নদী দূষণমুক্ত করে পানিপ্রবাহ বাড়ানো না গেলে আগামী ১৫ বছরের মধ্যে পানির অভাবে বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়বে ঢাকা। এ অবস্থা থেকে উত্তরণে এখনই সমন্বিত কার্যক্রমের উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন।
সোমবার (২১ মার্চ) দুপুরে বাংলাদেশ শিশু কল্যাণ পরিষদে ‘ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার ও জলবায়ু পরিবর্তনে করণীয়’ শীর্ষক এক আলোচনা সভায় এসব কথা বলেন বক্তারা।
বাংলাদেশ পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা), বাংলাদেশ নিরাপদ পানি আন্দোলন (বানিপা) ও মানবাধিকার উন্নয়ন কেন্দ্রের যৌথ উদ্যোগে এ সভা হয়।
বক্তারা বলেন, দেশের অন্যান্য এলাকার মতো ঢাকায়ও ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ভীতিকর গতিতে নিচে নেমে যাচ্ছে। ১৯৭০ সালে ৪৯টি গভীর নলকূপ ছিল ঢাকা মহানগরীতে। এখন ঢাকার চারপাশের নদীগুলোর পানি ব্যবহারের অনুপযোগী হওয়ায় সুপেয় পানির চাহিদার শতকরা ৭৮ ভাগ গভীর নলকূপের মাধ্যমে ভূগর্ভস্থ থেকে উত্তোলন করছে ওয়াসা। এতে ৯০০টি নলকূপ ব্যবহার হচ্ছে। নদীর পানি দূষিত হওয়ার অজুহাতে ওয়াসা একের পর এক নলকূপ বসিয়ে যাচ্ছে। অথচ ওয়াসাকে নদীর পানি দূষণরোধে কার্যকর তেমন কোনো উদ্যোগ নিতে দেখা যাচ্ছে না।
সভায় জানানো হয়, ভূগর্ভস্থ পানির স্তর প্রতি বছর ১০ ফুট করে নিচে নেমে যাচ্ছে। অন্যদিকে শিল্পকারখানার অপরিশোধিত বর্জ্য সরাসরি ফেলা হচ্ছে নদীতে। ফলে বেড়েই চলছে নদীদূষণের মাত্রা। অন্যদিকে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে লবণাক্ত পানি উজানে প্রবাহিত হচ্ছে। নদী দূষণমুক্ত ও পানিপ্রবাহ বৃদ্ধি করা না হলে এবং বর্তমান অবস্থা চলতে থাকলে পানির অভাবে ঢাকা বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়বে।
বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি, জলবায়ু পরিবর্তন, সমুদ্র স্তরের উচ্চতা বৃদ্ধির বিরূপ প্রভাব বাংলাদেশে ক্রমশ প্রকট হয়ে উঠেছে। সাম্প্রতিক কালে বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাসের বর্ধিত আনাগোনা ও প্রচণ্ডতায় বাংলাদেশের জনজীবন, কৃষি, ভৌত অবকাঠামো অহরহই বিপর্যস্ত হচ্ছে। জলবায়ুর প্রভাবে সবচেয়ে ঝুঁকির মধ্যে থাকা দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম।
জলবায়ুর পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব বাংলাদেশে ক্রমশ প্রকট হয়ে উঠছে বলে সতর্ক করেন পরিবেশবিদরা। তারা বলেন, ২১০০ সাল নাগাদ সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে যাওয়ার কারণে দেশের ১৮ শতাংশের বেশি ভূমি পানির নিচে স্থায়ীভাবে তলিয়ে যাওয়ার আশংকা রয়েছে।
সভায় জানানো হয়, ২০৫০ সাল নাগাদ দেশের খুলনা, বরিশাল, নোয়াখালীর দুই কোটি মানুষ জলবায়ুর প্রভাবে উদ্বাস্তু হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। পানি সংকট থেকে মুক্তি পেতে সভায় কয়েকটি সুপারিশ তুলে ধরা হয়।
