আকাশ ছুঁয়েছে নির্মাণ ব্যয়

আকাশ ছুঁয়েছে নির্মাণ ব্যয়

বর্তমান করোনাভাইরাস মহামারী পরিস্থিতিতে নির্মাণসামগ্রীর দাম অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ায় আবাসন ব্যবসায়ীরা বাড়তি নির্মাণব্যয় সমন্বয় শুরু করেছেন। এ অবস্থায় ফ্ল্যাটের দাম ৩০ শতাংশের বেশি বেড়ে যেতে পারে। মধ্যবিত্তদের জন্য যে ফ্ল্যাট কিছুদিন আগেও ৬০ থেকে ৮০ লাখ টাকায় পাওয়া যেত, তা এখন ৮০ লাখ থেকে কোটি টাকা ছাড়িয়ে যেতে পারে। এতে করে মৌলিক চাহিদার অন্যতম আবাসন মধ্যবিত্ত শ্রেণির নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে।

অন্যদিকে বাড়তি দাম সমন্বয় করতে না পারায় অনেক আবাসন ব্যবসায়ী পড়েছেন বিপাকে। কেউ কেউ ব্যবসা গুটিয়ে ফেলারও চিন্তা করছেন।

আর-রাহা বিল্ডার্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. হুমায়ুন কবীর রাজধানীর মিরপুরে নিম্ন মধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্তদের জন্য ফ্ল্যাট তৈরি করেন। গত ১০ বছর ধরে আবাসন ব্যবসা করছেন তিনি। নির্মাণসামগ্রীর অস্বাভাবিক দাম বেড়ে যাওয়ায় ব্যবসা গুটিয়ে ফেলার পরিকল্পনা করছেন হুমায়ুন। তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘এখন নির্মাণসামগ্রীর দাম যে হারে বাড়ছে, তাতে ফ্ল্যাটের ক্রেতাদের কাছে প্রতিশ্রুতি রক্ষা করা কঠিন হয়ে পড়ছে। মূলত আমার এলাকায় জমি-মালিকদের সঙ্গে অংশীদারত্বের ভিত্তিতে প্রকল্প হাতে নিই এবং নির্ধারিত দামে প্রকল্প বাস্তবায়নের শুরুতেই তা বিক্রি হয়। ক্রয়-বিক্রয় চুক্তি থাকায় এখন নির্মাণসামগ্রীর দাম বাড়লেও ফ্ল্যাটের দাম বাড়ানো যায় না। আবার যেসব ফ্ল্যাট অবিক্রীত থাকে, সেগুলোর দাম বেশি হওয়ায় ক্রেতাও পাওয়া যায় না। এমন পরিস্থিতিতে ব্যবসা গুটিয়ে ফেলানো ছাড়া অন্য কোনো বিকল্প হাতে নেই।’

ভবন নির্মাণের প্রধান উপকরণ হচ্ছে রড, সিমেন্ট, পাথর, বালু, ইট ইত্যাদি। গত দুই বছরে শুধু রডের দাম বেড়েছে ৪০ শতাংশের বেশি। ২০২০ সালে দেশের সেরা ব্র্যান্ডের যে রড প্রতি টন ৬৪ হাজার টাকায় বিক্রি হতো, গতকাল বৃহস্পতিবার পর্যন্ত তা ৯০ হাজার টাকা ছাড়িয়ে গেছে। প্রতি ঘনফুট ৮ টাকা দরের বালুর দাম হয়েছে ৩০ টাকা, বেড়েছে ২৭৫ শতাংশ। প্রতি বর্গফুট পাথর ১৬০ থেকে বেড়ে এখন ২৪০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। কয়লার দাম বেড়ে যাওয়ায় ৬-৮ টাকা দামের ইট ১০-১২ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এক্ষেত্রে দাম বেড়েছে ৫০ থেকে ৬৬ শতাংশ।

বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম ও জাহাজ ভাড়া বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি করোনার প্রাথমিক ধাক্কা কাটিয়ে ওঠার পর ভোক্তা পর্যায়ে পণ্যের চাহিদা বাড়ায় প্রায় সব কাঁচামালের দরই অব্যাহতভাবে বাড়ছে। উচ্চহারে নির্মাণসামগ্রীর দাম বৃদ্ধির এটিই প্রধান কারণ বলে জানিয়েছেন খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।

এ ছাড়া গত ২৪ ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হওয়া ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ মূল্যবৃদ্ধির উনুনে আরও ঘি ঢেলেছে। ফলে কোনো লাগাম ছাড়াই দাম বাড়ছে।

তবে নির্মাণ খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা মনে করছেন, বিশ্ববাজারে যতটা না বাড়ছে, সংকট দেখিয়ে তারচেয়ে বেশি দাম বাড়াচ্ছেন দেশের ব্যবসায়ীরা। যৌক্তিক মূল্য নির্ধারণে ব্যবস্থা চান তারা। তা না হলে করোনার ধাক্কা কাটিয়ে আবাসন খাত ঘুরে দাঁড়ানোর যে প্রক্রিয়া শুরু করেছিল, তা থমকে যাবে।

