রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির ৯ বছর

রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির ৯ বছর

৯ বছর আগে এই দিনে রানা প্লাজা ধস বাংলাদেশসহ গোটা দেশ বিশ্বকে নাড়িয়ে দিয়েছিল। সাভারে রানা প্লাজা ট্র্যাজেডিতে প্রাণ হারান ১ হাজার ১৩৬ জন। এই ঘটনা ঘটে ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল। রানা প্লাজা ধসের পর ৯ বছর পেরিয়ে গেছে, তবে এ ঘটনায় বিভিন্নভাবে দায়ীদের বিচারে অগ্রগতি খুব সামান্য। বাংলাদেশের ইতিহাসে এতজন শ্রমিকের মৃত্যুর ঘটনায় দায়ের করা হত্যা মামলার বিচার এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে রয়ে গেছে। মামলার ৫৯৪ জন সাক্ষীর মধ্যে মাত্র একজন সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহণ শেষ হয়েছে।

মামলার তদন্তে সময় গেছে দুই বছর। আনুষ্ঠানিক বিচার শুরু হতে (অভিযোগ গঠন) সময় লেগেছে আরও এক বছর। আর বিচার শুরুর আদেশকে চ্যালেঞ্জ করে সাত আসামি উচ্চ আদালতে গেলে তাঁদের পক্ষে মামলার কার্যক্রমে স্থগিতাদেশ আসে। ওই স্থগিতাদেশের কারণে পাঁচ বছর ধরে মামলার সাক্ষ্য গ্রহণ কার্যক্রম বন্ধ ছিল। তবে সম্প্রতি ছয়জনের পক্ষে স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার হয়েছে। চলতি বছরের ৩১ জানুয়ারি থেকে শুরু হয়েছে সাক্ষ্য গ্রহণ। ঢাকার জেলা ও দায়রা জজ এ এইচ এম হাবিবুর রহমান ভূঁইয়ার আদালতে মামলাটির সাক্ষ্য গ্রহণ চলছে।

ঢাকার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের অতিরিক্ত পাবলিক প্রসিকিউটর বিমল সমাদ্দার বলেন, নানাবিধ কারণে রানা প্লাজা ধসের ঘটনায় হত্যা মামলার বিচার বেশি দূর এগোয়নি। তবে এখন সাক্ষ্য গ্রহণ কার্যক্রম শুরু হয়েছে। মামলা দ্রুত নিষ্পত্তিতে রাষ্ট্রপক্ষে যা যা পদক্ষেপ দরকার, সেটি করা হচ্ছে।

রানা প্লাজা ধসে ১ হাজার ১৩৫ জন নিহত হওয়ার পাশাপাশি গুরুতর আহত হয়ে পঙ্গুত্ব বরণ করেন আরও ১ হাজার ১৬৯ জন। এ ঘটনায় মোট তিনটি মামলা হয়। এর মধ্যে অবহেলাজনিত মৃত্যু চিহ্নিত হত্যা মামলাটি করে পুলিশ। ইমারত নির্মাণ আইন লঙ্ঘন করে ভবন নির্মাণের অভিযোগে অপর মামলাটি করে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)। আর দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ভবন নির্মাণসংক্রান্ত দুর্নীতি নিয়ে আরেকটি মামলা করে। এই তিন মামলার কোনোটিরই বিচার শেষ হয়নি।

হত্যা মামলায় অভিযোগপত্রভুক্ত দুই আসামি মারা যাওয়ায় মামলা থেকে তাঁদের অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। মামলার বর্তমান আসামির সংখ্যা ৩৯। এর মধ্যে কারাগারে আছেন কেবল রানা প্লাজার মালিক সোহেল রানা। পলাতক সাতজন। জামিনে আছেন ৩১ জন আসামি। অবশ্য পাঁচ বছর আগে সম্পদের হিসাব না দেওয়ার মামলায় সোহেল রানার তিন বছর কারাদণ্ড দিয়েছিলেন আদালত।

রানা প্লাজা ধসে মৃত্যুর ঘটনায় দায়ের করা হত্যা মামলায় সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু হয়েছে। আর ইমারত আইনের মামলার বিচারে উচ্চ আদালতের স্থগিতাদেশ থাকলে সে ব্যাপারে রাষ্ট্রপক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

