দক্ষিণ আফ্রিকার মাটিতে বাংলাদেশের প্রথম সিরিজ জয়। গতকাল সেঞ্চুরিয়নে প্রোটিয়াদের উড়িয়ে দিয়ে ৯ উইকেটের ক্যারিশম্যাটিক জয়ে নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করল টাইগাররা। বাঘের গর্জনে ঘরের মাঠেই বিধ্বস্ত দক্ষিণ আফ্রিকা। পেসার তাসকিন আহমেদের বিধ্বংসী বোলিং ও তামিম ইকবালের ক্যাপ্টেন্স নকে ১৪১ বল আগেই জয় তুলে নেন তামিমরা।
সিরিজের প্রথম ম্যাচে দাপট দেখিয়ে ২০ বছর পর দক্ষিণ আফ্রিকার মাটিতে প্রথম জয়ের স্বাদ পেয়েছিল বাংলাদেশ। গতকাল অঘোষিত ফাইনালে স্বাগতিক প্রোটিয়ারা প্রতিদ্বন্দ্বিতাই গড়ে তুলতে পারেনি। এই জয়ে আইসিসি বিশ্বকাপ সুপার লিগে নিজেদের অবস্থান আরও দৃঢ় করল বাংলাদেশ। ১৮ ম্যাচে ১২ জয় টাইগারদের।
এমন জয় বাংলাদেশের ক্রিকেটের ইতিহাসে আর কয়টি আছে! ১৪১ বল হাতে রেখেই ম্যাচ শেষ। তা কিনা দক্ষিণ আফ্রিকার মতো ভয়ংকর প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে তাদের মাটিতে। এটি নিছক একটি জয় নয়, টাইগাররা যেন রীতিমতো ছিন্ন-ভিন্ন করে দিয়েছে স্বাগতিকদের। সেঞ্চুরিয়নে স্বাগতিকদের যেন বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দিয়েছেন তাসকিনরা। খানিকটা ফ্ল্যাশ ব্যাকে যাওয়া যাক! সব শেষ সিরিজে দক্ষিণ আফ্রিকার মাটিতে হোয়াইটওয়াশ ভারত। তার আগে আইসিসি ওয়ানডে র্যাঙ্কিংয়ের এক নম্বর দল অস্ট্রেলিয়া সিরিজ হারে ৩-০ ব্যবধানে। পরাক্রমশালী সেই দক্ষিণ আফ্রিকা কিনা পাত্তাই পেল না। ক্যাপ্টেন তামিম বললেন, ‘এটা আমাদের পরিশ্রমের ফল। আমরা অনেক কষ্ট করেছি। তার পুরস্কার পেয়েছি।’
ব্যাটিং, বোলিং কিংবা ফিল্ডিং -তিন বিভাগেই অনন্য এই বাংলাদেশ। গতকাল তাসকিন আহমেদ ও সাকিব আল হাসানের বোলিং ক্যারিশমায় দক্ষিণ আফ্রিকাকে মাত্র ১৫৪ রানে আটকে দেয় বাংলাদেশ। টাইগারদের বিরুদ্ধে এটিই প্রোটিয়াদের দলীয় সর্বনিম্ন স্কোর। এরপর দুই টাইগার ওপেনার তামিম ইকবাল ও লিটন দাসের ১২৭ রানের জুটি এনে দেয় সহজ জয়। মাত্র ৩৫ রানে ৫ উইকেট নিয়েছেন তাসকিন আহমেদ। টাইগার পেসার গতকাল সেঞ্চুরিয়নে যে ক্যারিশমা দেখিয়েছেন শেষ ১০ বছরে দক্ষিণ আফ্রিকার মাটিতে এমন দাপট দেখাতে পারেনি সফরকারী দলের কোনো বোলার! সব শেষ ২০১২ সালে শ্রীলঙ্কার কিংবদন্তি পেসার লাসিথ মালিঙ্গা এই কীর্তি দেখিয়েছিলেন। দাপুটে বোলিংয়ের পুরস্কার হিসেবে ম্যাচসেরার পুরস্কার তো পেয়েছেনই, সিরিজের সেরাও হয়ে গেলেন তাসকিন। ম্যাচ শেষ বলেন, ‘প্রথমবারের মতো সিরিজ সেরা হয়েছি। কতটা ভালো লাগছে তা ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না! এই সাফল্যের ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে চাই।’ কালকের ম্যাচটা শেষ করে দিয়েছেন মূলত বোলাররাই। তবে ব্যাটিংয়ে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন ক্যাপ্টেন তামিম। বিশেষ করে ম্যাচের দশম ওভারে ক্রিকেটের এ প্রজন্মের অন্যতম সেরা পেসার কাগিসো রাবাদার ওভারে যেভাবে চার চারটি বাউন্ডারি হাঁকিয়েছেন তা ছিল দেখার মতো। ৫২ বলে হাফ সেঞ্চুরি পূরণ করেন টাইগার ক্যাপ্টেন। শেষ পর্যন্ত অপরাজিত থেকে ৮২ বলে ৮৭ রান করে দলের জয় নিশ্চিত করেই মাঠ ছাড়েন। তাসকিনের দিনে বোলিংয়ে সাকিবও দুর্দান্ত দাপট দেখিয়েছেন। ৯ ওভারে মাত্র ২৩ রান দিয়ে নিয়েছেন ২ উইকেট। অন্য বোলাররাও রান দেওয়ায় ছিলেন ভীষণ কিপটে। তাই তো প্রোটিয়া কোনো ব্যাটসম্যান কাল সুবিধা করতে পারেননি। সর্বোচ্চ রান ওপেনার মালানের ৩৯। টাইগার বোলারদের সামনে কাল প্রোটিয়া ব্যাটসম্যানরা যে কতটা অসহায় ছিলেন তা বুঝতে পুরো স্কোর কার্ডও দেখার প্রয়োজন নেই! সুপার স্পোর্ট পার্কে সিরিজের প্রথম ম্যাচেও দুর্দান্ত বোলিং করেছিলেন তাসকিন। ৩৬ রানে নিয়েছিলেন ৩ উইকেট। সাকিব আল হাসানের ক্যারিশম্যাটিক ব্যাটিংয়ের কারণে সে ম্যাচে সেরা হতে পারেননি। কিন্তু এ ম্যাচে তাসকিন আর কাউকে সুযোগই দিলেন না। দক্ষিণ আফ্রিকার মাটিতে গত দুই যুগে বাংলাদেশের প্রতিটি মিশনই ছিল ব্যর্থ। তিন ফরম্যাট মিলে কোনো জয়ই ছিল না। তবে এবারের পরিস্থিতি ছিল অন্যরকম। কারণ, টাইগারদের কোচিংয়ে আফ্রিকান আবহ। প্রধান কোচ রাসেল ডমিঙ্গো আফ্রিকান। বোলিং কোচের দায়িত্বেও আছেন কিংবদন্তি প্রোটিয়া পেসার অ্যালান ডোনাল্ড। এমন কি কিছুদিন আগে ব্যাটিং কোচের দায়িত্বেও ছিলেন আরেক আফ্রিকান (অ্যাশওয়েল প্রিন্স)। আফ্রিকার মাটিতে ব্যাটারদের ভয় কমাতে সাময়িক কয়েক দিনের জন্য হার্ডহিটার প্রোটিয়া ব্যাটসম্যান অ্যালবি মরকেলকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। শুধু তাই নয়, আফ্রিকার মাটিতে টাইগার ব্যাটসম্যানদের মনোবল চাঙ্গা রাখতে টিম হোটেলে সাকিব-তামিমদের সঙ্গে কোচ রাসেল ডমিঙ্গো আলাপ করিয়ে দিয়েছেন ৩৬০ ডিগ্রিখ্যাত এবি ডি ভিলিয়ার্সকে। টিম ম্যানেজমেন্টের এই ‘টোটকা’ যে দারুণ কাজ দিয়েছে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। টিম বাংলাদেশের একাগ্র প্রচেষ্টাতেই এলো সাফল্য। টাইগাররা বিদেশের মাটিতে দাপট দেখানোর আত্মবিশ্বাসটা পেয়েছিল বছরের শুরুতে নিউজিল্যান্ডে গিয়ে। তাসমান পাড়ে গিয়ে প্রথমবারের মতো টেস্ট জিতে ছিল বাংলাদেশ। সেটি ছিল নিউজিল্যান্ডের মাটিতে তাদের বিরুদ্ধে প্রথম জয়। এবার টাইগাররা সেই আত্মবিশ্বাস টেনে দক্ষিণ আফ্রিকায় নিয়ে গিয়ে বাজিমাত করে দিলেন। দুই বছর আগে এই দক্ষিণ আফ্রিকার মাটিতেই অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে বাংলাদেশকে চ্যাম্পিয়ন করেছিলেন যুবারা। এবার সেই আফ্রিকার মাটিতেই স্বাগতিকের বিরুদ্ধে প্রথম সিরিজ জিতে নিজেদের ক্রিকেট ইতিহাসে নতুন অধ্যায় সংযোজন করলেন তামিম, সাকিব, তাসকিনরা।
প্রধানমন্ত্রীর অভিনন্দন : দক্ষিণ আফ্রিকার মাটিতে প্রথম সিরিজ জয়ের পর বাংলাদেশ দলকে অভিনন্দন জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এক বার্তায় ক্রিকেটপ্রেমী প্রধানমন্ত্রী দক্ষিণ আফ্রিকাকে হারানোর জন্য সংশ্লিষ্ট সব খেলোয়াড়, জাতীয় ক্রিকেট দলের কোচ ও কর্মকর্তা এবং বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) কর্মকর্তাদের অভিনন্দন জানিয়েছেন।