নিত্যপণ্যের দামে চিড়েচ্যাপ্টা হয়ে পড়েছে দেশের মানুষ। প্রতিদিনই হু হু করে বাড়ছে নিত্যপণ্যের দাম। লাগামহীনভাবে বাড়ছে চাল, ডাল, পেঁয়াজ ও ভোজ্যতেলের দাম। সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে গ্যাস-বিদ্যুতের বাড়তি খরচ। বাজারে ঢুকে পণ্যের দাম শুনতেই ক্রেতার হাত ওঠে মাথায়। দিশাহারা হয়ে পড়েছেন তারা। বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকার বিভিন্ন সময় নানা পদক্ষেপ নিচ্ছে। বিভিন্ন পর্যায়ে পণ্যের দাম বেঁধে দেওয়া হচ্ছে। পাশাপাশি বাজার মনিটরিংয়ে মাঠে অভিযান চালাচ্ছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরসহ সরকারের বিভিন্ন সংস্থা। কিন্তু সরকারের এসব উদ্যোগও যেন বিফলে যাচ্ছে। সরকারের নির্দেশনা উপেক্ষা করেই ব্যবসায়ীরা বেশি দামে পণ্য বিক্রি করছেন। রাজধানীর কদমতলীর বাসিন্দা বেসরকারি চাকরিজীবী মো. আনিস রহমান। সরকারের বেঁধে দেওয়া দাম উপেক্ষা করে কীভাবে ব্যবসায়ীরা বাড়তি দামে পণ্য বিক্রি করে, তা বুঝে উঠতে পারেন না তিনি। আনিস বলেন, ‘সরকারের নির্দেশ অমান্য করার ক্ষমতা আছে কার। অথচ সরকারের নির্ধারিত দাম উপেক্ষা করে বেশি দামে পণ্য বিক্রি করছেন ব্যবসায়ীরা। এর থেকে হতাশার আর কী হতে পারে। আমরা ব্যবসায়ীদের হাতে জিম্মি হয়ে আছি।’ বাজারের এমন পরিস্থিতির প্রতিকার কী- জানতে চাইলে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আপৎকালীন সময়ে নিত্যপণ্যের ওপর থেকে ভ্যাট প্রত্যাহার করতে হবে। আমদানি নির্ভরতা কমানোর পাশাপাশি উৎপাদনে স্বনির্ভর হতে হবে। তারা আরও বলেন, এখনো বাজারব্যবস্থাপনায় ত্রুটি এবং স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার অভাব রয়েছে।
এসব দূর করতে হবে। এ ছাড়া সরকারের কাছে চাহিদা ও সরবরাহের প্রকৃত পরিসংখ্যান থাকতে হবে।
বাজারে নিত্যপণ্যের দাম হঠাৎ হঠাৎ যে হারে বাড়ে, তা অস্বাভাবিক উল্লেখ করে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘আমাদের অভ্যন্তরীণ উৎপাদন ও ভোক্তা পর্যায়ে পণ্যমূল্যের যে বিশাল পার্থক্য, সেটাই আমাদের বড় সমস্যা। আমদানি ও খুচরা পর্যায়ের পণ্যমূল্যের পার্থক্যটাও একইভাবে অনেক বেশি। কিছুদিন আগেও কৃষি মন্ত্রণালয়ের গবেষণায় দেখা গেছে, স্থানীয় পর্যায়ে ১৩ টাকার সবজি রাজধানীর খুচরা বাজারে ৩৮ টাকায় বিক্রি হয়। পৃথিবীর অন্য কোথাও এমন নজির নেই। সুতরাং নিবিড় পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে বিভিন্ন পর্যায়ে পণ্যের মূল্য সমন্বয় করতে হবে।’
বর্তমানে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের অজুহাতে পণ্যের দাম বাড়াচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। কিন্তু এটা যৌক্তিক কারণ নয় উল্লেখ করে মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘ব্যবসায়ীরা বিভিন্ন সময়ে নানা অজুহাতে পণ্যের দাম বাড়ান। আগেও দেখেছি আমরা। বর্তমানে তারা রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের সুযোগ নিচ্ছেন। যদিও এ ইস্যুতে বিশ্ববাজারে অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। তবে এখনই দেশের বাজারে তার প্রভাব সেভাবে পড়ার কথা নয়। অথচ তিন মাস আগে আমদানিকৃত পণ্যের দাম বাড়িয়ে বিক্রি করা হচ্ছে। তখন তো ইউক্রেন যুদ্ধ ছিল না। তা ছাড়া এই ইস্যুর আগেও সব জিনিসপত্রের দাম অস্বাভাবিকভাবে বাড়ছিল।’
