নিজস্ব প্রতিবেদক
টিপ পরায় তেজগাঁও কলেজের থিয়েটার অ্যান্ড মিডিয়া স্টাডিজ বিভাগের প্রভাষক লতা সমাদ্দারকে হেনস্তার ঘটনায় অচেনা সেই অভিযুক্ত পুলিশ সদস্যকে শনাক্ত করা হয়েছে। তার নাম মো. নাজমুল তারেক। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) প্রটেকশন বিভাগে কনস্টেবল হিসেবে কর্মরত। ঘটনার দায় স্বীকার করায় গতকাল সোমবারই এক অফিস আদেশের মাধ্যমে তাকে বরখাস্ত করা হয়।
পাশাপাশি বহুল অলোচিত এ ঘটনার তদন্তে দুই সদস্যের কমিটি গঠন করেছে ডিএমপি। আগামী তিন কর্মদিবসের মধ্যে সেই কমিটিকে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে। এদিকে অভিযুক্ত পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানিয়েছে বিভিন্ন দল ও সংগঠন। গতকাল পৃথক সভা-সমাবেশ ও বিবৃতিতে এ দাবি জানানো হয়।
ডিএমপির মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশনস বিভাগের উপপুলিশ কমিশনার মো. ফারুক হোসেন জানান,তেজগাঁও কলেজের প্রভাষক ড. লতা সমাদ্দার গত শনিবার শেরেবাংলা নগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার (ওসি) বরাবর এক লিখিত অভিযোগ দেন। তাতে অভিযোগ করেন- পুলিশের পোশাকপরা একজন দ্বারা তিনি ইভটিজিং ও প্রাণনাশের চেষ্টার শিকার হয়েছেন, যার ঘটনাস্থল ফার্মগেটের সেজান পয়েন্টের কাছাকাছি।
এ অভিযোগের ভিত্তিতে ডিএমপির তেজগাঁও বিভাগের উপপুলিশ কমিশনারের নির্দেশে তদন্তকাজ শুরু করে পুলিশ। সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণ, গোয়েন্দা তথ্য ও বিভিন্ন তথ্য বিশ্লেষণ করে তেজগাঁওয়ের পুলিশ ঘটনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কনস্টেবল নাজমুল তারেককে সোমবার প্রাথমিকভাবে শনাক্ত করে।
জিজ্ঞাসাবাদে অভিযোগকারীর সঙ্গে বাগ্বিতÐায় লিপ্ত হওয়ার কথা স্বীকার করায় তাকে চাকরি থেকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়েছে। এ ছাড়া ঘটনা তদন্তে গঠন করা হয়েছে দুই সদস্যবিশিষ্ট তদন্ত কমিটি। এই কমিটিকে আগামী তিন কার্যদিবসের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করতে বলা হয়েছে।
তেজগাঁও বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) বিপ্লব কুমার সরকার বলেন, ‘ফার্মগেটে ড. লতা সমাদ্দারকে হেনস্তার অভিযোগে তিনি শুধু একজন পুলিশ সদস্যের কথা বলেছিলেন। এ ছাড়া অন্য কোনো পরিচয় নিশ্চিত করতে পারেননি। ডিএমপি কমিশনার, আইজিপি ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীও ঘটনার যথাযথ তদন্তের নির্দেশ দেন। সিসিটিভি ফুটেজ, ডিজিটাল ও অ্যানালগ- সব পর্যায়ে তদন্ত করে কনস্টেবল নাজমুলের ব্যাপারে নিশ্চিত হই। তার মোটরসাইকেল নম্বর ধরেও নাম-পরিচয় নিশ্চিত হওয়া গেছে। আমরা অভিযুক্ত কনস্টেবল নাজমুল তারেকের সঙ্গে কথা বলেছি। অভিযোগকারী নারীর সঙ্গে একটি ঘটনা ঘটেছে বলে তিনি স্বীকারও করেছেন। এখন টিপ পরা বা ইভটিজিংসংক্রান্ত তথ্যের সত্যতা নিশ্চিতে যথাযথ প্রক্রিয়ায় তদন্ত করব। এ ঘটনায় তদন্ত চলমান আছে। যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করে তদন্ত ও ঘটনার সত্যতা তুলে আনা হবে।’
ডিসি বিপ্লব কুমার আরও বলেন, ‘ঘটনার পর অভিযুক্ত পুলিশ সদস্যকে খুঁজে বের করতে আমাদের সময় লেগেছে প্রায় দুদিন। কারণ অভিযুক্ত কনস্টেবল নাজমুল তেজগাঁও বিভাগে কর্মরত নন, তিনি ডিএমপির প্রটেকশন বিভাগে কর্মরত। সোমবার সকালে তাকে আমরা শনাক্ত করে জিজ্ঞাসাবাদ করেছি। তিনি (অভিযুক্ত পুলিশ) জানিয়েছেন, টিপ পরার বিষয়ে সারাদেশে তাকে নিয়ে যে তোলপাড় হয়েছে সেটি তিনি জানতেন না। ঘটনার পরদিন অফিসও করেছেন। তিনি বাটন মোবাইল ফোনসেট ব্যবহার করেন। এ ছাড়া দুদিন টেলিভিশনে খবর না দেখার কারণে ঘটনা সম্পর্কে জানতেন না তিনি। এমনকি তার কোনো সহকর্মী এ বিষয়ে তাকে কিছু জানাননি। কনস্টেবল নাজমুলের গ্রামের বাড়ি যশোরে।’