এ বিষয়ে আবাসন ব্যবসায়ীদের সংগঠন রিহ্যাব সহসভাপতি কামাল মাহমুদ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আন্তর্জাতিক বাজারের দোহাই দিয়ে প্রতিদিনই দাম বাড়ানো হচ্ছে। এখন বলা হচ্ছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে সব ধরনের কাঁচামালের দাম বেড়েছে। কিন্তু আমরা দেখছি, যুদ্ধ শুরুর আগেই সব পণ্যের দাম অস্বাভাবিক হারে বাড়ছিল। আর যুদ্ধ শুরুর পর তা এখন নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে।’ তিনি বলেন, ‘আন্তর্জাতিক বাজারের তুলনায় দেশে দাম যৌক্তিক হারে বাড়ছে কিনা, সেটি দেখার কেউ নেই।’

এই ব্যবসায়ী নেতা বলেন, “আমাদের দেশে ভোক্তাদের স্বার্থ দেখার জন্য একটি প্রতিষ্ঠান আছে ‘জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর’। নির্মাণসামগ্রীর অস্বাভাবিক দরবৃদ্ধিতে এই প্রতিষ্ঠানটির কাজ করার সুযোগ থাকলেও আমরা কখনোই তা দেখিনি।”

কামাল মাহমুদ আরও বলেন, মৌসুম শুরুর আগেই নির্মাণের প্রধান উপাদান রড, সিমেন্ট, ইটের দাম কোনো কারণ ছাড়াই বেড়ে যায়। কিন্তু এবার অনেক দিন থেকেই বাড়ছে, দাম বাড়ানোর জন্য মৌসুমের প্রয়োজন হচ্ছে না। নির্মাণসামগ্রীর দাম বাড়ায় ভবন নির্মাণ ব্যয় ৪০ থেকে ৪৫ শতাংশ বেড়ে গেছে। ফলে ফ্ল্যাট মধ্যবিত্তের নাগালের বাইরে চলে যাবে। আবাসনের মতো মৌলিক চাহিদা পূরণ হবে না।

সম্প্রতি নির্মাণসামগ্রীর দরবৃদ্ধি নিয়ে জরিপ চালিয়েছে রিহ্যাব। সংগঠনটির জরিপে শুধু রড, সিমেন্ট, পাথর, বালু কিংবা ইট নয় ভবন নির্মাণসংশ্লিষ্ট সব পণ্যেরই দাম বেড়েছে। এমনকি নির্মাণকাজে জড়িত শ্রমিকদের শ্রমমূল্যও গত দুই বছরে উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। ভবন নির্মাণে ২০২০ সালে প্রতি বর্গফুটের জন্য শ্রমমজুরি ছিল ১৪০ টাকা, যা চলতি বছরে ২২০ টাকায় উন্নীত হয়েছে।

২০২০ সালে প্রতি বর্গফুট থাই অ্যালুমিনিয়ামের দাম ছিল ২৫০ টাকা, যা এখন বেড়ে হয়েছে ৪২০ টাকা। গ্রিল ও রেলিংয়ের দাম প্রতি বর্গফুট প্রায় ৪৩ শতাংশ বেড়ে ১৫০ টাকায় দাঁড়িয়েছে। স্যানিটেশনে ব্যয় ৪০ শতাংশ বেড়েছে। সিলেট বালু, পিভিসি পাইপ-ফিটিংসের দামও বেড়েছে। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে পুরোনো লোহার টুকরা বা স্ক্র্যাপ ও প্লাস্টিকসামগ্রীর কাঁচামালের দামও বাড়ছে। ফলে আগামী দিনগুলোতে রডসহ অন্যান্য পণ্যের দাম আরও বাড়তে পারে বলে ব্যবসায়ীরা শঙ্কা প্রকাশ করেছেন।

রিহ্যাবের জরিপ অনুযায়ী, নির্মাণসামগ্রীর মূল্যবৃদ্ধির কারণে প্রতি বর্গফুটের নির্মাণ ব্যয় বেড়েছে প্রায় ৩৫৫ টাকা। জমির মালিকের সঙ্গে ফ্ল্যাট ভাগাভাগির কারণে নির্মাণ প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যয় বেড়েছে প্রতি বর্গফুটে ৭১০ টাকা। নির্মাণসামগ্রীর অব্যাহত দাম বাড়ায় আবাসন প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যয় প্রতিদিনই বাড়ছে।

