ডায়রিয়ার মূল কারণ লাইনের দূষিত পানি

ডায়রিয়ার মূল কারণ লাইনের দূষিত পানি

ঢাকার নির্দিষ্ট কিছু এলাকায় ডায়রিয়ার প্রকোপ সবচেয়ে বেশি দেখা দিয়েছে। এসব এলাকার বয়স্ক মানুষই বেশি ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হচ্ছে। মোট রোগীর ৪০ শতাংশের মতো তীব্র পানিশূন্যতা নিয়ে হাসপাতালে আসছে। তাদের সুস্থ হতে যেমন সময় লাগছে, তেমনি মৃত্যুঝুঁকিও বেশি।

হাসপাতালে আসা এসব রোগীর বেশিরভাগই অভিযোগ, ওয়াসার পানি পান করেই তাদের সমস্যা হয়েছে। আক্রান্তরা পানি ফুটিয়ে পান করেনি। অনেকে এমনও বলেছে, পানি ফুটালেও দুর্গন্ধ যাচ্ছে না।

রাজধানীর মহাখালীর আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশের (আইসিডিডিআর.বি) কলেরা হাসপাতালে আসা রোগী ও চিকিৎসকরা এমনটাই জানিয়েছেন।

এসব চিকিৎসক দেশ রূপান্তরকে বলেন, মূলত কয়েকটা এলাকা থেকেই রোগী বেশি আসছে। সব জায়গায় দেখা যাচ্ছে পানির সমস্যা। পানিতে গন্ধ। অনেক কারণে পানি দূষিত হয়। রোগীদের বেশিরভাগই বলেছে, তাদের পানি খেয়েই সমস্যা হয়েছে। অনেকে বলেছে, তারা ওয়াসার পানি ফুটিয়ে খায়নি।

এ ব্যাপারে কলেরা হাসপাতালের প্রধান ডা. বাহারুল আলম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ডায়রিয়া একটি পানিবাহিত রোগ। ইনজেকশন বা রক্তের মাধ্যমে রোগটির জীবাণু শরীরে যাবে না। এটা পানির মাধ্যমে মুখ দিয়েই শরীরে যাবে। যেকোনো উপায়ে তারা দূষিত পানি খেয়েছে। সেটা ওয়াসারও হতে পারে বা অন্য কোনো কারণেও দূষিত হতে পারে।

অবশ্য এর আগেও ওয়াসার সরবরাহ করা দূষিত পানির কারণে ডায়রিয়ার আউটব্রেক বা প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে বলে জানিয়েছেন সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. এ এস এম আলমগীর। তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, সারা দেশে যারা পানি ম্যানেজমেন্ট করে, তাদের পানি সরবরাহের দিকে মনোযোগ দিতে হবে। অনেক সময় খাওয়ার পানির ও স্যুয়ারেজ লাইন এক হয়ে যায়। মিউনিসিপ্যাল করপোরেশন বা পৌরসভা ও সিটি করপোরেশন এলাকায় পানির সাপ্লাইলাইন চেক করা উচিত। কোনো রকম ত্রুটি পেলে সেটা মেরামত করতে হবে। আমাদের আগের অভিজ্ঞতাও আছে, আমরা আগেও ডায়রিয়ার অনেক আউটব্রেক পেয়েছি, স্যুয়ারেজ ও পানির লাইন এক হয়ে গেছে। ওই পানি পান করে মানুষ ডায়রিয়া আক্রান্ত হয়েছে। সবাই সতর্ক থাকলে এটা চিহ্নিত ও সমাধান করা সহজ।

ডায়রিয়া পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সচেতন বলে জানিয়েছেন অধিদপ্তরের পরিচালক ও মুখপাত্র অধ্যাপক ডা. নাজমুল ইসলাম। তিনি গতকাল এক ভার্চুয়াল স্বাস্থ্য বুলেটিনে বলেন, গ্রীষ্ম আসার আগে আগেই দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ডায়রিয়া রোগের প্রকোপ বাড়ার তথ্য পাওয়া যাচ্ছে; বিশেষ করে রাজধানী ঢাকায় ডায়রিয়া আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বেড়েছে। তবে ডায়রিয়া পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে স্বাস্থ্য বিভাগ সচেতন আছে। সরকারি হাসপাতালগুলোতে খাবার স্যালাইন, আইভিফ্লুইড স্যালাইন, পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় উপকরণের সরবরাহ রয়েছে। অল্প ডায়রিয়া থাকতেই যেকোনো অবস্থাতেই কিন্তু চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ করতে হবে। একবিংশ শতাব্দীতে ডায়রিয়া একেবারে চলে যায়নি। সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে এ রোগ নিয়ন্ত্রণ সম্ভব।

