আবাসিক এলাকা হিসেবে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) নির্মাণ করেছিল রাজধানীর উত্তরা মডেল টাউন, বনানী ও গুলশান। কিন্তু সময়ের ব্যবধানে এ আবাসিক এলাকাগুলোর অধিকাংশ এখন বাণিজ্যিকে রূপ নিয়েছে। অভিজাত ছায়াসুনিবিড় আবাসিক এলাকাগুলো বাণিজ্যিক স্থাপনার আড়ালে হারিয়েছে উপশহরের মর্যাদা। কাঠাপ্রতি ২৫-৫০ লাখ টাকার বিনিময়ে এ এলাকার আবাসিক প্লট বাণিজ্যিক প্লটে রূপান্তর হচ্ছে। ইতোমধ্যে এসব এলাকার কয়েকটি সড়কের দুই পাশ বাণিজ্যিক হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে। বাণিজ্যিক ব্যবহারের ফলে আবাসিক এলাকাগুলো হারিয়েছে স্বকীয় রূপ। রাজউক-সূত্রে জানা যায়, ২০০৪ সালের ২০ সেপ্টেম্বর গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় একটি
প্রজ্ঞাপন জারি করে। সেখানে রাজউকের গুলশান ও বনানী আবাসিক এলাকার গুলশান শুটিং ক্লাব থেকে গুলশান ২ নম্বর চত্বর পর্যন্ত; বনানীর কামাল আতাতুর্ক এভিনিউ, গুলশান-বনানী সংযোগ ব্রিজ থেকে গুলশান-বারিধারা ব্রিজ পর্যন্ত; গুলশান-মহাখালী ব্রিজ থেকে বাড্ডা লিঙ্ক রোড (গুলশান দক্ষিণ এভিনিউ) পর্যন্ত উভয় পাশের প্লটগুলো বাণিজ্যিক হিসেবে ব্যবহারের এবং বনানী ১১ নম্বর রোডের উভয় পাশের প্লটগুলো বাণিজ্যিক ব্যবহারের অনুমোদন দেওয়া হয়। তবে এসব রোডের বাইরেও গুলশান, বনানী, বারিধারায় বিভিন্ন আবাসিক প্লটে নির্ধারিত ফি দিয়ে রাজউকের অনুমোদন নিয়ে বাণিজ্যিক হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। এ বিষয়ে রাজউক চেয়ারম্যান এ বি এম আমিনুল্লাহ নুরী বলেন, ‘রাজউক এলাকায় আবাসিক প্লটকে বাণিজ্যিক প্লটে রূপান্তরের সুযোগ রয়েছে। তবে চাইলেই বাণিজ্যিক প্লটে রূপান্তরের সুযোগ নেই। আমরা গণহারে প্লট বাণিজ্যিকীকরণ করার সুযোগ দিই না। এজন্য মন্ত্রণালয়ের একটি কমিটি রয়েছে। সে কমিটি যথেষ্ট যাচাই-বাছাই করে তবেই বাণিজ্যিক প্লটের বৈধতা দেয়।’
তিনি বলেন, উত্তরা, বনানী ও গুলশানের কয়েকটি সড়কের দুই পাশ বাণিজ্যিক এলাকা হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। তবে এসব সড়কের প্রস্থ কমপক্ষে ৫০ ফুট ও ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার ওপর বিবেচনা করে বাণিজ্যিক ভবনের অনুমোদন দেওয়া হয়। বাণিজ্যিক হিসেবে অনুমোদন নিতে এলাকাভেদে ২৫ থেকে ৫০ লাখ টাকা পর্যন্ত নেওয়া হয়। তবে বিষয়টি মানতে নারাজ নগর পরিকল্পনাবিদরা। তাঁরা বলছেন, যথেষ্ট যাচাই-বাছাই ছাড়াই অনেক সময় বিভিন্ন চাপে নত হয়ে বা অনৈতিকভাবে অর্থের বিনিময়ে এ ধরনের রূপান্তর ঘটে। যথেচ্ছভাবে বাণিজ্যিক ভবন নির্মাণের সুযোগ দেওয়ার ফলে একটি এলাকার অধিবাসীদের বসবাসের জন্য যে ভারসাম্য থাকা প্রয়োজন, তা নষ্ট হয় বলেও মন্তব্য করেন তাঁরা।
ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইপিডি) নির্বাহী পরিচালক ও পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, একটি আবাসিক এলাকার জন্য যখন পরিকল্পনা করা হয় তখন আবাসিক এলাকা ও ট্রাফিকের চিন্তা করা হয়। পরে ওই চিন্তা থেকে এলাকা তৈরি করা হয়। কিন্তু আবাসিক এলাকা হওয়ার পর যখন বাণিজ্যিকে রূপান্তর হয়, তখন ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায় বড় পরিবর্তন আসে। বাণিজ্যিক স্থাপনায় মানুষের চলাচল বেড়ে যায়, অন্যান্য সুযোগ-সুবিধাও সীমিত হয়ে পড়ে। ফলে একটি অঞ্চল তার বাসযোগ্যতা হারায়। নীতিনির্ধারক কর্তৃপক্ষের অদক্ষতা-দুর্বলতায় বছরের পর বছর ধরে এসব অনিয়ম হয়ে আসছে।
সরেজমিন এসব এলাকা ঘুরে দেখা যায়, ধানমন্ডিতে আবাসিক বাড়িঘরের সঙ্গে শুধু বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানই গড়ে ওঠেনি, সেখানে পাশাপাশি গড়ে তোলা হয়েছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও হাসপাতাল। এ আবাসিক এলাকায় একের পর এক তরতর করে উঠছে শপিং মল। এখন অভিজাত এলাকাসমূহে কোনটা আবাসিক আর কোনটা বাণিজ্যিক বুঝে ওঠা কঠিন। ধানমন্ডির গ্রিন রোডসহ আশপাশ এলাকা এমনই ঘনঘিঞ্জি বাণিজ্যিক স্থাপনার হাটবাজারে পরিণত হয়েছে। আবাসিক ভবনের নিচতলা ব্যবহৃত হচ্ছে কারখানা কিংবা ওয়ার্কশপ হিসেবে। দোতলা, তিন তলা ও চার তলাকে বানানো হয়েছে মার্কেট। এরও ওপরের তলাসমূহ ব্যবহৃত হচ্ছে আবাসিক ফ্ল্যাট হিসেবে। সৃষ্টি হয়েছে অস্বস্তিকর পরিবেশ।
এদিকে গতকাল ধানমন্ডি আবাসিক এলাকায় বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান নির্মাণ বন্ধের দাবিতে ধানমন্ডি থানা কমিউনিটি পুলিশ ও এলাকাবাসী মানববন্ধন করেন। মানববন্ধনে ধানমন্ডি থানা কমিউনিটি পুলিশের সভাপতি এম এ কামাল ও সাধারণ সম্পাদক মাহফুজুর রহমান বক্তব্য দেন। তাঁরা বলেন, আবাসিক এলাকায় বাণিজ্যিক স্থাপনার ফলে আবাসিকের পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে। দিনরাত সব সময় গাড়ি ও মানুষের হইহল্লায় মেতে থাকে এলাকাটি। এতে শিক্ষার্থী ও বয়স্করা ভোগান্তিতে পড়ছেন। অভিজাত এলাকা খ্যাত গুলশান-বনানীর অবস্থা আরও নাজুক। অর্ধশতাধিক স্কুল ও কলেজ, অন্তত দেড় ডজন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, প্রায় ২০টি ব্যাংক, শপিং মল, কমিউনিটি সেন্টার, শতাধিক ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও ক্লিনিক রয়েছে গুলশানে। এ ছাড়া চায়নিজ ও ফাস্টফুডের দোকান, ডিপার্টমেন্টাল স্টোরসহ বিভিন্ন ধরনের দোকানপাটও রয়েছে। সেখানে যাবতীয় বাণিজ্যের ধকল সহ্য করেই বসবাস করতে হচ্ছে বাসিন্দাদের। অবিরাম হইচই, রাস্তাজুড়ে পার্কিং, গভীর রাত পর্যন্ত বিপুলসংখ্যক মানুষের আনাগোনা মিলিয়ে বিশ্রী বেহাল অবস্থা চলছে গুলশান-বনানী জুড়ে। একই অবস্থা উত্তরা মডেল টাউন আবাসিক এলাকার। এ এলাকার রবীন্দ্র সরণি, গাউসুল আজম এভিনিউ, সোনারগাঁও জনপথ রোড, গরিব-এ নেওয়াজ রোডসহ বিভিন্ন সড়কের পাশে গড়ে উঠেছে বড় বড় বাণিজ্যিক স্থাপনা। উত্তরার অলিগলিতে গড়ে উঠেছে অবৈধ দোকানপাট। কোথাও বসেছে ভাসমান কাঁচাবাজার। গলির মুখে পসরা সাজিয়ে বসছেন ভাসমান দোকানিরা। ফুটপাথ দখল করে দোকান বসানো হয়েছে। প্রতিটি সড়কের মোড়ে মোড়ে ভ্যানগাড়িতে রয়েছে ভ্রাম্যমাণ সবজির দোকান।