বাংলাদেশে ২০২০ সালের মার্চ থেকে ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এবং পুনরায় ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে স্কুল বন্ধ থাকায় প্রায় ৩ কোটি ৭০ লাখ শিশুর শুধু শিক্ষাই ব্যাহত হয়নি, এ কারণে তাদের পড়তে ও গুনতে পারার প্রাথমিক দক্ষতার ঘাটতি উদ্বেগজনক মাত্রায় বেড়েছে বলে জানিয়েছে ইউনিসেফ। যদিও এই ঘাটতি মহামারির আগেও ছিল।
বুধবার (৩০ মার্চ) ‘শিশুরা কি সত্যিই শিখছে?’ শীর্ষক ইউনিসেফের এই প্রতিবেদনে শিশুদের ওপর কোভিড-১৯ মহামারি এবং এ কারণে স্কুল বন্ধ থাকার প্রভাব সম্পর্কে বিভিন্ন দেশের জাতীয় পর্যায়ের উপাত্ত এবং একইসঙ্গে মহামারির আগের সময়ে শিশুদের শিক্ষার অবস্থা কেমন ছিল, তা নিয়ে হালনাগাদ বিশ্লেষণ তুলে ধরা হয়েছে। এতে উল্লেখ করা হয় যে, গত ২ বছরে প্রায় ১৪ কোটি ৭০ লাখ শিশু সশরীরে স্কুলে শিক্ষা কার্যক্রমের অর্ধেকের বেশি হারিয়েছে। এতে বৈশ্বিকভাবে সশরীরে স্কুলে শিক্ষা কার্যক্রমের ২ ট্রিলিয়ন ঘণ্টা নষ্ট হয়েছে।
ইউনিসেফের প্রতিবেদন অনুযায়ী, কোভিড-১৯ মহামারি যখন তৃতীয় বছরে পদার্পণ করছে, তখনও ২৩টি দেশে স্কুলগুলো পুরোপুরি খোলেনি। ওইসব দেশে প্রায় ৪০ কোটি ৫০ লাখ স্কুলগামী শিশুর বসবাস এবং এই শিশুদের অনেকে স্কুল থেকে ঝরে পড়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। প্রতিবেদনে যেসব দেশের পরিস্থিতি পর্যালোচনা করা হয়েছে, সেই দেশগুলোর একটি বাংলাদেশ। দেশটি বিশ্বে সবচেয়ে বেশি সময় ধরে স্কুল বন্ধ থাকা দেশগুলোর অন্যতম এবং এখানে শিশুরা প্রায় ১৮ মাস সশরীরে স্কুলের পড়াশোনা কার্যক্রম থেকে বঞ্চিত হয়েছে।
প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, বাংলাদেশে তৃতীয় শ্রেণিতে অধ্যয়নরত শিশুদের মাত্র ৩৪ শতাংশের পড়তে পারার এবং মাত্র ১৮ শতাংশের গুনতে পারার প্রাথমিক দক্ষতা রয়েছে। এক্ষেত্রে সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের অবস্থা আরও খারাপ।
প্রতিবেদনে পড়তে পারার দক্ষতা বিচারে গত একবছরে স্কুল থেকে ঝরে পড়া এবং পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়া শিশুদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য মাত্রায় পার্থক্যের বিষয়টিও তুলে ধরা হয়েছে। গত একবছরের মধ্যে স্কুল থেকে ঝরে পড়া শিশুদের মাত্র ২৯ শতাংশের পড়তে পারার প্রাথমিক দক্ষতা রয়েছে, যেখানে স্কুলে পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়া শিশুদের মধ্যে এই হার ৩৯ শতাংশ।
বাংলাদেশে ইউনিসেফের প্রতিনিধি শেলডন ইয়েট বলেন, ‘মহামারির আগেও বাংলাদেশের শিশুরা পড়াশোনার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হয়েছিল। কোভিডে বাংলাদেশের শিশুদের পড়াশোনায় যে ক্ষতি হয়েছে, তা কাটিয়ে উঠতে তাদের জন্য প্রতিকারমূলক শিক্ষা প্রাপ্তির ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। এখনই এ বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হলে তা পরবর্তী প্রজন্মের শিশু ও তাদের পরিবারের সামগ্রিক কল্যাণকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলবে।’
ইউনিসেফের নির্বাহী পরিচালক ক্যাথরিন রাসেল বলেন, ‘শিশুরা যখন তাদের শিক্ষক ও সহপাঠীদের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করতে পারে না, তখন তাদের শেখার ক্ষতি হয়। যখন তারা একেবারেই যোগাযোগ করতে পারে না, তখন তাদের শেখার ক্ষতি স্থায়ী হতে পারে। শেখার সুযোগ প্রাপ্তির ক্ষেত্রে এই ক্রমবর্ধমান বৈষম্যের অর্থ হলো শিক্ষা সবচেয়ে বড় সমতা বিধায়ক হওয়ার পরিবর্তে সবচেয়ে বড় বিভাজকে পরিণত হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। যখন বিশ্ব তার শিশুদের শিক্ষিত করতে ব্যর্থ হয়, তখন আমরা সবাই এর পরিণতি ভোগ করি।’
ক্যাথরিন রাসেল বলেন, ‘‘মহামারির আগেও সবচেয়ে প্রান্তিক শিশুদের পেছনে ফেলে রাখা হচ্ছিল। আর মহামারি যখন তৃতীয় বছরে পা রাখছে, তখন আমাদের ‘স্বাভাবিক’ পরিস্থিতিতে ফিরে যাওয়া সুযোগ নেই। আমাদের প্রয়োজন একটি নতুন স্বাভাবিক পরিস্থিতি, শিশুদের শ্রেণিকক্ষে ফিরিয়ে আনা এবং তাদের শেখার অবস্থা কী, তা মূল্যায়ন করা। তারা যা হারিয়েছে তা পুনরুদ্ধার করার জন্য তাদের প্রয়োজনীয় নিবিড় সহায়তা প্রদান এবং শিক্ষকরা যাতে তাদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ ও শিক্ষা উপকরণ পায় তা নিশ্চিত করা। এগুলো করতে না পারলে অনেক বেশি ঝুঁকি তৈরি হবে।”