অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে পাঁচ বছরে সরকারের বিভিন্ন দপ্তর থেকে লোপাট করা হয়েছে পৌনে এক লাখ কোটি টাকা। এরমধ্যে ২৭ হাজার কোটি টাকা উদ্ধার করা গেলেও তছরুপের প্রায় ৬৪ শতাংশই রয়ে গেছে আদায়ের বাইরে। বাকি এই টাকা কবে নাগাদ উদ্ধার হবে, আদৌ হবে কি না, তা নিয়ে সংশয়ে আছেন সংশ্লিষ্টরা।
জাতীয় সংসদের সরকারি হিসাব সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সর্বশেষ সভায় বাংলাদেশের মহাহিসাব নীরিক্ষক ও নিয়ন্ত্রকের কার্যালয় উপস্থাপিত অডিট প্রতিবেদনে এই তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। ২০১৫ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন খাত থেকে উল্লিখিত অঙ্কের অর্থ তছরুপ করা হয়েছে বলে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। সংসদীয় কমিটি অডিটে চিহ্নিত অনিয়মের অর্থ দ্রুত আদায় করে তা সরকারি কোষাগারে জমা দেয়ার উপর তাগিদ দিয়েছে। একই সঙ্গে অর্থ তছরুপের সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণেরও সুপারিশ করা হয়েছে।
প্রতিবেদনে অর্থ আদায়ের বিষয়ে বলা হয়েছে, দুর্নীতি ও অনিয়মের মাধ্যমে আত্মসাৎ করা সরকারি অর্থ থেকে গত পাঁচ বছরে আদায় হয়েছে প্রায় ২৭ হাজার কোটি টাকা। ব্যাংক, জ্বালানি, সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী, বিদ্যুৎ, টেলিকমসহ বিভিন্ন উৎস থেকে এ অর্থ ফেরত আনা হয়েছে। আদায়কৃত অর্থ রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা হয়েছে।
বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও সংস্থা থেকে অনিয়ম ও দুর্নীতির অর্থ উদ্ধারের ২০২১ সালের হিসাবটি এখন চূড়ান্ত হয়নি। তবে ২০১৫-২০২০ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন খাত থেকে উল্লিখিত অঙ্কের অর্থ উদ্ধার করেছে সিএজি। এর মধ্যে ২০১৯-২০২০ সালে অর্থ উদ্ধারের অঙ্ক ৬ হাজার ৪২১ কোটি ৬৬ লাখ টাকা এবং ২০১৮-২০১৯ সালে উদ্ধারকৃত টাকার অঙ্ক ৯ হাজার ৭৭৩ কোটি ৪৮ লাখ টাকা। এছাড়া ২০১৭-১৮ সালে অনিয়মের অর্থ উদ্ধার হয় ৮ হাজার ৩১৭ কোটি টাকা, ২০১৬-২০১৭ সালে অর্থ উদ্ধারের অঙ্ক হলো ৭৩১ কোটি ৯৪ লাখ এবং ২০১৫-২০১৬ সালে উদ্ধার হয় ১ হাজার ৬৮৬ কোটি ৬২ লাখ টাকা। অনিয়মের অর্থ উদ্ধার প্রসঙ্গে সরকারি হিসাব সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সভাপতি রুস্তুম আলী ফরাজী বলেন, অডিট অনিয়মের অর্থ আদায় কিছুটা কমেছে করোনার কারণে। আদায়ের আরো একটি বড় সমস্যা হচ্ছে অনেকে অবসর জীবনে চলে যান। যদিও আর্থিক অনিয়মের সঙ্গে তারা জড়িত। তবে আমি যদি দেখি আপত্তি সঠিক, তবে সেখানে যে কেউ হোক টাকা আদায় করে থাকি।
তথ্যমতে, ২০১৯-২০২০ অর্থবছরের অনিয়ম ও দুর্নীতির উল্লেখযোগ্য কয়েকটি ঘটনার মধ্যে একটি হলো স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়ন মন্ত্রণালয়ের আর্থিক অনিয়মের ঘটনা। এখান থেকে প্রায় ৪৭ কোটি টাকা উদ্ধার করা হয়। ব্যাংকিং খাত থেকে আদায় হয় ২৮ কোটি টাকা। একইভাবে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয় থেকে প্রায় ১১ কোটি, জ্বালানি মন্ত্রণালয় থেকে ৪৮ কোটি, স্থানীয় সরকার বিভাগ থেকে ৩৩ কোটি এবং পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় থেকে আদায় হয় ১৩ কোটি টাকা। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে জ্বালানি খাত থেকে ৬৩৯ কোটি টাকা আদায় করা হয়। একই বছরে ব্যাংকিং খাত থেকে ৩৯ কোটি, টেলিকম খাত থেকে ১৫ কোটি এবং বিদ্যুৎ খাত থেকে ১৬ কোটি টাকা আদায় হয়। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে শুধু টেলিকম খাত থেকে আদায় করা হয় ১ হাজার ৬২৯ কোটি টাকা, স্থানীয় সরকার বিভাগ থেকে ৩৮ কোটি টাকা আদায় করা হয়।
আদায়ের হার কম থাকলেও সিএজি অফিসের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা জানান, ২০২০ সালে সিএজি কার্যালয়ের বাজেট ছিল ২৩৭ কোটি ১৩ লাখ টাকা। ওই বছর আদায় করা হয়েছে ৬ হাজার ৪২১ কোটি টাকা। এতে সিএজি অফিস এক টাকা ব্যয়ে করে ২৭ টাকা অর্জন করে। অডিট আপত্তির পর টাকা আদায় এবং সংশ্লিষ্ট দায়ীদের শাস্তির আওতায় আনার বিষয়ে তিনি বলেন, সিএজির নিরীক্ষা প্রতিবেদন সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রপতির কাছে জমা দেয়া হয়। রাষ্ট্রপতি এটি জাতীয় সংসদে উপস্থাপন করেন। এরপর এটি সরকারি হিসাব সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির কাছে পর্যালোচনার জন্য যায়। ওই কমিটি অর্থ আদায়সহ নানা ধরনের সুপারিশ করে থাকে। সেসময় ওই কমিটির কাছে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সচিব জবাবদিহি করেন।
এ বিষয়ে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল অব বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, দুর্নীতি ও অনিয়মের অর্থ আদায় সিএজি অফিসের একটি ভালো উদ্যোগ। এটি এক ধরনের সাফল্যের প্রতীক। তবে শুধু সিএজি অফিসের দায়িত্বই শেষ নয়। মন্ত্রণালয়গুলোর উচিত এসবের বিরুদ্ধে আইনগত যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া। অনিয়মের ক্ষতিগ্রস্ত অর্থ উদ্ধার করা। এর সঙ্গে জড়িতদের জবাবদিহিতা ও শাস্তি নিশ্চিত করা।