১. ভূপৃষ্ঠের পানি ব্যবহারের বিষয়টি নগর ও বসতবাড়ি পরিকল্পনায় বাধ্যতামূলকভাবে যুক্ত করা। ঢাকা ওয়াসাসহ সব নগরীতে ভূগর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে নদী বা জলাশয়ের পানি ব্যবহারের সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া।
২. প্রকৃতি ও পরিবেশবান্ধব পানি ব্যবস্থাপনায় চাষাবাদ পদ্ধতির প্রতি গুরুত্বারোপ করা। ভূগর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভরতা কমিয়ে ভূউপরিস্থ পানি ব্যবহারের জন্য বিভিন্ন মেয়াদি মহাপরিকল্পনা নিয়ে অগ্রসর হওয়া।
৩. সোককূপের মাধ্যমে ভূগর্ভস্থ পানির উন্নয়নের পদক্ষেপ গ্রহণ করা।
৪. পয়ঃনিষ্কাশনের জন্য আবাসিক, অনাবাসিক এলাকায় সেফটিক ট্যাংক ও সোককূপ স্থাপনে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া।
৫. জলাধার রক্ষায় পানি আইনের কঠোর বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা।
৬. দুই বছরের মধ্যে ভূপৃষ্ঠের পানি ৯০ শতাংশ পর্যন্ত ব্যবহারে বাধ্য করা।
৭. নাগরিকদের মাঝে পানির গুরুত্ব অনুধাবনে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেওয়া।
৮. ড্রেজিং করে নদীর নাব্য বাড়ানো এবং অভিন্ন নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা প্রাপ্তির লক্ষ্যে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া।
৯. খরা মৌসুমে সেচ ও রাসায়নিক সারনির্ভর ধান চাষের পরিবর্তে প্রকৃতিনির্ভর ধান চাষের উদ্যোগ নেওয়া।
১০. অপরিশোধিত শিল্পকারখানায় বর্জ্য ও পয়ঃবর্জ্য, নৌযানের বর্জ্য, কঠিন বর্জ্য নদীতে ফেলা বন্ধ করা।
১১. ঢাকার আশপাশের নদীসহ অন্যান্য সব নদী ও জলাশয় দখল, ভরাট এবং দূষণরোধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া।
১২. নদী দূষণমুক্ত করা। একই সঙ্গে নদীর পানি পরিশোধন করে খাবার পানি হিসেবে ব্যবহার করা।
১৩. নদীর প্রবাহ ও নাব্য রক্ষায় নদীতে পিলার ব্রিজের পরিবর্তে ঝুলন্ত ব্রিজ বা টানেল নির্মাণ করা।
আলোচনা সভায় পবা’র চেয়ারম্যান আবু নাসের খান সভাপতিত্ব করেন। সঞ্চালনা করেন বানিপা’র সাধারণ সম্পাদক এম এ ওয়াহেদ। সভায় বক্তব্য দেন পবা’র সাধারণ সম্পাদক মো. আবদুস সোবহান, বানিপা’র সভাপতি মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন, মানবাধিকার উন্নয়ন কেন্দ্রের মহাসচিব মাহবুল হক, পরিবেশ আন্দোলন মঞ্চ’র সভাপতি আমির হাসান মাসুদ, পবা’র সদস্য তোফায়েল আহমদ, দেবীদাস ঘাট সমাজকল্যাণ সংসদের সভাপতি মো. মুসা, মৃত্তিকা’র সমন্বয়ক খাদিজা খানম, ডাব্লিউবিবি ট্রাস্টের প্রজেক্ট অফিসার পদ্মা সাহা, নাসফ’র কেন্দ্রীয় কমিটির আইনবিষয়ক সম্পাদক মো. ওমর ফারুক, কবি ও লেখক কামরুজ্জামান ভূঁইয়া, বাংলাদেশ নদী বাঁচাও আন্দোলনের কেন্দ্রীয় প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক হাসিবুল হক পুনম, জাসদ’র কেন্দ্রীয় কমিটি সহ-দপ্তর সম্পাদক মো. হারুনুর রশিদ সুমন প্রমুখ।