ভুঁইফোড় রিয়েল এস্টেট কোম্পানি ধরতে মাঠে রাজউক ক্রেতাদের সঙ্গে প্রতারণা বন্ধে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছি : চেয়ারম্যান রাজউক

ভুঁইফোড় রিয়েল এস্টেট কোম্পানি ধরতে মাঠে রাজউক ক্রেতাদের সঙ্গে প্রতারণা বন্ধে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছি : চেয়ারম্যান রাজউক

দেশের রিয়েল এস্টেট ও আবাসন কোম্পানিগুলোর মধ্যে একটি বড় অংশই নির্ধারিত অর্থ ও কিস্তি পরিশোধের পরও তাদের ক্রেতাদের জমি, প্লট কিংবা ফ্ল্যাটের পজিশন বুঝিয়ে না দিয়ে প্রতারণা করে আসছে। এসব ভুয়া রিয়েল এস্টেট ও আবাসন কোম্পানিগুলো ধরতে মাঠে নামছে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ রাজউক। অনিবন্ধিত রিয়েল এস্টেট ডেভেলপার কোম্পানির সাথে চুক্তিবন্ধ না হওয়ার অনুরোধ জানিয়েছে রাজউক। ইতোমধ্যে বেশ কয়েকটি কোম্পানিকে চিঠি দিয়ে সর্তক করা হয়েছে।

এদিকে নির্ধারিত মূল্য পরিশোধ করা হাজারো ক্রেতা তাদের প্লট ও ফ্ল্যাট পেতে প্রধানমন্ত্রীসহ সরকারের উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন। তাদের দাবি, রাজউকসহ দেশের নগর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষগুলোর কাছে বর্তমানে হাজারো অভিযোগ রয়েছে। তবে তারা আইনের ফাঁক-ফোকর দেখিয়ে এসব নিষ্পত্তি এবং তাদের সম্পত্তি উদ্ধারে কোন পদক্ষেপ নিচ্ছে না।

রিহ্যাব সভাপতি শামসুল আলামিন ইনকিলাবকে বলেন, আবাসন ব্যবসায়ীদের দুটি সংগঠন রিহ্যাব ও বাংলাদেশ ল্যান্ড ডেভেলপার্স অ্যাসোসিয়েশন। দুটি সংগঠনই এসব অভিযোগের বিষয়গুলো দেখভাল করে। তাদের কাছে সুনির্দিষ্ট তথ্যসহ কোন অভিযোগ করা হলে কর্তৃপক্ষ অবশ্যই তদন্ত করে ব্যবস্থা নেবে। গত বছর কয়েকটি কোম্পানির সদস্যপদ বাতিল করা হয়।

রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান এ বি এম আমানুল্লাহ নুরী  জানান, এ ধরণের প্রতারণার অভিযোগ আসে শত শত। অনেক কোম্পানি আছে যাদের ক্রেতারা টাকা পরিশোধের পর ১০/১৫ বছরেও প্লট বা ফ্ল্যাট পাননি। তারা টাকাও তুলতে পারছেন না। এসব বন্ধ করতে রাজউক বিভিন্ন পদক্ষেপও নিয়েছে। কিন্তু তাতে তেমন সফলতা আসেনি।

তিনি বলেন, দায়িত্ব নেয়ার পর এবার নতুন উদ্যোগ নিয়েছেন। রাজউকের নিবন্ধিত নয় এমন ডেভেলপার কোম্পানির বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ইতোমধ্যে রাজউক একটি প্রচারণা কার্যক্রম শুরু করেছে। একটি বড় কোম্পানি রাজধানীর কেরাণীগঞ্জে কার্যক্রম চালিয়ে আসছে। সেটাকে নিবন্ধনের আওতায় আনা হচ্ছে। এছাড়া ড্যাপের এরিয়ার মধ্যে অনিবন্ধিত কোম্পানি কাজ করতে পারবে না।

রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) পরিচালক (উন্নয়ন নিয়ন্ত্রণ-১) প্রকৌশলী মো. মোবারক হোসেন স্বাক্ষরিত এক জরুরি বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, যথাযথ সময়ে ভবন নির্মাণ ও নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ এবং প্রতারণা থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য রাজউকের আওতাধীন এলাকায় ভবন নির্মাণে ইচ্ছুক সংশ্লিষ্টদের অনিবন্ধিত রিয়েল এস্টেট ডেভেলপার কোম্পানির সাথে চুক্তিবন্ধ না হওয়ার জন্য অনুরোধ করা যাচ্ছে। ভবন নির্মাণ চুক্তির সময় ডেভেলপার কোম্পানি রাজউকের নিবন্ধিত কি না এবং নিবন্ধন নবায়ন হালনাগদ কি না, তা যাচাই করে চুক্তি করার জন্য সংশ্লিষ্ট সকলকে অনুরোধ করা যাচ্ছে। যে সকল ডেভেলপার কোম্পানি রাজউকের নিবন্ধিত নয় বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় ও রাজউকে দেয়া লিখিত অভিযোগে বলা হয়েছে, রাজধানী, পার্শ্ববর্তী নারায়ণগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ, মানিকগঞ্জ ও গাজীপুরসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় বর্তমানে কয়েক হাজার রিয়েল এস্টেট ও আবাসন কোম্পানি গড়ে উঠেছে। শুধু এসব কোম্পানিই নয়, বর্তমানে ঢাকা ও এর আশেপাশে বেশ কিছু আবাসন ব্যবসায়ী ও ভূমি উন্নয়ন কোম্পানি গড়ে উঠেছে- যারা একই ধরণের প্রতারণার সঙ্গে জড়িত।