দুই সপ্তাহ ধরে রোগী বাড়ছে : কলেরা হাসপাতালের ডায়রিয়া রোগীর তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, মার্চের প্রথম ও দ্বিতীয় সপ্তাহেও হাসপাতালে রোগীর সংখ্যা দৈনিক ৫০০-৬০০-এর ঘরে ছিল। তৃতীয় সপ্তাহ থেকে রোগী বাড়তে থাকে। ১৬ মার্চ রোগী ভর্তি হয়েছে ১ হাজার ৫৭ জন, যা ঘণ্টার হিসাবে ৪৭ জনের বেশি। সেখানে গত শনিবার রোগী ভর্তি হয়েছে ১ হাজার ২৪৫ জন, যা ঘণ্টা হিসাবে ৫২ জনে দাঁড়িয়েছে। গতকাল বেলা ২টা পর্যন্ত রোগী ভর্তি হয়েছে ৬৯৪ জন, অর্থাৎ ঘণ্টায় রোগীর সংখ্যা ৪৯ জন। গত ১২ দিনের মধ্যে সবচেয়ে বেশি রোগী ভর্তি হয়েছে ২২ মার্চ ১ হাজার ২৭২ জন, যা ঘণ্টায় ছিল ৫৩ জন। এ সময় সবচেয়ে কম রোগী ছিল ১৯ মার্চ ১ হাজার ১৩৫ জন, যা ঘণ্টা হিসাবে ৪৭ জন। কলেরা হাসপাতালের বাইরে খোলা প্রাঙ্গণে আরও দুটি তাঁবু খাটিয়ে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।

তীব্র পানিশূন্যতা ও বয়স্ক রোগী বেশি: ডা. বাহারুল আলম বলেন, তীব্র পানিশূন্যতা নিয়ে রোগী বেশি আসছে। তাৎক্ষণিকভাবে তার পানিশূন্যতা দূর না করি, সে মারা যাবে। মোট রোগীর ৩০-৪০ শতাংশ তীব্র পানিশূন্যতা নিয়ে আসছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ডায়রিয়া রোগীদের তিন ভাগে ভাগ করেÑ তীব্র, আংশিক ও কোনো ধরনের পানিশূন্যতা নেই। তাদের মধ্যে তীব্র পানিশূন্যতার রোগীরাই বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। তাদের সেরে উঠতে সময় লাগে। তাদের মৃত্যুঝুঁকিও বেশি।

এই চিকিৎসক আরও বলেন, বয়স্ক রোগী বেশি। এই গরমে শিশুরা বেশি আক্রান্ত হয় না। তারা আক্রান্ত হয় শীতে।

শিশু রোগী কম : ঢাকা শিশু হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, আমাদের এখনো খুব একটা রোগী বাড়েনি। সামান্য বেড়েছে। গত সপ্তাহে ৮, ১০, ১১, ১২, ৭ জন এ রকম রোগী এসেছে। আজ (গতকাল) ২২ জন রোগী ভর্তি আছে। ৬৭৩ বিছানার মধ্যে এই সংখ্যক রোগী স্বাভাবিকই বলা চলে। বাচ্চারা এখন রাস্তাঘাটে সে রকম খাবার খায় না। স্কুল খুলে গেছে। সেখানে বাচ্চার মা-বাবারা বাসা থেকে বিশুদ্ধ পানি বোতলে ভরে নিয়ে যান। ডায়রিয়া খাবার ও পানিবাহিত রোগ। গরমে খাবার অল্প সময়েই নষ্ট হয়ে যায়। তা ছাড়া ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণও গরমের সময় বাড়ে। সে জন্য ডায়রিয়া বাড়ছে।

এই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক বলেন, আমার পরামর্শ হলো, খোলা খাবার না খাওয়া, হাত ভালোভাবে সাবান দিয়ে ধোয়া, বাচ্চার মা-বাবা যেন বাচ্চাকে পরিষ্কার করার সময় সাবান দিয়ে হাত ধুয়ে নেন, ওদের জন্য খাবার তৈরির সময় সাবান দিয়ে হাত পরিষ্কার করে নেন। বিশুদ্ধ পানি পান করতে হবে। পানি ফুটিয়ে খেতে হবে। রাস্তার ফুচকা, চটপটি, ভেলপুরি বা ডালপুরি এগুলো পরিহার করতে হবে।

চার এলাকার রোগী বেশি : কলেরা হাসপাতালের চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, যাত্রাবাড়ী, কদমতলী, শনির আখড়া ও দক্ষিণখান এলাকা থেকে রোগী বেশি আসছে। প্রায় সবারই অভিযোগ, তারা বাসায় যে পানি পান করছে, সেখান থেকেই সমস্যা হয়েছে। এ ছাড়া মোহাম্মদপুর ও মিরপুর থেকেও রোগী বেশি আসছে।

