ব্যাংক ও সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান টেমিনসের স্থানীয় প্রতিনিধি ফ্লোরা টেলিকমের গাফিলতির প্রমাণও পাওয়া গেছে। তবে এই প্রক্রিয়ায় পারস্পরিক যোগসাজশে ব্যাংক থেকে অর্থ হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে।

ব্যাংক পরিচালনায় বিভিন্ন অনিয়মের আশ্রয় নিয়ে তিনি ব্যাংক চালাচ্ছেন বলে সম্প্রতি কিছু প্রমাণিত হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক রাষ্ট্রায়ত্ত অগ্রণী ব্যাংককে বড় অঙ্কের জরিমানা করেছে। ঋণখেলাপি গ্রুপের সহযোগী প্রতিষ্ঠানকে ঋণপত্র সুবিধা দেওয়ায় অগ্রণী ব্যাংককে ৫ লাখ টাকা জরিমানা করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। নথিপত্রে দেখা গেছে, তানাকা গ্রুপের সহযোগী প্রতিষ্ঠান সুইস কোয়ালিটি পেপার গত বছরের জানুয়ারিতে ১৪ কোটি টাকা এবং ডিসেম্বরে ১৩ কোটি টাকার ঋণপত্র খোলে অগ্রণী ব্যাংকে। ওই সময় গ্রুপটির ১০৩ কোটি টাকার ঋণখেলাপি ছিল। পাশাপাশি সুইস কোয়ালিটি পেপারকে নতুন করে দেওয়া ঋণসুবিধার বিষয়টি এক বছর ধরে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ঋণ তথ্য ব্যুরোতে (সিআইবি) যুক্ত করেনি ব্যাংকটি। এছাড়া গ্রুপটির অন্য প্রতিষ্ঠান মারহাবা স্পিনিং লিমিটেডের ২৬৯ কোটি টাকার তথ্যও সিআইবিতে যুক্ত করা হয়নি। এ কারণে অগ্রণী ব্যাংককে কেন্দ্রীয় ব্যাংক জরিমানা করে।

পরে জরিমানা মওকুফের জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে ব্যাংকের পক্ষ থেকে আবেদনও করা হয়েছিল। তবে সেই আবেদন নাকচ করে দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ফলে বাংলাদেশ ব্যাংকে রক্ষিত টাকা থেকে জরিমানার অর্থ কেটে নিয়েছে।

অর্থ বাণিজ্য