অভিযোগ রয়েছে এমন কোম্পানিগুলো হচ্ছে, ঢাকা- মাওয়া সড়ককের জম্মভূমি সিটি, নিকেতন সিটি, বাতায়ন সিটি, মদিনা ঝিলমিল রিভার ভিউ, মেরীল্যাণ্ড সিটি, স্বপ্নধারা রিয়েল এস্টেট, পদ্মা ফিউচার পার্ক, বিডি প্রোপার্টিজ, ডিভাইস সাউদ সিটি, আশালয় হাউজিং, চিয়ারফুল গ্রীণ সিটি, দিশারী গ্রুপ, ইউরো স্টার মডেল টাউন, সিলভার গ্রীণ সিটি, এশিয়ান টাউন, শান্তি নিবাস, আমেরিকান সিটি, অ্যারাবিয়ান সিটি, কানাডা সিটি, ফ্লোরিডা সিটি, সিডনি সিটি, প্রবাসী পল্লী, স্যাটেলাইট টাউন ও ইটালিয়ান সিটি।

এসব কোম্পানি এখনো চমকপ্রদ বিজ্ঞাপন দিয়ে মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করে চলেছে। উত্তরা পূর্ব এলাকায় সেবা আইডিয়াল অ্যান্ড লিভিং লিমিটেড নামে একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয়। আবাসন ব্যবসার আড়ালে এমএলএম ব্যবসার মাধ্যমে গ্রাহকদের সাথে প্রতারণা করে আসছিল একটি চক্র। রাজধানীর উত্তরা থেকে ওই চক্রের ৬ সদস্যকে গ্রেফতার করেছে সিআইডি।

সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ থেকে এসব কোম্পানির নিবন্ধনের বাধ্যবাধকতা থাকলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এগুলো শুধু কোম্পানি নিবন্ধন ও সিটি করপোরেশন বা পৌরসভা থেকে ট্রেড লাইসেন্স নিয়েই কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। ক্রেতাদের সুরক্ষা দিতে এগুলোর কোন জামানতও নেওয়া হয়না। এসব ভূমি উন্নয়ন ও আবাসন ব্যবসায়ীদের বেশিরভাগেরই নিজস্ব কোন জমি নেই। যেসব স্থানে তাদের সাইনবোর্ড লাগানো হয়েছে, সেখানে তাদের কোন জমি নেই।
ভুক্তভোগিরা জানান, প্লট বা ফ্ল্যাট না পেয়ে প্রশাসন ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দ্বারস্থ হয়েও কোন সুফল না পেয়ে প্রতারিত অনেক ক্রেতা চরম হতাশায় দিনাতিপাত করছেন। আইনগত সমস্যা দেখিয়ে আবাসন ব্যবসায়ীদের সংগঠন রিয়েল এস্টেট ও হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (রিহ্যাব) কোন ব্যবস্থা নিচ্ছে না।

মহসিন আলী, আতিকুর রহমান, মুজতবা খন্দকার ও নুরুল ইসলাম নামের তিন ক্রেতা মালিবাগের পিপলস ডেভেলপার লিমিটেড নামে একটি হাউজিং কোম্পানি থেকে প্লট কিনে গত ছয় বছরেও পজিশন পাননি। তারা অভিযোগ করেন, ওই প্রতিষ্ঠান থেকে জমি কেনার জন্য ২০১০ সালে চুক্তিবদ্ধ হন। চুক্তি অনুযায়ী ২০১০ সালে এসব প্লট বুঝিয়ে দেওয়ার কথা। কিন্তু কিস্তি পরিশোধ হওয়ার পর থেকেই কোম্পানির পক্ষ থেকে টালবাহানা শুরু করা হয়।

এক পর্যায়ে কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক নাজমুল হোসেন ও তার সহযোগী আব্দুল লতিফ তুষার গা-ঢাকা দেন। অফিস বন্ধ করে দেওয়ায় বর্তমানে তাদের কোন হদিসও পাওয়া যাচ্ছে না। তারা জানান, পিপলস ডেভেলপারের আশুলিয়া প্রকল্পে প্লট কিনে প্রতারিত হওয়া ক্রেতার সংখ্যা প্রায় ৩০০ বেশি। প্রতিষ্ঠানের কোন লোককে খুঁজে না পেয়ে বর্তমানে তারা চরম হতাশায় দিনযাপন করছেন। এ বিষয়ে কথা বলার জন্য নাজমুল ও তুষারের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাদের অফিসের বর্তমান ঠিকানা এবং কোন যোগাযোগের নম্বর পাওয়া যায়নি।

রাজধানীর ভাটারা এলাকার গৃহবধু জোসনা বেগম অভিযোগ করেন, তিনি তার ভগ্নিপতি রেজাউল করিমসহ ২০১২ সালে স্থানীয় গার্ডিয়ান রিয়েল এস্টেট থেকে একটি ফ্ল্যাট কেনেন। এজন্য তিনি কোম্পানিকে ২৪ লাখ টাকা পরিশোধ করেন। কিন্তু টাকা নেওয়ার পর কোম্পানির পরিচালক রেজাউল ইসলাম সোহেল (প্রকৃত নাম মোহাম্মদ আক্তার হোসেন) ফ্ল্যাট বুঝিয়ে দিতে টালবাহানা শুরু করেন। তিনি ছয় বছরেও তার ফ্ল্যাট বুঝে পাননি।

জাতীয়