স্টাফ রিপোর্টার ॥ মিয়ানমার থেকে জেলের ছদ্মবেশে নৌকায় মাছের আড়ালে ভয়ঙ্কর মাদক আইস-ইয়াবা চালান আসছে রাজধানীসহ দেশের কয়েকটি জেলায়। গভীর সমুদ্রে দিয়ে এই মাদকের বিশাল চালান আনছে একটি বিশাল সিন্ডিকেট। আর মিয়ানমার মাদক চক্রের সদস্যরা বাকিতে আইস দিচ্ছে দেশীয় মাদক কারবারিদের। আইসের চালান দেশে বিক্রি হওয়ার পর হু-ির মাধ্যমে মিয়ানমারে টাকা যাচ্ছে। আবার অনেক সময় হাতে হাতে টাকা মিয়ানমারে যাচ্ছে। এ রকমই মাদকের বিশাল চালানসহ পাঁচজনকে গ্রেফতার করেছে র্যাব। বুধবার রাতে মুন্সীগঞ্জের গজারিয়া এলাকায় তাদের গ্রেফতারের সময় কয়েকজন পালিয়ে যায়। গ্রেফতারকৃতরা হচ্ছে, চক্রের হোতা জসিম উদ্দিন ওরফে জসিম (৩২) তার অন্যতম সহযোগী মকসুদ মিয়া (২৯), রিয়াজ উদ্দিন (২৩), শাহিন আলম (২৮) ও সামছুল আলম (৩৫)। তাদের সবার বাড়ি কক্সবাজারের সোনাদিয়ায়। এ সময় তাদের কাছ থেকে দেশের সর্ববৃহৎ আইসের চালান ১২ কেজি আইস (যার বাজারমূল্য ৫ কোটি টাকার বেশি), এক লাখ পিস ইয়াবা, ৪ হাজার ৬০০ পিস চেতনানাশক মাদক সিডাকটিভ ইনজেকশন, দুটি বিদেশী পিস্তল, নয় রাউন্ড গুলি, দুটি টর্চলাইট, মিয়ানমারের সিমকার্ড, এক লাখ ৬৪ হাজার বাংলাদেশী টাকা ও এক লাখ মিয়ানমারের মুদ্রা ও পাঁচটি মোবাইল ফোন জব্দ করা হয়। বৃহস্পতিবার দুপুরে রাজধানীর কাওরান বাজার এলাকায় র্যাব মিডিয়া সেন্টারে এক সংবাদ সম্মেলনে র্যাবের লিগ্যাল এ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন এসব তথ্য জানান।
র্যাবের মুখপাত্র খন্দকার মঈন জানান, বৈধ ব্যবসা ও মাছ ধরার আড়ালে সাগরপথে মিয়ানমার থেকে আইস ও ইয়াবা বাংলাদেশে নিয়ে আসছে একটি চক্র। এমন গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে অভিযান চালিয়ে বিপুল পরিমাণ মাদক উদ্ধার করেছে র্যাব-১৫ এর একটি দল। এ সময় এ চক্রের হোতা ও সমন্বয়কারী জসিমসহ পাঁচজনকে গ্রেফতার করা হয়। তিনি জানান, কক্সবাজারের সেন্টমার্টিনের দক্ষিণে গভীর সমুদ্রে ট্রলারের মাধ্যমে মিয়ানমারের মাদক চক্রের সদস্যরা বাংলাদেশের এই চক্রের কাছে ইয়াবা ও আইসের চালান হস্তান্তর করে। সাগরপথে মাদকের চালান গ্রহণ ও নিরাপদে পৌঁছানোর জন্য এ চক্রের সদস্যরা ২০ থেকে ২৫ দিন জেলে ছদ্মবেশে গভীর সমুদ্রে অবস্থান করে। মাদক গ্রহণের পর সুবিধাজনক সময়ে তারা সোনাদিয়া দ্বীপে চলে আসে। পরে সেগুলো সোনাদিয়া ও মহেশখালী দ্বীপের বিভিন্ন স্থানে লুকিয়ে রাখা হয়। এরপর সুবিধাজনক সময়ে চক্রটি সোনাদিয়া থেকে দুটি বোটের মাধ্যমে নোয়াখালীর হাতিয়া নিয়ে আসে। হাতিয়ায় থাকা চক্রের সদস্যদের তত্ত্বাবধানে মাদকের চালান সংরক্ষণ করা হয়। এরপর ইঞ্জিনচালিত নৌকায় করে মেঘনা নদী হয়ে মুন্সীগঞ্জের গজারিয়া ও ঢাকার বিভিন্ন স্থানে পৌঁছে দেয়া হতো। ঢাকা ছাড়াও চক্রটি বরিশাল ও পটুয়াখালী অঞ্চলে মাদক সরবরাহ করত।