এ মামলার আসামিদের মধ্যে আছেন রানা প্লাজার মালিক সোহেল রানার বাবা আবদুল খালেক ও মা মর্জিনা বেগম, সাভার পৌরসভার সাবেক প্রকৌশলী রফিকুল ইসলাম, সাইট ইঞ্জিনিয়ার সরোয়ার কামাল, সাভার পৌরসভার তৎকালীন মেয়র রেফায়েত উল্লাহ, পৌরসভার তৎকালীন কাউন্সিলর মোহাম্মদ আলী খান, কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের চট্টগ্রাম বিভাগের তৎকালীন পরিদর্শক (প্রকৌশল) মো. ইউসুফ আলী, ঢাকা বিভাগের তৎকালীন পরিদর্শক (প্রকৌশল) মো. শহিদুল ইসলাম, সাবেক উপপ্রধান পরিদর্শক মো. আবদুস সামাদ এবং উপপ্রধান পরিদর্শক (সাধারণ, ঢাকা বিভাগ) মো. জামশেদুর রহমান প্রমুখ।

অভিযোগপত্রের তথ্য বলছে, ২০১৩ সালের ২৩ এপ্রিল সকাল সাড়ে ৯টায় সাভারের রানা প্লাজা ভবনের তৃতীয় তলায় পিলার ও দেয়ালে ফাটল দেখা দেয়। খবর পেয়ে পোশাক মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর কর্মকর্তারা রানা প্লাজা ভবনে যান। পোশাক কারখানার মালিকদের পরামর্শ দেন, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) ভবন বিশেষজ্ঞদের দিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা না করা পর্যন্ত সব কার্যক্রম বন্ধ রাখতে। কিন্তু পাঁচ পোশাক কারখানার মালিক ও তাঁদের লোকজন ভয়ভীতি দেখিয়ে পরদিন (২৪ এপ্রিল) শ্রমিকদের কাজে যোগ দিতে বাধ্য করেন। এর সঙ্গে যোগ দেন রানা প্লাজা ভবনের মালিক খালেক ও তাঁর ছেলে সোহেল রানা। সোহেল রানা সেদিন বলেছিলেন, ‘আগামী ১০০ বছরেও রানা প্লাজা ভেঙে পড়বে না।’

অভিযোগপত্রে বলা হয়, রানা প্লাজা তৈরির প্রতিটি ক্ষেত্রে অনিয়ম ও জালিয়াতির আশ্রয় নিয়েছিলেন ভবনটির মালিক ও তাঁর ছেলে, যা রানা প্লাজা ভবনকে একটি মৃত্যুকূপে পরিণত করে। এই ভবনে পাঁচটি পোশাক কারখানা ছিল। এসব কারখানায় বসানো হয় বৈদ্যুতিক ভারী জেনারেটর, ভারী সুইং মেশিন। রানা প্লাজা ধসের আগের দিন ভবনের তৃতীয় তলায় ফাটল দেখা দেয়। কিন্তু মালিকপক্ষ তাৎক্ষণিকভাবে ভবনটিকে পরিত্যক্ত ঘোষণা না করে পরদিন পাঁচটি পোশাক কারখানা চালু করে। ঘটনার দিন সকাল ৯টায় রানা প্লাজায় হঠাৎ বিদ্যুৎ চলে যায়। তখন একসঙ্গে পোশাক কারখানাগুলো তিনটি জেনারেটর চালু করে। ঠিক তখনই রানা প্লাজা ভবন বিকট শব্দ করে ধসে পড়ে।

ভবন নির্মাণে ত্রুটি ও নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহারের অভিযোগে করা ইমারত নির্মাণ আইনের মামলায় রানা প্লাজার সোহেল রানাসহ ১৮ জনের বিরুদ্ধে ২০১৫ সালের ২৬ এপ্রিল অভিযোগপত্র দেয় পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। পরের বছর (২০১৬ সাল) ১৪ জুন আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন ঢাকার চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট (সিজেএম) আদালত। তবে ওই আদেশকে চ্যালেঞ্জ করে কয়েকজন আসামি রিভিশন আবেদন করেন। সিজেএম আদালতের অতিরিক্ত পাবলিক প্রসিকিউটর আনোয়ারুল কবীর প্রথম আলোকে বলেন, অভিযোগ গঠনের আদেশ চ্যালেঞ্জ করে আসামিপক্ষ উচ্চ আদালতে গেলে গত বছরের ৮ নভেম্বর স্থগিতাদেশ আসে। স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার না হওয়ায় সাক্ষ্য গ্রহণ কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে।

এ ছাড়া রানা প্লাজা ভবন নির্মাণসংক্রান্ত দুর্নীতির মামলার সাক্ষ্য গ্রহণ কার্যক্রম চলছে ঢাকার বিভাগীয় বিশেষ জজ আদালতে। ২০১৭ সালের ২১ মে সোহেল রানাসহ ১০ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয়। এই মামলার সাক্ষ্য গ্রহণ কার্যক্রম এখনো শেষ হয়নি। মাত্র ১৪ জন সাক্ষীর সাক্ষ্য শেষ হয়েছে।

জাতীয়