ফোশান গ্রুপের ওয়েবসাইটে ঢুঁ মারলে শুরুতেই চোখ আটকে যাবে নজরকাড়া এক টাইলসের বিজ্ঞাপনে। আদতে ক্রেতাদের মন ভোলাতে বিজ্ঞাপনে এমন চাকচিক্য। শিল্প গ্রুপ খুলে যিনি শিল্পপতি সেজেছেন, তিনি জিয়াউদ্দিন জামান; কোম্পানিটির চেয়ারম্যান। আভিজাত্যের জানান দিতে হাঁকান দামি ল্যান্ডক্রুজার গাড়ি, হাতে রোলেক্স ব্র্যান্ডের ঘড়ি। দুবাইয়ে তার সেকেন্ড হোম। ‘নৈতিকতা ও সততা ব্যবসার মূলমন্ত্র’- এমন স্লোগান করেছেন লালন। ফোশান গ্রুপের ওয়েবসাইটের তথ্য দাবি করছে, কোম্পানিটির অঙ্গ প্রতিষ্ঠান ২০টির বেশি। অনেক তালাশ করেও কোনোটির মেলেনি অস্তিত্ব। হরেক প্রতিষ্ঠানের নামে ‘প্রতারণার দোকান’ খুলে ৬১০ কোটি টাকা হাতিয়ে জিয়া এখন নিখোঁজ।
বাগেরহাটের মোরেলগঞ্জে জিয়ার গ্রামের বাড়ি। রাজধানীর বনানীর ৪ নম্বর রোডে একটি ফ্ল্যাটে তার আস্তানা। ভুঁইফোঁড় ২০ শিল্প প্রতিষ্ঠানের মোট কর্মচারী ছয় থেকে সাতজন। তার ঠকবাজির ধরন কোনো কোনো ক্ষেত্রে দেশের আরেক ‘প্রতারণার লিজেন্ড’ রিজেন্ট হাসপাতালের মালিক সাহেদ করিমকেও হার মানায়। প্রতারক সাহেদের মতো সমাজের প্রভাবশালী ব্যক্তিদের সঙ্গে ছবি তুলে তা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দিতেন জিয়া। টাইলস ব্যবসার বিশেষজ্ঞ হিসেবে একাধিক টেলিভিশনে টকশোতে অংশ নিতেন।
জিয়ার প্রতারণার গ্যাঁড়াকলে পড়ে অনেকেই এখন ফতুর। ইউরোপ, আমেরিকা ও মধ্যপ্রাচ্যে পাঠানোর কথা বলেও একেকজনের কাছ থেকে ১০-১২ লাখ টাকা হাতিয়েছেন এই প্রতারক। এরই মধ্যে জিয়ার নামে মামলা হয়েছে ১০টির বেশি। একাধিক ভুক্তভোগীর সুনির্দিষ্ট মামলা ও অভিযোগের পর জিয়ার বিরুদ্ধে তদন্তে নামে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ), দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ও একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা। নয়জন ভুক্তভোগী ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে আর্থিক জালিয়াতির এ তথ্য উঠে আসে।
জানা যায়, জালিয়াতি করে ভুয়া ব্যবসা প্রতিষ্ঠান দেখিয়ে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে মোটা অঙ্কের ঋণ নিয়েছেন জিয়া। এর মধ্যে সোনালী ব্যাংক থেকে ৩০০ কোটি টাকা, অগ্রণী ব্যাংক থেকে ১৯৬ কোটি ও ইসলামী ব্যাংক থেকে ১৭ কোটি টাকার ঋণ রয়েছে। জিয়াকে ঋণ পাইয়ে দিতে সহযোগিতা করতেন সংশ্নিষ্ট ব্যাংকেরই উচ্চ পদের কর্মকর্তারা। মধুপুরে জালিয়াতি করে নেওয়া যে জমিতে টাইলস কারখানা করার কথা, সেটির বাজারদর সর্বোচ্চ ১৫ কোটি টাকা। একজন প্রভাবশালীকে ৫০ শতাংশ শেয়ার দেওয়ার কথা বলে ওই জমির বিপরীতে ১৯৬ কোটি টাকা ঋণ নেওয়া হয়। হাতিয়ে নেওয়া টাকার একটি বড় অংশ বিদেশে পাচার করেন জিয়া। একটি চায়নিজ ভুয়া কোম্পানির বাংলাদেশি প্রতিনিধি সেজে দেশে একটি সেতু তৈরির সম্ভাব্যতা যাচাই সভায় অংশ নেন এই প্রতারক। এক