ইস্পাত কোম্পানিগুলো জানিয়েছে, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ শুরুর আগে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতি টন স্ক্র্যাপের দাম ছিল ৫৭০ ডলার, যা চলতি সপ্তাহের শুরুতে ৬৯০ থেকে ৭১০ ডলারে পৌঁছে। অবশ্য এ দাম আরও বাড়তে শুরু করেছে। গত বুধবার অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ড থেকে স্ক্র্যাপের দাম টনপ্রতি ৭৩০ থেকে ৭৪০ ডলার চাওয়া হচ্ছে।

বিএসআরএম গ্রুপের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি) তপন সেনগুপ্ত দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বর্তমানে আন্তর্জাতিক বাজারে যে হারে স্ক্র্যাপের দাম বেড়েছে, দেশে তার তুলনায় কম দামে রড বিক্রি করছি। এমনকি পাশর্^বর্তী দেশ নেপাল, ভারতের তুলনায়ও দেশে কম দামে রড বিক্রি হচ্ছে। আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সমন্বয় করা হলে বর্তমানের দামের চেয়ে অন্তত ৮-৯ হাজার টাকা বেশি দরে রড বিক্রি করতে হবে। কিন্তু দেশের আবাসন খাতের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে আর্থিক ঝুঁকি নিয়ে রড উৎপাদন করছি, যাতে সরবরাহ ঠিক থাকে।’

এখন রডের দাম বাড়ার প্রধান কারণ হচ্ছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। তপন সেনগুপ্ত বলেন, ‘রাশিয়া ও ইউক্রেন থেকে স্ক্র্যাপ কিংবা লৌহজাত পণ্য আসছে না। দক্ষিণ কোরিয়া, তুরস্কসহ বেশকিছু দেশ রাশিয়া ও ইউক্রেন থেকে আমদানি করত, আমরাও করতাম। কিন্তু চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কম থাকায় এখন সুনির্দিষ্ট কয়েকটি উৎসের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে। ফলে দাম বাড়ছে। এ ছাড়া জ্বালানি তেল ও জাহাজ ভাড়াও কয়েক মাসে অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে। এটিও কাঁচামালের দাম বৃদ্ধির অন্যতম কারণ।’ তিনি বলছেন, ইতিমধ্যেই দাম আরও বাড়তে শুরু করছে।

এদিকে জাহাজীকরণের খরচ বাড়ায় আন্তর্জাতিক বাজারে সিমেন্টের প্রধান কাঁচামাল ক্লিংকারের দামও ব্যাপক হারে বেড়েছে। গত দুই মাসের ব্যবধানে ক্লিংকার জাহাজীকরণে ব্যয় বেড়েছে ৪০ শতাংশের বেশি। এ ছাড়া সাম্প্রতিক সময়ে দেশে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির কারণে কাঁচামাল ও উৎপাদিত পণ্য পরিবহন ব্যয়ও উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। এসব কারণে নতুন করে সিমেন্টের দাম বাড়াতে চাইছে বাংলাদেশ সিমেন্ট ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিসিএমএ)। প্রসঙ্গত, দেশে সিমেন্টের কাঁচামাল প্রায় পুরোটাই আমদানিনির্ভর।

সম্প্রতি বিসিএমএ’র প্রেসিডেন্ট ও ক্রাউন সিমেন্টের ভাইস চেয়ারম্যান মো. আলমগীর কবির বলেন, একদিকে জাহাজীকরণের অব্যাহত মূল্যবৃদ্ধি, অন্যদিকে তীব্র প্রতিযোগিতার কারণে দেশীয় সিমেন্ট কোম্পানিগুলো ব্যাপক লোকসান দিয়ে যাচ্ছে, যা কোনোভাবেই দীর্ঘদিন চলতে পারবে না। এমতাবস্থায় সিমেন্ট কোম্পানিগুলো টিকে থাকার স্বার্থে মূল্য সমন্বয়ের চেষ্টা করে যাচ্ছে। এখনই যদি মূল্য সমন্বয় না করা হয়, তাহলে সিমেন্ট খাতে ব্যাপক ক্ষতির সম্ভাবনা রয়েছে।

সাম্প্রতিক সময়ে অস্ট্রেলিয়ায় ভারী বৃষ্টিপাতের কারণে বন্যা দেখা দিয়েছে। এর প্রভাবে দেশটিতে উৎপাদিত কয়লার দাম বেড়ে গেছে। ইটভাটা মালিকরা জানিয়েছেন, গত এক বছরে প্রতি টন কয়লার দাম ৭ হাজার থেকে বেড়ে ২৪-২৫ হাজার টাকা হয়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় সামনের দিনগুলোতে ইটের দাম আরও বাড়তে পারে বলে মনে করছেন ইটভাটা মালিকরা।

ভবন নির্মাণে ব্যবহৃত পিভিসি ও ইউপিভিসি পাইপ-ফিটিংস, দরজা, সিলিং ইত্যাদি পণ্যের দামও গত কয়েক মাসে ৩০ শতাংশের বেশি বেড়েছে।

অর্থ বাণিজ্য