আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় শরিকদের ক্ষোভ

আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় শরিকদের ক্ষোভ

দীর্ঘ তিন বছরেরও বেশি সময় পর জোট প্রধানের ডাকে বৈঠকে বসলেন আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলের শরিক নেতারা। বৈঠকে নিজেদের পাওয়া না পাওয়ার বেদনা নিয়ে প্রকাশ্যে কিছু না বললেও সরকারপ্রধানের কাছে নানা বিষয়ে অসঙ্গতি তুলে ধরেছেন জোট নেতারা।

বিশেষ করে সরকারে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন সিনিয়র নেতারা। চলমান নিত্যপণ্য নিয়ে সরকারবিরোধীদের অপরাজনীতি ও জনগণের মনোভাব বুঝে দ্রুত ব্যবস্থা নেয়ারও তাগিদ দেন তারা। নেতাদের বক্তব্যের জবাবের পাশাপাশি আগামী জাতীয় নির্বাচনে জোটগতভাবে লড়ার প্রস্তুতি নিতে সবাইকে নির্দেশনা দিয়েছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বৈঠক সূত্রে এমনটাই জানা গেছে।

গতকাল মঙ্গলবার বেলা ১১টায় প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন গণভবনে জোটের বৈঠক বসে। জোটপ্রধান ও আ.লীগের সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে বৈঠকে অংশ নেন ১৪ দলীয় জোটের সমন্বয়ক ও মুখপাত্র আমির হোসেন আমু, আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য অ্যাভোকেট জাহাঙ্গীর কবির নানক, আব্দুর রহমান, ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন, জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু, সাধারণ সম্পাদক শিরিন আক্তার, তরিকত ফেডারেশনের সভাপতি নজিবুল বশর মাইজভাণ্ডারী, বাংলাদেশ গণআজাদী লীগের সভাপতি অ্যাডভোকেট এস কে সিকদার, ন্যাপের সভাপতি আইভি আহমেদ, সাধারণ সম্পাদক ইসমাইল হোসেন, মজদুর পার্টির সাধারণ সম্পাদক জাকির হোসেন ও ১৪ দলের শীর্ষ নেতারা।

বৈঠক সূত্রে জানা যায়, নিত্যপণ্যের ঊর্ধ্বমুখী নিয়ে চলমান সমস্যা ও তা সমাধানের জন্য আওয়ামী লীগের সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দৃষ্টি আকর্ষণ করে বক্তব্যে রাখেন ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন ও বাংলাদেশ গণআজাদী লীগের সভাপতি অ্যাডভোকেট এস কে সিকদার।

সরকারপ্রধানকে উদ্দেশ্য করে তারা বলেন, দ্রব্যমূল্য নিয়ে সাধারণ মানুষের মাঝে দুর্ভোগ সৃষ্টি হয়েছে। দ্রব্যমূল্য নিয়ে সৃষ্ট সমস্যা দ্রুত সমাধান করতে সরকারকে সব ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। সাম্প্রদায়িক অপশক্তি ও দেশের আমলাতান্ত্রিক জটিলতা নিয়েও কথা বলেন রাশেদ খান মেনন।

তিনি বলেন, ‘আমরা যারা রাজনীতি করি, তারা যেন কোনোভাবে আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কাছে বন্দি না হয়ে যাই। পরিস্থিতি সেদিকেই কিন্তু যাচ্ছে। এ বিষয়ে আপনার (প্রধানমন্ত্রী) গুরুত্ব দিতে হবে। নইলে আগামীতে আমলাতান্ত্রিক বিষয়টি আরও খারাপের দিকে যাবে।’

তিনি বলেন, ‘সাম্প্রদায়িক বিষয়গুলো আরও গুরুত্ব দিয়ে দেখতে হবে। বিশেষ করে তৃণমূল পর্যায়ে সাম্প্রদায়িক ঘটনার সাথে আমাদের অনেক নেতাকর্মী সরাসরি জড়িয়ে পড়ছেন। তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। যাতে আমাদের কোনো নেতাকর্মী আর এমন ঘটনার সাথে যুক্ত না হতে পারে।’ ১৪ দলীয় জোট নেতাদের সম্মান ও জোটের ঐক্যের বিষয়ে আরও সতর্ক হওয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রীকে আহ্বান জানিয়ে মেনন বলেন, ‘আমাদের জোট শরিক দলের যে সব নেতা রয়েছেন তাদের যেন অসম্মান না হয় সেদিকে আপনাকে (প্রধানমন্ত্রী) নজর দিতে হবে। যেন আমাদের জোটের ঐক্য ভেঙে না যায়।’

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশের উন্নয়নচিত্র তুলে ধরে ন্যাপের চেয়ারম্যান আইভি আহম্মেদ বলেন, ‘আপনার কঠোর পরিশ্রম এবং সময়োপযোগী সিদ্ধান্তের কারণে আজ দেশের চেহারা বদলে গেছে। বাংলাদেশ আজ বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির কারণে নিম্ন ও মধ্যবিত্তের নাভিশ্বাস উঠেছে।’ জনগণের বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে দেখার অনুরোধ জানান তিনি।