এ ব্যাপারে ডা. বাহারুল আলম বলেন, যাত্রাবাড়ী ও শনির আখড়ায় ডায়রিয়ার প্রকোপ প্রথম থেকেই বেশি। দক্ষিণখানেও বেশি রোগী পাচ্ছি। তবে ঢাকার সবখান থেকেই কম-বেশি রোগী আসছে।

বৃষ্টি হলেই রোগী কমবে : ডা. বাহারুল আলম বলেন, এখন যে গরম তাতে ব্যাকটেরিয়া প্রজনন বা বংশবৃদ্ধিতে খুব উৎসাহিত হয়। রোগ ছড়ানোর অনুকূল পরিবেশ পায়। একটা বৃষ্টি হলেই ডায়রিয়া অনেক কমে যাবে। এখন ৩২-৩৬ ডিগ্রি তাপমাত্রা। এই পরিবেশ ব্যাকটিয়ার জন্য খুবই সহায়ক। বৃষ্টি হলে তাপমাত্রা ২৪-২৭ তাপমাত্রায় নেমে আসবে। তখন রোগীর সংখ্যাও অর্ধেকে নেমে আসবে।

তিন কারণে বাড়ছে ডায়রিয়া : ডা. এ এস এম আলমগীর বলেন, প্রতি বছরই গরমের সময় ডায়রিয়া বাড়ে। গত দুই বছর করোনার কারণে সবকিছু বন্ধ ছিল। রাস্তার পাশে দোকানপাট ও খাবার কম ছিল। এ বছর গরম শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সবকিছুই খোলা। গরমও বেশি পড়েছে। মানুষ রাস্তার আশপাশে পানি খাচ্ছে। এখন রাতের খাবার রেখে দিলে পরদিন সকালে খাওয়া যায় না। এখন ডায়রিয়ার দুটি মূল কারণÑ একটি হলো দূষিত পানি, আরেকটি বাসি খাবার বা রাস্তার আশপাশের খাবার। আমরা বাইরে শরবত খাচ্ছি। কিন্তু কী শরবত খাচ্ছি ও কী পানি দিয়ে তৈরি হচ্ছে, সেগুলো জানছি না।

এই বিশেষজ্ঞ কর্মকর্তা আরও বলেন, প্রতি বছরই ডায়রিয়া বাড়ে। কিন্তু এ বছর তুলনামূলক বেশি। আমাদের দেশে সাধারণত এপ্রিলের দিকে যখন গরম শুরু হয়, তখনই ডায়রিয়ার প্রকোপ দেখা দেয়। এ বছর যেহেতু আগেই গরম পড়তে শুরু করেছে, ডায়রিয়াও একটু আগেই শুরু হয়ে গেছে। এবার ডায়রিয়া ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলায় বাড়ছে।

এ ব্যাপারে ডা. বাহারুল আলম বলেন, সবচেয়ে বেশি বিপজ্জনক রাস্তার পাশে বিক্রি হওয়া খোলা খাবার, শরবত। মাছ সংরক্ষণের জন্য যে বরফ, সেই বরফ দিয়ে ওরা শরবত বানায়। এই বরফ সাধারণ পানি দিয়ে হয়, ফুটানো পানির দরকার নেই। সেই বরফ জুস শরবতে ব্যবহার করছে। এটা খুবই বিপজ্জনক।

উপসর্গ কী : ডা. এ এস এম আলমগীর বলেন, ডায়রিয়ার উপসর্গ হলো পাতলা পায়খানা হবে, বমি হতে পারে। পেটে একধরনের ব্যথা হয়। সাধারণ সময়ের চেয়ে যদি বেশিবার পায়খানা হয়, তাহলে বুঝতে হবে ডায়রিয়ার উপসর্গ। এমন হলে সে সঙ্গে সঙ্গে বাজারে যে ওরস্যালাইন পাওয়া যায়, সেটা খাবে। স্যালাইনও বেশি খাওয়া যাবে না। প্যাকেটের গায়ে যেভাবে প্রস্তুত করতে বলা হয়েছে, সেভাবেই প্রস্তুত করবে ও খাবে। সেটাও বিশুদ্ধ পানি দিয়ে তৈরি করতে হবে।

তিনটি বিষয় মানার পরামর্শ : ডায়রিয়া থেকে বাঁচতে বেশ কিছু পরামর্শ দিয়েছেন চিকিৎসকরা। ডা. বাহারুল আলম বলেন, পানি ফুটিয়ে খেতে হবে। পানি বলগ ওঠার পর ৪-৫ মিনিট ফুটাতে হবে, এরপর ঠা-া করে খেতে হবে, রাস্তার খাবার বর্জন করতে হবে, আর হাত ধুতে হবে। অবশ্যই খাওয়ার আগে ও টয়লেট থেকে আসার পরে সাবান দিয়ে ভালো করে হাত ধুতে হবে। এই তিনটি মানতেই হবে।

স্বাস্থ্য