ওই শিক্ষিকা হেনস্তার ঘটনার পরপর বিভিন্ন গণমাধ্যমে খবর আসে, অভিযুক্ত পুলিশ সদস্যের ব্যবহৃত মোটরসাইকেলটি অবৈধ ও চোরাই, যেটি পাঁচ বছর আগে মিরপুর থেকে চুরি হয়েছিল। সেই মোটরসাইকেলটিই হয়তো ব্যবহার করতেন পুলিশের ওই সদস্য। বিষয়টি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও পুলিশকে কটাক্ষ করে বিভিন্ন পোস্ট আসতে থাকে।
কনস্টেবল নাজমুলের ব্যবহৃত মোটরসাইকেল কি চুরির, এমন কোনো তথ্য মিলেছে কিনা জানতে চাইলে ডিসি বিপ্লব বলেন, ‘আমরা এখন পর্যন্ত যতটুকু প্রমাণ পেয়েছি, তাতে মনে হয়েছে পুলিশ সদস্যের ব্যবহৃত মোটরসাইকেলটির বৈধ এবং সঠিক কাগজপত্র রয়েছে। পুলিশ তাকে অধিকতর জিজ্ঞাসাবাদ করছে। কেন সে এটা করল, সেটাও জানার চেষ্টা চলছে।’ তার বিষয়ে আইনানুগ পদক্ষেপ কী- জানতে চাইলে বিপ্লব কুমার সরকার বলেন, ‘সব জায়গায় ঘটনা নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। সংসদেও আলোচনা হয়েছে। তবে আলোচনা হোক বা না হোক, আমরা প্রত্যেকটি অভিযোগ গুরুত্বের সঙ্গে তদন্ত করি। এ ক্ষেত্রেও এর ব্যত্যয় ঘটেনি। ওই কনস্টেবলের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা প্রক্রিয়াধীন।’
এ বিষয়ে ডিএমপি কমিশনার মোহা. শফিকুল ইসলাম জানান, ঘটনার অভিযোগ ওঠার পর থেকেই পুলিশ গুরুত্বসহকারে জোরালো তদন্ত এবং অভিযুক্তকে শনাক্ত করেছে। তদন্তে যে পুলিশ আন্তরিক, গাফিলতির সুযোগ নেই- এটা ইতোমধ্যে প্রমাণিত। তবে যিনি ঘটনা সম্পর্কে অভিযোগ করেছেন, তাকে প্রমাণ করতে হবে। আমাদের তদন্ত কমিটি হয়েছে। কমিটি তদন্ত করছে। অভিযোগকারীকে অভিযোগের বিষয়ে প্রমাণ করতে হবে- আসলে ঘটনা ঘটেছে এবং পুলিশ সদস্য ঘটনায় জড়িত।
রাজধানীর গ্রিন রোডের বাসা থেকে গত শনিবার কলেজে যাওয়ার পথে শিক্ষিকা লতা সমাদ্দার উত্ত্যক্তের শিকার হন বলে পুলিশের কাছে অভিযোগ জানান। লিখিত বক্তব্যে তিনি অভিযোগ করেন, কলেজে হেঁটে যাওয়ার সময় পাশ থেকে মধ্যবয়সী, লম্বা দাড়িওয়ালা একজন ‘টিপ পরছস কেন’ বলেই বাজে গালি দেন তাকে। ওই মধ্যবয়সী ব্যক্তির গায়ে পুলিশের পোশাক ছিল। ঘটনার প্রতিবাদ জানালে একপর্যায়ে তার পায়ের ওপর দিয়েই বাইক চালিয়ে চলে যান সেই ব্যক্তি। এতে তিনি আহত হন। পরে এ ঘটনায় শেরেবাংলানগর থানায় একটি অভিযোগ দায়ের করেন তিনি।
এ ঘাটনার প্রতিবাদে গতকাল জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে বাংলাদেশ নারী প্রগতি সংঘ ও জনউদ্যোগের যৌথ কর্মসূচিতে নেতারা বলেন, নারী শিক্ষিকাকে হেনস্তার ঘটনা সা¤প্রদায়িক আচরণের নগ্নরূপ। সাংবিধানিকভাবেই প্রত্যেক নারী-পুরুষের নিজের পছন্দ অনুযায়ী সাজপোশাক নির্বাচনের অধিকার রয়েছে। লতা সমাদ্দারকে হেনস্তাকারী পুলিশ সদস্যকে অবশ্যই দৃষ্টান্তমূলক শান্তির আওতায় আনতে হবে। অন্যথায় আমরা গণবিক্ষোভের আয়োজন করব।
নারী প্রগতি সংঘের উপপরিচালক শাহনাজ সুমীর সভাপতিত্বে প্রতিবাদ কর্মসূচিতে বক্তব্য রাখেন সিপিবির কেন্দ্রীয় নেতা লুনা নূর, সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী জীবনানন্দ জয়ন্ত, জাতীয় আদিবাসী ফোরামের সহসাংগঠনিক সম্পাদক হরেন্দ্রনাথ সিং, ছাত্র ইউনিয়নের সাবেক সভাপতি মেহেদী হাসান নোবেল, গার্মেন্ট শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের সাংগঠনিক সম্পাদক কেএম মিন্টু, নারী প্রগতি সংঘের সমন্বয়কারী নাসরিন বেগম, জনউদ্যোগের সদস্যসচিব তারিক হোসেন মিঠুল, নারী মুক্তি সংসদের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক শিউলি সিকদার, ইনস্টিটিউট ফর এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের সমন্বয়ক সঞ্চিতা তালুকদার, তরুণ সমাজের প্রতিনিধি মাহমুদা আকন্দ প্রমুখ।
ঘটনাটি সুষ্ঠু তদন্তসাপেক্ষে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছে আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)। টিপ পরায় প্রভাষক লতা সমাদ্দারকে হেনস্তায় অভিযুক্ত পুলিশ সদস্যকে বিচারের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানিয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) শিক্ষক সমিতিও।