ভুক্তভোগী জানান, ফোশান নামে চীনের একটি বড় শহর রয়েছে। ওই শহর টাইলস ও সিরামিকস কারখানার জন্য প্রসিদ্ধ। টাইলসের পেছনে ফোশান লেখা দেখিয়ে প্রচার করতেন চীনের কারখানায় এসব তৈরি করা হয়। জিয়ার কোম্পানির ওয়েবসাইটেও রয়েছে- তার প্রতিষ্ঠানের গ্লোবাল হেডকোয়ার্টার জিংজিং এলাকায়। রুম নম্বর-৯১৩, লেভেল-৯। কোম্পানির পরিচালক একজন চায়নিজ নারীর ছবি আছে। তার নাম ‘লি জিয়াওইং’ বলে দাবি করা হয়। ওমান ও সংযুক্ত আরব আমিরাতে সুবিশাল ভবনের ছবি ওয়েবসাইটে দিয়ে দাবি করা হয়, সেখানে আছে তার বাণিজ্যিক অফিস।
জিয়ার জালিয়াতির চক্করে পড়ে ৭৪ কোটি টাকা খুইয়েছেন শিল্পপতি নজরুল ইসলাম। তিনি ওয়াটা কেমিক্যালস লিমিটেডের কর্ণধার। সাখাওয়াত এইচ মেমোরিয়াল হাসপাতালেরও মালিক তিনি। ভুক্তভোগী নজরুল সমকালকে জানান, টাঙ্গাইলের মধুপুরে সিরামিকস কারখানায় বিনিয়োগের প্রস্তাব দিয়ে ২০১৯ সালে কয়েক দফায় তার কাছ থেকে ৭৪ কোটি টাকা হাতিয়েছেন জিয়া। তবে মধুপুরে সামান্য স্থাপনা ছাড়া আর কিছু নেই। কয়েক মাস পর বুঝতে পারেন, বড় ফাঁদে পড়েছেন।
টাঙ্গাইলের নাগরপুরের রফিকুল ইসলামও পড়েন জিয়ার ফাঁদে। তিনি বলেন, ‘২০১৯ সালে হঠাৎ দেখলাম, মধুপুরে একটি সিরামিকস কারখানার সাইনবোর্ড। মালিক পরিচয় দিয়ে সেখানে আসা-যাওয়া করতেন জিয়া। সংযুক্ত আরব আমিরাত সরকারের সঙ্গে তার ভালো সম্পর্ক বলে এলাকায় প্রচারণা চালাতেন। চাইলে যে কাউকে সহজে দুবাই নিতে পারেন বলে জানান। এরপর কয়েক বন্ধু মিলে তাকে ২০ লাখ টাকার বেশি দিয়েছি। পাসপোর্ট তৈরি করে দেওয়ার কথা বলে তিনি আমাদের ছবি ও অন্য কাগজপত্র নিয়েছেন। কয়েক মাস যাওয়ার পর তার দিক থেকে কোনো অগ্রগতি দেখছিলাম না। পরে জানতে পারি, যে জমিতে টাইলস ফ্যাক্টরির সাইনবোর্ড টানানো হয়েছে, তা গ্রামের অনেক মানুষকে প্রলোভন দেখিয়ে রেজিস্ট্রি করানো হয়। এরপর একসময় টাঙ্গাইলে যাতায়াত বন্ধ করে দেন জিয়া। মোবাইলে ফোন করলেও তিনি রিসিভ করতেন না।’
নারায়ণগঞ্জের ১৭ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর আবদুল করিম বলেন, ‘নারায়ণগঞ্জের নিতাইগঞ্জে ১০ তলা ভবন করছিলাম। ২০২১ সালের জানুয়ারিতে হঠাৎ আমার কাছে ফোশান টাইলসের বিক্রয়কর্মী পরিচয়ে এক ব্যক্তি আসেন। বাজারদর থেকে প্রতি বর্গফুটে চার টাকা কমে আমার ভবনে চায়নিজ টাইলস সরবরাহের প্রস্তাব দেন। তাদের বনানী অফিসে কোম্পানির চেয়ারম্যানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করার দাওয়াত দেন এক দুপুরে। এরপর বনানীতে গেলে জিয়ার সঙ্গে পরিচয়। ভাবভঙ্গি, অফিসের পরিবেশ ও কথাবার্তায় তিনি মুগ্ধ করেছিলেন। কয়েক দিন পর টাইলস কেনা বাবদ তাকে ৫০ লাখ টাকা দিয়েছিলাম।’