অতি প্রয়োজনীয় নিত্যপণ্যের দাম সাধারণ ক্রেতার নাগালে রাখতে সরকারের মজুদকৃত পণ্য খোলাবাজারে ছাড়া যেতে পারে, সেই সঙ্গে পণ্য পৌঁছানোর আওতা বাড়ানো যেতে পারে বলে পরামর্শ দেন মোস্তাফিজুর রহমান। তিনি আরও বলেন, অতি প্রয়োজনীয় পণ্যের আমদানিতে শুল্ক-ভ্যাট সমন্বয় করে কিছুটা সুরাহা করা যেতে পারে। ভোক্তা অধিকারসহ বাজার সংশ্লিষ্ট সরকারি সংস্থাগুলোকে আরও কার্যকর করা যেতে পারে।
ভোক্তা অধিকার নিয়ে দেশে কাজ করছে বাংলাদেশ কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)। সংগঠনটির সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, ‘মুক্তবাজার অর্থনীতিতে পণ্যে দাম নির্ধারণ করে কাজ হবে না। চাহিদা নিরূপণ করে সে অনুযায়ী সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। পণ্যের সরবরাহ স্বাভাবিক কিংবা তার কাছাকাছি থাকলে দাম আপনা থেকেই যৌক্তিক পর্যায়ে থাকবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের বাজার মনিটরিং ভ্রাম্যমাণ আদালতও মামলা-জরিমানায় সীমাবদ্ধ। বাজারে হাতেগোনা, লোক দেখানো মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করেও কাজ হবে না। এতে কেবল কিছু সংখ্যক ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। এ ছাড়া কোনো ফল মিলবে না। বাজারে নিবিড় পর্যবেক্ষণ থাকতে হবে। সরকারের কাছে পণ্যের প্রকৃত হিসাব থাকতে হবে। বাজার সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, অধিদপ্তর ও সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয় থাকতে হবে সবার আগে।’
আমদানি নির্ভরতা কাটিয়ে দেশীয় উৎপাদনে সক্ষমতা অর্জনের তাগিদ দেন ক্যাব সভাপতি। তিনি বলেন, ‘দেশীয় উৎপাদন বাড়াতেই হবে। এটিই টেকসই সমাধান। আমদানি বাড়িয়ে তাৎক্ষণিক সমাধান হলেও সেটা টেকসই সমাধান নয়। যেটা পেঁয়াজকা-ে আমরা দেখেছি।’
দেশের এবার চালের উৎপাদন সন্তোষজনক। আমনে ভালো ফলন হয়েছে, আউশের ফলন ভালো। অপরদিকে পেঁয়াজের আবাদ প্রতিবছর বাড়ছে। সবজির আবাদ এবং ফলন দুটিই বেড়েছে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর। অভ্যন্তরীণ উৎপাদনে দেশের সক্ষমতা বাড়লেও বাজারে পণ্যের দাম কমছে না।
রাজধানীর বাজারে চিকন চাল ৬২ থেকে ৭৮ টাকা এবং মাঝারি চাল ৫৬ থেকে ৫৮ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে। গরিবের মোটা চালের দামও এখন ৫০ টাকায় গিয়ে ঠেকেছে। সংকট দেখিয়ে ৬৫ থেকে ৭০ টাকায় দেশি পেঁয়াজ বিক্রি করছেন ব্যবসায়ীরা। সবজির দামও নাগালে নেই। বেশিরভাগ সবজির কেজি ৫০ টাকার ওপরে। কাঁচামরিচ, বরবটি, ঢেঁড়শ, করলাসহ বেশ কয়েকটি সবজির দাম একশ টাকা ছাড়িয়েছে।
এরই মধ্যে বোতলজাত সয়াবিনের দাম লিটারপ্রতি আরও ১২ টাকা বাড়ানোর জোর চেষ্টা চালাচ্ছে পরিশোধনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো। যদিও সরকার এখনো পর্যন্ত এ বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত দেয়নি। কিন্তু এরই মধ্যে ব্যবসায়ীরা সয়াবিনের কৃত্রিম সংকট তৈরি করে বাজার অস্থির করে তুলেছেন। বাজারে অনেক দোকানেই বোতলজাত তেল গায়েব হয়ে গিয়েছে। যেখানে পাওয়া যাচ্ছে, সেখানেও বোতলের লিটার বিক্রি হচ্ছে ১৭০ থেকে ১৮০ টাকা পর্যন্ত। পাঁচ লিটারের বোতল বিক্রি হচ্ছে ৮২০ থেকে ৮৫০ টাকা পর্যন্ত। মসুর ডালের দাম স্বল্প আয়ের ভোক্তাদের নাগালের বাইরে গেছে অনেক আগেই। মোটা দানার মসুর এখন বিক্রি হচ্ছে ১০০ থেকে ১১০ টাকা কেজি। খোলা চিনির কেজি এখন ৭৬ থেকে ৮০ টাকা। বেড়েছে আটা-ময়দার দামও। অপরদিকে গরুর মাংসের দাম ঠেকেছে ৬৫০ টাকায়। গরিবের প্রোটিনের সহজ উৎস ব্রয়লার মুরগির দামও রেহাই দেয়নি। ব্রয়লারের কেজি এখন ১৬৫ টাকা। ডিম খেয়ে দিন পার করার দিন ফুরিয়ে গেছ। ডিমের ডজনও এখন ১২০ টাকা।
ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন বলেন, ঘাটতি না থাকার পরেও সয়াবিন তেলের দাম বৃদ্ধি অস্বাভাবিক। গুটি কয়েক অসাধু ব্যবসায়ীর জন্য পুরো ব্যবসায়ী সমাজের ভাবমূর্তি ক্ষুণœ হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, ভোজ্যতেলের দাম নিয়ন্ত্রণে প্রতিবেশী দেশ ভারত তিনবার শুল্ক ও ভ্যাট সমন্বয় করেছে। বাংলাদেশেও ভ্যাট প্রত্যাহার করা উচিত।
লাগাতার বাড়তে থাকা নিত্যপণ্যের দামে দিশাহারা সাধারণ মানুষ। কম দামে পণ্য পেতে টিসিবির ট্রাকের পেছনে দীর্ঘ হচ্ছে লাইন। রোদ-বৃষ্টি মাথায় নিয়ে অপেক্ষা করেও টিসিবির পণ্য মিলছে না। সাধারণ মানুষের একটাই প্রশ্ন, এই দুর্ভোগের শেষ কোথায়। এ পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণ মিলবে কবে? এ বিষয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব ও জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এএইচএম সফিকুজ্জামান আমাদের সময়কে বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে নিত্যপণ্যের দাম প্রতিদিনই বাড়ছে। বিশ্ববাজারে দাম বাড়লে দেশে দাম বাড়বে, এটাই স্বাভাবিক। তবে এখনো রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব দেশীয় বাজারে পড়েনি। বাজার অস্থিরতা নিয়ন্ত্রণে সরকারের বিভিন্ন দপ্তর কাজ করছে। প্রয়োজনে বদলে ফেলা হবে বাজার তদারকির ধরনও।
এদিকে বাজারে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করতে গিয়ে ব্যবসায়ীদের কাছে ক্রয় রসিদ পাচ্ছে না সরকারি সংস্থাগুলো। ব্যবসায়ীরা বলছেন, পণ্য ক্রয়ে তাদের কোনো রসিদ দেওয়া হয় না। দীর্ঘদিন ধরেই এমনটা চলছে। এই সুযোগ নিয়ে ব্যবসায়ীরা ইচ্ছামতো বাড়তি দাম রাখছেন বলে অভিযোগ উঠছে বারবার।
গতকাল মঙ্গলবার খুচরা ও পাইকারি ব্যবসায়ীদের নিয়ে ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদপ্তরের এক সভায় এএইচএম সফিকুজ্জামান বলেন, রমজান পর্যন্ত চাহিদা মেটাতে দেশে পর্যাপ্ত তেল মজুদ আছে। সংকটের ধোঁয়াশা সৃষ্টি করে দাম বাড়ানোর চেষ্টা করা হচ্ছে।
বাজারের অস্থিরতার কারণগুলো সবার জানা, কিন্তু সমাধান নিয়ে উদাসীনতা দেখা যাচ্ছে বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং বিভাগের অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান। আমাদের সময়কে তিনি বলেন, ‘আমরা সমস্যার গোড়াতে হাত না দিয়ে বাজার নিয়ন্ত্রণের ব্যর্থ চেষ্টা করছি। আমরা জানিই না বাজার মনিটরিং কী। আমাদের বাজার ব্যবস্থাপনা ও মনিটরিংয়েই গলদ রয়েছে। আমাদের কাছে পণ্যের চাহিদা, মজুদ ও সরবরাহের প্রকৃত তথ্য নেই। এসব বিষয়ে পরিসংখ্যান নেই সরকারের কাছে। আগে আমাদের পরিসংখ্যান লাগবে। তারপর পরিসংখ্যানে নিবিড় পর্যবেক্ষণ থাকতে হবে। সে অনুযায়ী পদক্ষেপ নিতে হবে। আমাদের হাতে পরিসংখ্যানই নেই, তাহলে আমরা কীভাবে বাজার সামলাব। মুক্ত বাজার অর্থনীতিতে এসব মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করে কাজ হবে না।’