নিজস্ব প্রতিবেদক
বহুল আলোচিত রমনা বটমূলে বোমা হামলার মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত, ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত এবং একাধিক মামলার পলাতক আসামি মুফতি শফিকুর রহমান ওরফে আব্দুল করিম ওরফে শফিকুল ইসলামকে গ্রেপ্তার করেছে র্যাব।
র্যাব বলছে, মুফতি শফিকুল ২০০১ সালে রমনা বটমূলে বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে বোমা হামলা, ২০০৪ সালে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা ছাড়াও ২০০৫ সালের ২৭ জানুয়ারি হবিগঞ্জ সদর থানার বৈদ্যের বাজারে গ্রেনেড হামলায় সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এএমএস কিবরিয়াসহ ৫ জন নিহতের ঘটনায় সম্পৃক্ত ছিল।
বৃহস্পতিবার রাতে র্যাব-২ কিশোরগঞ্জের ভৈরব এলাকায় অভিযান পরিচালনা তাকে গ্রেপ্তার করে। শুক্রবার দুপুরে রাজধানীর কারওয়ান বাজার র্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান র্যাব সদরদপ্তরের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইং পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন
২০০১ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত রমনা বটমূলে হামলার পর আত্মগোপনে থেকে সংগঠনের সাথে সম্পৃক্ত থাকেন মুফতি শফিকুল। ২০০৮ থেকে নরসিংদীতে একটি মাদ্রাসায় নিজের পরিচয় গোপন করে ‘আব্দুল করিম’ ছদ্মনামে ওই এলাকার চরে অবস্থিত একটি মসজিদে মাসিক ৫ হাজার টাকা বেতনে ইমামতির চাকরি করতেন। ইমামতির আড়ালে তিনি মানুষকে ধর্মের নামে বিভ্রান্তিমূলক অপব্যাখ্যা প্রচার করতেন।
মামলা সম্পর্কে র্যাব জানায়, গত ১৪ এপ্রিল ২০০১ সালে রমনা বটমূলে ছায়ানটের বর্ষবরণ অনুষ্ঠান চলাকালীন সময় প্রকাশ্য দিবালোকে দুর্বৃত্তদের অতর্কিত বোমা হামলায় ১০ জন মৃত্যুবরণ করেন এবং আরও অনেকে আহত হন। ওই ঘটনার পর রমনা থানায় একটি হত্যা মামলাসহ অপর একটি বিস্ফোরক দ্রব্য আইনে মামলা করা হয়। হত্যা মামলাটির বিচারে ২০১৪ সালের ২৩ জুন ৮ জনকে মৃত্যুদণ্ড এবং ৬ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয়। অপরদিকে বিস্ফোরক দ্রব্য আইনের মামলাটি দ্রুত বিচার ট্রাইবুন্যাল-১ এ বিচারাধীন রয়েছে।
খন্দকার আল মঈন বলেন, ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট ঢাকার বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে একটি জনসভা চলাকালে প্রকাশ্য দিবালোকে গ্রেনেড হামলা চালানো হয়। গ্রেনেড হামলায় ২৪ জন নিহত হন এবং প্রায় তিন শতাধিক গুরুতর আহত হয়। এ হাময় ঢাকার মতিঝিল থানায় একটি হত্যা ও হত্যা চেষ্টার সহযোগিতাসহ ২টি পৃথক মামলা হয়।
তিনি বলেন, দীর্ঘ বিচারিক প্রক্রিয়া শেষে গত ১০ অক্টোবর ২০১৮ সালে ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইবুন্যাল ১৯ জনকে মৃত্যুদণ্ড এবং মুফতি শফিকুর রহমানসহ ১৯ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড প্রদান করেন।
র্যাবের মুখপাত্র বলেন, গ্রেপ্তার শফিকুর রহমান উক্ত গ্রেনেড হামলার পরিকল্পনার সাথে সম্পৃক্ত ছিল। অপরদিকে একই ঘটনায় ঢাকার মতিঝিল থানায় বিস্ফোরক দ্রব্য আইনে অপর একটি মামলা করা হয়। মুফতি শফিকুর বিস্ফোরক দ্রব্য আইনে মামলারও পলাতক আসামি।
