২০১৭ সালের বিপিএল। ১৭ নভেম্বর মিরপুরে মুখোমুখি সিলেট সিক্সার্স ও রাজশাহী কিংস। বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের দুর্নীতি দমন বিভাগ জানতে পারে, মাঠে বসেই জুয়ায় মেতেছে জুয়াড়িরা। অভিযান চালিয়ে গ্যালারি থেকে আটক করা হয় ৭৭ জনকে।
তখনকার বিপিএল গভর্নিং কাউন্সিলের সদস্যসচিব ইসমাইল হায়দার মল্লিক ওই বিপুলসংখ্যক জুয়াড়িকে আটক করা নিয়ে বললেন, ওই জুয়াড়িদের ৬৫ জন বাংলাদেশি, ১০ জন ভারতীয় এবং দুজন ছিল অন্য দেশের। তাদের পুলিশে সোপর্দ করা হয়েছিল। মোবাইলে জুয়া খেলার পাশাপাশি তথ্য পাচার করছিল তারা।
প্রশ্ন আসতে পারে, কী তথ্য পাচার করছিল তারা? মজাটা এখানেই। প্রযুক্তিবিদরা জানান, মাঠে চলা খেলা সরাসরি টেলিভিশন, ফেসবুক, ইউটিউব, টুইটারে আসে ভিন্ন ভিন্ন সময়ে, একটু দেরিতে। কারণ ‘স্যাটেলাইট কমিউনিকেশন ডিসটেন্স’ সর্বনিম্ন হয় ৩৬ হাজার কিলোমিটার। এর সঙ্গে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতার বিষয়ও যুক্ত। মাঠে খেলার ভিডিও সম্প্রচারকারী সংস্থা হয়ে বাড়ির টেলিভিশন পর্যন্ত পৌঁছতে তাই হেরফের হয় সময়ের। টেলিভিশনের তুলনায় ফেসবুক, ইউটিউবে তা আরো বেশি।
বাংলাদেশের একমাত্র স্পোর্টস চ্যানেল টি-স্পোর্টসের জ্যেষ্ঠ নির্বাহী সাইফুল ইসলাম জানালেন, ‘স্যাটেলাইট টু স্যাটেলাইট ভিডিও আসতে সময়ের হেরফের হবে দুই সেকেন্ড। বাড়ির টিভি পর্যন্ত সেটা পৌঁছতে পারে পাঁচ থেকে সাত সেকেন্ড পর। আর ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম বা ফেসবুক, ইউটিউব, টুইটারে ভিডিও আপলোড হবে অন্তত ৩০ সেকেন্ড পর। এখানে আমাদের হাতে কিছু নেই। পুরোটাই প্রযুক্তির ব্যাপার। আশার কথা, প্রযুক্তি উন্নত হচ্ছে। ভবিষ্যতে হয়তো মাঠের সময়ের সঙ্গেই ফেসবুক, ইউটিউবে ম্যাচ দেখাতে পারব আমরা। ’
ক্রিকেট জুয়া তদন্তে যুক্ত সরকারি সংস্থার কর্মকর্তারা বলছেন, জুয়াড়িরা ফায়দা লুটছে এই সময়টারই। পাঁচ থেকে সাত সেকেন্ড এমনিতে চোখের পলকে চলে গেলেও জুয়াড়িদের কাছে এটাই যথেষ্ট সময়। আর ফেসবুক, ইউটিউবের ৩০ সেকেন্ড মানে তো সোনায় সোহাগা। জুয়াড়িদের এজেন্ট মাঠে মোবাইল নিয়ে বসে খেলা দেখতে। কোনো বলে ব্যাটার রান নিলেন কি না, চার-ছয় মারলেন কি না কিংবা আউট হলেন কি না—এসব তথ্য ফোনে তাৎক্ষণিক জানিয়ে দেন দেশে-বিদেশে থাকা জুয়া নিয়ন্ত্রকদের কাছে। ছবির আগে চলে যায় সে তথ্য। এখন যেহেতু প্রতি বলে বাজি হয়, তাই ফাঁদে পড়ে বাজি ধরা লোকজন। তারা জানতেও পারে না, যে বলের জন্য বাজি ধরা হচ্ছে তার ফল ৩০ সেকেন্ড আগেই জুয়াড়িদের কাছে চলে গেছে। ফল জেনে বাজির রেট বাড়িয়ে-কমিয়ে সাধারণ মানুষের টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে জুয়াড়িরা।