মাদকের চালান মুন্সীগঞ্জে পৌঁছানোর পর রাজধানীর একটি চক্র আইস ও ইয়াবার চালান গ্রহণ করে। এরপর সড়কপথে বিভিন্ন কৌশলে ঢাকায় নিয়ে আসে। নৌপথে মাদক পরিবহনে তারা বিভিন্ন নিরাপত্তা ও সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করে থাকে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চোখকে ফাঁকি দেয়ার জন্য চক্রটি দুটি বোট ব্যবহার করে থাকে। সামনের বোটটিকে তারা নজরদারি করতে ব্যবহার করত। আর পরের বোটটিতে মাদক বহন করা হতো। মোবাইল অথবা টর্চ লাইট সিগন্যালের মাধ্যমে উভয় বোটের সদস্যরা নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ করত। পথিমধ্যে নজরদারিতে নিয়োজিত বোট আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সন্দেহজনক কিছু আঁচ করতে পারলে পেছনের মাদকবাহী বোটকে সঙ্কেত দিতো। এভাবে তারা ভয়ঙ্কর মাদকের বিশাল চালান রাজধানীসহ দেশের বিভিন্নস্থানে পৌঁছে দিতো।
র্যাব পরিচালক খন্দকার মঈন জানান, গ্রেফতারকৃতদের জিজ্ঞাসাবাদে জানায়, চক্রের নেতৃত্ব দিতেন জসিম উদ্দিন। তার নেতৃত্বে মাদক চক্রের ১২ থেকে ১৫ জন সদস্য রয়েছে। এই চক্রটি মূলত সোনাদিয়া কেন্দ্রিক একটি মাদক চোরাকারবারি চক্র। তারা নৌপথ ব্যবহার করে বিভিন্ন কৌশলে মিয়ানমার থেকে মাদক নিয়ে আসত। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে সম্প্রতি তারা নৌপথকে প্রাধান্য দিয়ে ঢাকাসহ বিভিন্ন অঞ্চলে মাদক সরবরাহ করত। তিনি জানান, গ্রেফতারকৃত জসিম ৫ থেকে ৭ বছর থেকে মাদক চোরাচালানের সঙ্গে জড়িত। লবণ ব্যবসার আড়ালে আইস কারবারে জড়িত। রাজধানীসহ বিভিন্ন স্থানে ক্রিস্টাল আইসের চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায় গতবছর থেকে তারা মিয়ানমার থেকে ক্রিস্টাল আইস নিয়ে আসা শুরু করে। এছাড়া এই চক্রটির জসিম রাজধানী থেকে কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের চেতনানাশক মাদক সিডাক্সিন ইনজেকশন সংগ্রহ করে নৌপথে দেশের বিভিন্ন স্থানে পৌঁছে দিতো। র্যাবের মুখপাত্র জানান, গ্রেফতারকৃত শাহীন আলম মূলহোতা জসিমের প্রধান সহযোগী। সে সাগর ও নৌপথে মাদক পরিবহনের মূল দায়িত্ব পালন করে। তার বিরুদ্ধে মহেশখালী থানায় মানবপাচার ও মারামারির দুটি মামলা আছে। শামছুল আলম এর বিরুদ্ধে মহেশখালী থানায় অস্ত্র ও মারামারির তিনটি মামলা আছে। মকসুদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ও ডাকাতির ছয়টি মামলা আছে। শাহীন, সামসু ও মকসুদ মাদক বহন ও নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করত। রিয়াজ উদ্দিন মাদক পরিবহনে নজরদারির জন্য বোটে অবস্থান করত।