এছাড়াও র্যাব জানায়, ২০০৫ সালের ২৭ জানুয়ারি হবিগঞ্জ সদর থানাধীন বৈদ্যের বাজারে গ্রেনেড হামলায় সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এএমএস কিবরিয়াসহ ৫ জন নিহত এবং কমপক্ষে শতাধিক লোক আহত হন। উক্ত হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার শফিকুর রহমান কিবরিয়া হত্যা মামলায় চার্জশীটভুক্ত আসামি বলে জানা যায়। গ্রেপ্তার আসামি মুফতি শফিকুর রহমানের বিরুদ্ধে ভৈরব থানায় সর্বমোট ৬টি গ্রেপ্তারি পরোয়ানা রয়েছে।
কেই এই মুফতি শফিকুল
গ্রেপ্তারকে জিজ্ঞাসাবাদের ভিত্তিতে র্যাব কর্মকর্তা খন্দকার মঈন বলেন, সে নিজ গ্রাম থেকে ৫ম শ্রেণি পাশ করার পর মাদ্রাসায় পড়াশোনা শুরু করে। ১৯৭৫ সালে ঢাকার চকবাজারে অবস্থিত একটি মাদ্রাসা থেকে ১৯৮৩ সাল পর্যন্ত হেদায়ায় পড়াশোনা করে। হেদায়া পাস করার পর ১৯৮৩ সালে পার্শ্ববর্তী দেশে দারুল উলুম দেওবন্দ মাদ্রাসায় ভর্তি হয়ে ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত দাওরায়ে হাদিস (টাইটেল) পাস করে বাংলাদেশে ফেরত আসে। ১৯৮৭ সালে পাকিস্তানের করাচিতে ইউসুফ বিন নুরী মাদ্রাসায় ফতোয়া বিভাগে ভর্তি হয়ে ৩ বছরের ইফতা (ফতোয়া) কোর্স সম্পন্ন করে।
র্যাব আরও জানায়, ১৯৮৯ সালে পাকিস্তানে অবস্থানকালীন মুফতি শফিকুল আফগানিস্তানে চলে যায় এবং তালেবানদের পক্ষে যুদ্ধ করেন। এরপর ১৯৮৯ সালের শেষের দিকে বাংলাদেশে ফিরে আসে। বাংলাদেশে আসার পর সে ঢাকার খিলগাঁও এ একটি মাদ্রাসায় পার্ট টাইম শিক্ষকতা শুরু করে। ১৯৮৭ সালে পাকিস্তানের করাচীর নিউ টাউনে পড়াশোনাকালে সেই প্রতিষ্ঠানে মুফতি হান্নানও পড়াশোনা করতে গেলে তার সাথে পরিচয় হয়। পাকিস্তান থেকে আফগানিস্তানে ভ্রমনে গেলে আফগানিস্তানে থাকাকালীন জঙ্গী সংগঠন ‘হরকাতুল জিহাদের’ সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়।
কমান্ডার খন্দকার মঈন বলেন, আফগানিস্তান থেকে দেশে এসে ‘হরকাতুল জিহাদ (বি)’ নামে একটি জঙ্গি সংগঠন গড়ে তোলার চিন্তা করে মুফতি শফিকুল। পরবর্তীতে ১৯৯০ সালে দেশে ফেরত এসে সমমনাদের সাথে নিয়ে প্রতিষ্ঠাতা সদস্য হিসেবে ‘হরকাতুল জিহাদ (বি)’ সংগঠন প্রতিষ্ঠা করে এবং দাওয়াতের কাজ শুরু করে। ১৯৯০ সাল থেকে ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত সে ‘হরকাতুল জিহাদ (বি)’ এর প্রচার সম্পাদক ছিল। ১৯৯৩ সাল থেকে ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত সে হরকাতুল জিহাদ এর আমীর ছিল। ১৯৯৭ সাল থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত সে হরকাতুল জিহাদ এর সুরা সদস্য ছিল।
গ্রেপ্তারকে জিজ্ঞাসাবাদে র্যাবের এই কর্মকর্তা আরও বলেন, মুফতি শফিকুল ইমামতির আড়ালে মানুষকে ধর্মের নামে বিভ্রান্তিমূলক অপব্যাখ্যা প্রচার করতেন। সে অত্যন্ত কৌশলে মাঝে মধ্যে ভিন্ন স্থানে তার পরিবারের সদস্যদের সাথে দেখা সাক্ষাৎ করত। বিগত ২১ বছর তিনি এভাবেই আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর নজর এড়িয়ে চলে বিভিন্ন স্থানে আত্মগোপনে ছিলেন। তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা প্রক্রিয়াধীন।