সব তথ্যই কি মাঠ থেকে যথাসময়ে পেয়ে যায় জুয়া নিয়ন্ত্রণকারীরা? সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের ব্যাখ্যা, একটি ম্যাচের যে কয়েকটি বল বা তথ্যের ক্ষেত্রে তারা পিছিয়ে থাকে, সেগুলোতে হয়তো জুয়ায় অংশ নেওয়া ব্যক্তিদের একটা অংশের কিছুটা লাভবান হওয়ার সুযোগ থাকে। কিন্তু জুয়াড়িরা মাঠ থেকে তথ্য জেনে যখন বাজির রেট বাড়িয়ে দেয়, তখন একবারেই চলে যায় সব অর্থ।
এমনই এক ঘটনা কলকাতা পুলিশের দুঁদে গোয়েন্দাদের চোখে পড়ে ২০১৯ সালে ইডেনে ভারত-বাংলাদেশ গোলাপি বলের টেস্টে। ম্যাচে ইনিংস ও ৪৬ রানে যাচ্ছেতাইভাবে হেরেছিল বাংলাদেশ। তাতে বয়েই গেছে জুয়াড়িদের। কোন বলে কী হচ্ছে সেটা সঙ্গে সঙ্গে বেটিং ওয়েবসাইটে তুলে দিচ্ছিলেন মাঠে থাকা তিন জুয়াড়ি শম্ভু দয়াল, মুকেশ গোরে ও চেতন শর্মা। সময় আর বুদ্ধির অভূতপূর্ব মেলবন্ধন দেখছিলেন গোয়েন্দারা। ম্যাচ চলার সময়ই গ্রেপ্তার করা হয় তাঁদের।
বিভিন্ন এজেন্ট দিয়ে এই সময়টা কাজে লাগিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার পীরবাড়ি এলাকার ছোট্ট কনফেকশনারির দোকানি সাব্বির মিয়া অল্পদিনেই হয়েছেন কোটিপতি। গত ২২ মে র্যাবের হাতে ধরা পড়েন সাব্বির।
আর সিআইডির অনুসন্ধানে বের হয়ে এসেছে, কক্সবাজারে ৩০টি গ্রুপ জড়িত এমন জুয়ায়। পুরান ঢাকায় আবার ব্যবসায়ীরা ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে অংশ নিচ্ছেন ক্রিকেট জুয়ায়। তাঁদের কয়েকজন গ্রেপ্তারও হয়েছেন। আইনের ফাঁক গলে বেরও হয়ে যাচ্ছেন সহজে।
আইনের এই ফাঁক নিয়ে সিআইডির সাইবার পুলিশ সেন্টারের অতিরিক্ত ডিআইজি কামরুল আহসান বলেন, জুয়ার আইনটা প্রায় ১৫০ বছর আগের। সেখানে ক্যাসিনো শব্দটির উল্লেখ নেই। ১০০-২০০ টাকা জরিমানা আর তিন মাসের জেলের বিধান আছে। তাই সামান্য অঙ্কের জরিমানা করে ছেড়ে দিতে হয় দেশি-বিদেশি জুয়াড়িদের। তিনি বলেন, ‘এখন প্রতারণাসহ অন্য মামলা দিয়ে বড় অঙ্কের জুয়া খেলা জুয়াড়িদের আটকানোর চেষ্টা করি আমি। যেভাবেই হোক, দেশের টাকাপাচার ঠেকানোই লক্ষ্য আমাদের। ’
টেলিভিশন, ফেসবুক, ইউটিউব আর টুইটারে সাত থেকে ৩০ সেকেন্ড পর আসা মাঠের খেলার তথ্য নিয়ে চলা জুয়ার তথ্যে বিস্মিত ওয়ানডেতে বাংলাদেশের হয়ে প্রথম ফিফটি করা আজহার হোসেন শান্টু। তিনি কালের কণ্ঠকে বললেন, ‘প্রথম জানলাম ব্যাপারটা। আমি চাই জুয়ার আগ্রাসন বন্ধ হোক। মোবাইল এখন জীবনের অংশ। এর পরও মোবাইল ছাড়া দর্শকদের মাঠে আসতে বলা যায় কি না, তা ভাবা যেতে পারে। ’