তাদের এমন বক্তব্যের পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বর্তমান আন্তর্জাতিক বিশ্বের পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করে বলেন, ‘বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতে নিত্যপণ্যের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর মতো তার প্রভাব আমাদের দেশেও পড়েছে।’

নিত্যপণ্যের ঊর্ধ্বমুখী চলমান সমস্যা নিয়ে তার সরকার কাজ করছে জানিয়ে সরকারপ্রধান বলেন, ‘আমরা টার্গেট করেছি এক কোটি মানুষকে আমরা স্পেশাল কার্ড দেবো। যেটা দিয়ে তারা ন্যায্যমূল্যে জিনিস কিনতে পারবে। যে ৩৮ লাখকে আমরা টাকা দিচ্ছি তারা তো থাকবে, তার বাইরেও আরও এক কোটি লোককে দেবো। তা ছাড়া ৫০ লাখ লোককে একটা কার্ড দেয়া আছে সেটা থেকে তারা ১০ টাকায় চাল কিনতে পারে। সেই ব্যবস্থা করা আছে।’

ফসল উৎপাদন বাড়ানোর তাগিদ দিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, ‘কারো এতটুকু জমি যেন অনাবাদি না থাকে। যে যা পারেন সেটাই উৎপাদন করেন। প্রত্যেক এলাকায় কিছু না কিছু উৎপাদন হবেই। সেটাই আমার লক্ষ্য। তাতে আমাদের যে খাদ্যচাহিদা সেটা যেন পূরণ করতে পারি।’

১৪ দলীয় জোটের বৈঠকে উপস্থিত থাকা একাধিক নেতা জানান, দীর্ঘদিন পর আওয়ামী লীগের সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে ১৪ দলীয় জোটের আলোচনায় সব থেকে বেশি গুরুত্ব পেয়েছে জোটকে মাঠ পর্যায়ের রাজনীতিতে সক্রিয় করা। মূলত দীর্ঘদিন ধরেই নিষ্ক্রিয় ১৪ দলীয় জোটের সাংগঠনিক কার্যক্রম। শুধু দিবস ভিত্তিক অনুষ্ঠান পরিচালনা করে আসছিলেন জোটের নেতারা। ফলে জনসাধারণের অধিকার প্রতিষ্ঠায় প্রশ্নবিদ্ধ জোটের কার্যক্রম। যা নিয়ে জোট শরিক নেতারা ক্ষুব্ধ। এমন অবস্থায় বৈঠকে কথা তোলেন জোটভুক্ত উপস্থিত নেতারা।

বিশেষ করে আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ১৪ দলীয় জোটের গ্রহণযোগ্যতা কিভাবে বৃদ্ধি করা যায় তা নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ হয়। তবে মাঠ পর্যায়ের এসব কার্যক্রমের রূপরেখা ও সাংগঠনিক কর্মপরিকল্পনা তৈরি করতে উপস্থিত জোটের নেতাদের নির্দেশনা দেন আওয়ামী লীগের সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। জোটপ্রধানের এমন নির্দেশনার পর জোট শরিকদের সাথে আলাদা আলোচনার কথা বলেন জোটের সমন্বয়ক ও মুখপাত্র আমির হোসেন আমু। অল্প কিছু দিনের মধ্যেই নতুন ফের বৈঠকে বসবেন জোটভুক্ত নেতারা।

বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু আমার সংবাদকে বলেন, ‘আজকের আলোচনায় জোটকে সক্রিয় করতে বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। এখন জোটকে সক্রিয় করাই মূল কথা। জোটকে সক্রিয় করতে সমন্বয়ক ও মুখপাত্র আমির হোসেন আমুর নেতৃত্বে আমরা আলোচনা বসব এবং জোটের সাংগঠনিক কার্যক্রম ঠিক করব। এটাই আমাদের সিদ্ধান্ত।’

বৈঠকের এক পর্যায়ে আগামী দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনের পরিকল্পনা কী হবে বা এ বিষয়ে কিছু ভাবছেন কি-না, জোট শরিক দলের এক নেতার এমন প্রশ্নের উত্তরে আওয়ামী লীগের সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘বিগত নির্বাচনের মতোই আগামী দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচন জোটগতভাবে অংশগ্রহণ করব। এ সময় উপস্থিত নেতাদের জোটগতভাবে নির্বাচনে অংশগ্রহণের জন্য প্রস্তুতি নেয়ার আহ্বান জানান।’

বৈঠক বিষয়ে জানতে চাইলে ন্যাপের সাধারণ সম্পাদক ইসমাইল হোসেন আমার সংবাদকে বলেন, ‘নিত্যপণ্যের ঊর্ধ্বমুখী ও জোটের কার্যক্রম নিয়ে আলোচনা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী আমাদের কথা শুনেছেন এবং নিত্যপণ্য নিয়ে সৃষ্ট সমস্যা সমাধানের আশ্বাস দিয়েছেন

রাজনীতি