আবদুল করিম বলেন, ‘টাকা দেওয়ার কয়েক মাস পার হলেও টাইলস সরবরাহ না করলে আবার তার বনানী অফিসে যাই। তখন অফিসের লোকজন জানায়, স্যার বিদেশে। পরে ফেব্রুয়ারিতে এক ভোরে বনানীর অফিসে গেলে জিয়া তখন হাত-পায়ে ধরে বলেন, এক মাসের মধ্যে টাকা পরিশোধ করবেন। এর পর থেকে তার কোনো হদিস নেই। ফোন নম্বরও বন্ধ।’
এ ছাড়া ইকবাল হায়দার চৌধুরীর কাছ থেকে ১০ কোটি টাকা নেন জিয়া। এ ঘটনায় মতিঝিল থানায় মামলা করেন ইকবাল। মামলার এজাহারে তিনি বলেন, বিদেশ থেকে টাইলস আমদানির কারবারে ইকবালকে যুক্ত হওয়ার প্রস্তাব দেন জিয়া। এরপর তাকে ১০ কোটি টাকা দেওয়া হয়। লাভের একটি অংশ তাকে দেওয়ার কথা বলে ব্যবসায়িক অংশীদার হিসেবে তার নামে ভুয়া এলসি খোলা হয়। দীর্ঘদিন পার হলেও লাভের অংশ না পেয়ে হতাশ হয়ে পড়েন ইকবাল। বারবার মূল টাকা ফেরত চাইলেও ঘোরাতে থাকেন। একপর্যায়ে তাকে হুমকি দেন জিয়া। বেস্ট স্টিল স্ট্রাকচার নামে একটি কোম্পানির পাওনা তিন কোটি ২৫ লাখ টাকা ও ফরহাদ আলী রেজা নামের এক ব্যক্তি পাবেন আট লাখ টাকা।
হেলাল উদ্দিন নামের আরেক ভুক্তভোগী জানান, মধুপুরের কারখানায় শিগগিরই টাইলস উৎপাদন শুরু করবে। অগ্রিম টাকা দিলে ভালো কমিশনে টাইলস সরবরাহ করা হবে- এমন আশ্বাসে হেলালের কাছ থেকে এক কোটি ২৫ লাখ টাকা নিয়েছিলেন। তবে আড়াই বছর ধরে ওই টাকা ফেরত দিচ্ছেন না জিয়া। এ ঘটনায় পল্টন থানায় করেছেন তিনি।
জিয়ার যে প্রতিষ্ঠানের নাম ভাঙিয়ে টাকা হাতাতেন সেগুলো হলো- ফোশান টাইলস, ব্ল্যাক হর্স টাইলস, জিয়া ব্রিকস লিমিটেড, মেজর চায়না লিমিটেড, মাসকাট ফুড অ্যান্ড বেভারেজ, হাইটেকস সিরামিকস, কাশফুল টয়লেট্রিজ, ফোশান ট্রেডিং, হাই-লেডি স্যানিটারি ন্যাপকিন, চায়না কনস্ট্রাকশন কোম্পানি লিমিটেড, ফোশান বিল্ডিং ম্যাটেরিয়ালস ট্রেডিং, গ্রিন বায়োটেক লিমিটেড, ডাইনিং মাসকট, নিউ জং ইউয়ান সিরামিক কোম্পানি, ফোশান গ্রুপ ইউএসএ, ফোশান ট্রেডিং ওমান এবং ব্ল্যাকহর্স এক্সপোর্ট-ইমপোর্ট কোম্পানি।
আর জিয়া যেসব ব্যবসায়িক সংগঠনের সদস্য হিসেবে নিজেকে পরিচয় দিতেন, এর মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স ইন্ডাস্ট্রি, ওমান চেম্বার অব কমার্স ইন্ডাস্ট্রি, বাংলাদেশ সিরামিকস ম্যানুফ্যাকচারার অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন, বাংলাদেশ-চায়না চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি এবং বাংলাদেশ অর্গানিক প্রডাক্টস ম্যানুফ্যাকচারিং অ্যাসোসিয়েশন।
এ ব্যাপারে কথা বলতে অভিযুক্ত জিয়াউদ্দিন জামানের ব্যবহূত সাতটি নম্বরে একাধিকবার ফোন দেওয়া হলেও তা বন্ধ পাওয়া যায়। এসএমএস পাঠানো হলেও তিনি ফিরতি কোনো বার্তা দেননি।
জিয়ার ৭৪ কোটি টাকা আত্মসাতের ঘটনায় গত ১ এপ্রিল মামলা হয় গুলশান থানায়। এ ব্যাপারে গুলশান থানার ওসি আবুল হাসান বলেন, জিয়াকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে। এটি যেহেতু অর্থ জালিয়াতির বিষয়, তাই মামলাটি সিআইডিতে স্থানান্তরের প্রস্তাব দিয়েছি।