বিজিবি, কোস্টগার্ডসহ বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কঠোর নিরাপত্তা থাকা সত্ত্বেও কীভাবে ঢাকা পর্যন্ত এমন বড় বড় মাদকের চালন নিয়ে আসে। তারা কোথাও ম্যানেজ কিংবা অপকৌশল করে কি-না এমন প্রশ্নের জবাবে র্যাবের মুখপাত্র জানান, অবশ্যই অপকৌশল। যারা মাদক চোরাকারবারি করছে তারা কিন্তু বিভিন্ন সময়ে মাদকের চাহিদা অনুযায়ী তারাও জীবনের ঝুঁকি নিয়েই এসব মাদক বহন করছে। তারা আড়াই হাজার টাকা দিয়ে যে মাদকটি কিনে সেটি ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা পর্যন্ত বিক্রি করে। এখানে মুনাফার পরিমাণটা অনেক বেশি। আমাদের সমাজে যারা মাদক সেবন করে যতক্ষণ পর্যন্ত তাদের সেবনের চাহিদা আমরা কমিয়ে নিয়ে আসতে না পারি, ততক্ষণ পর্যন্ত মাদক কারবারিরা বিভিন্ন অপকৌশলে তারা মাদক নিয়ে আসবে। তারা রূপ পরিবর্তন করছে, কৌশলও পরিবর্তন করছে। শুঁটকির ভেতরে, ফলের ভেতরে করে মাদক নিয়ে আসছে মাদকের সিন্ডিকেটের সদস্যরা। তবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পাশাপাশি সকলের সহযোগিতায় বিশেষ করে র্যাব সতর্ক ছিল বলেই বড় বড় চালান নিয়ে মাদক কারবারিরা আটক হচ্ছে। আমরা সামনেও যারা এসব কাজে লিপ্ত হবে তাদের আইনের আওতায় নিয়ে আসতে সক্ষম হবো। মাদক ব্যবসায়ীরা কী ঢাকাকে টার্গেট করেই এসব চালান নিয়ে আসছে সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে র্যাবের পরিচালক জানান, পুরোটা যে ঢাকার জন্য আনা হয়েছে তা না। তাদের বক্তব্য অনুযায়ী এখান থেকেই মানিকগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ, ঢাকার বাইরেও যাবে। কীভাবে সেটা যাবে নৌপথে নাকি সড়কে সেটা তাদের আরও জিজ্ঞাসাবাদে জানা যাবে। টাকা হস্তান্তরের বিষয়ে জানতে চাইলে র্যাবের এই কর্মকর্তা জানান, চক্রটি যেভাবে মাদক পাচার করছিল। ঠিক সেভাবেই হাতে হাতে মাদক বিক্রি শেষে টাকা পরিশোধ করত। এছাড়া হু-ির মাধ্যমেও মাদকের টাকা পরিশোধ করা হতো। প্রথমে ২০ থেকে ৩০ ভাগ দাম অগ্রিম দিয়ে মাদক নিয়ে আসে। প্রতি ১০ গ্রাম কিনে ১৫০০ থেকে ২ হাজার টাকায় কেনে। যা দেশে এনে ২৫ হাজার থেকে ৩৫ হাজার টাকায় বিক্রি করত। তিনি জানান, বৈধ ব্যবসার আড়ালে মাদক সংগ্রহ করত জসিমের নেতৃত্বে থাকা চক্রটি। তারা প্রতিটি চালান সংগ্রহের ২০ থেকে ২৫ দিন সময় নিতো। সাগরে মাছ ধরতে যাওয়া সাধারণ জেলেদের বেশে তারাও মাছ ধরতে যেত। তারা এমনভাবে কাজ করত যেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চোখে না পড়ে।