নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির (এনএসইউ) বোর্ড অব ট্রাস্টির (বিওটি) কয়েক সদস্যের বিরুদ্ধে অনিয়ম-দুর্নীতির নানা অভিযোগ উঠেছে। এর মধ্যে ক্ষমতার অপব্যবহার, অতিরিক্ত টিউশন ফি আদায়, টিউশন ফির টাকায় গাড়ি কেনা এবং নিজেদের মালিকানাধীন ব্যাংকে বিশ^বিদ্যালয়ের অর্থ জমা রাখার মতো অভিযোগ রয়েছে।
সম্প্রতি দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) এসব অভিযোগ জমা পড়ে। অভিযোগ অনুসন্ধানে কমিশনের উপপরিচালক মোহাম্মদ ফয়সালকে অনুসন্ধান কর্মকর্তা ও পরিচালক সৈয়দ ইকবাল হোসেনকে তদারক কর্মকর্তা করে একটি কমিটি করা হয়।
পরবর্তী সময়ে অনুসন্ধান কর্মকর্তা পরিবর্তন করে দায়িত্ব দেওয়া হয় উপপরিচালক মো. ফরিদ উদ্দিন পাটোয়ারীকে।
দুদকের কমিটি গঠন সংক্রান্ত নোটিশে বলা হয়, ‘দেশের শীর্ষস্থানীয় বেসরকারি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে নানা ধরনের দুর্নীতি ও অনিয়ম চলছে। বিশ্ববিদ্যালয় ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্যদের বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত অর্থ আদায়, এফডিআর করার নামে প্রতিষ্ঠানের অর্থ লোপাট, স্ত্রীসহ স্বজনদের চাকরি দেওয়ার নমে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয়া, সরকারি শুল্ক ফাঁকি দিয়ে গাড়ি কেনা, অবৈধভাবে বিলাশবহুল গাড়ি ব্যবহার, কম মূল্যের জমি বেশি দামে কেনা, ডেভেলপার কোম্পানির কাছ থেকে কমিশন নেওয়া, লাখ টাকা করে সিটিং অ্যালাউন্স গ্রহণ, অনলাইনে মিটিং করে অ্যালাউন্স গ্রহণ ও বিভিন্ন অনৈতিক সুযোগসুবিধা গ্রহণের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানের অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ জমা পড়ে দুদকে।’
দুদক মহাপরিচালক (বিশেষ তদন্ত) সাঈদ মাহবুব খান জানান, জমি কেনার নামে ৩০৩ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে গত ৫ মে বিশ^বিদ্যালয়ের ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান আজিম উদ্দিনসহ ছয়জনের নামে মামলা হয়। মামলাটি করেছে দুদকের অনুসন্ধান কমিটি। এখন অন্যান্য অভিযোগের অনুসন্ধান চলছে।
দুদকের অনুসন্ধান টিমের তথ্য বলছে, জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ট্রাস্টি আজিম উদ্দিন আহমেদ, এম এ কাশেম, মোহাম্মদ শাহজাহান, রেহানা রহমান, বেনজির আহম্মেদ, আজিজ আল কায়সার টিটোকে দুদকে তলব করা হয়। কিন্তু রেহানা রহমান ছাড়া আর কেউ তলবে সাড়া দেননি।
জানা গেছে, ২০১৪ সালে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির তহবিল থেকে প্রায় ৫০০ কোটি টাকা ব্যয়ে একটি হাউজিং কোম্পানির কাছ থেকে জমি কেনা হয়। ওই জমি কেনা নিয়ে বিওটি সদস্যদের মধ্যে মতানৈক্য ছিল। এ নিয়ে বিওটির ওই সময়ের সদস্য ড. রওশন আলম আদালতে মামলা করেন। এছাড়া জমি কেনায় অনিয়ম নিয়ে ট্রাস্টি বোর্ডের দুই সদস্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে লিখিত অভিযোগ দেন। তাতে তারা উল্লেখ করেন, বোর্ডের অধিকাংশ সদস্যকে না জানিয়েই সভায় ৫০০ কোটি টাকায় জমি কেনার সিদ্ধান্ত হয়। দুদকের প্রাথমিক অনুসন্ধানে জমি কেনার নামে ৩০৩ কোটি ৮২ লাখ টাকা আত্মসাতের সত্যতা পাওয়ায় গত ৫ মে’র মামলা করা হয়।
এর আগেও প্রতিষ্ঠানটিতে কোষাধ্যক্ষ নিয়োগে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের নথি জাল করার অভিযোগ ওঠে। এ অভিযোগে ২০২০ সালের ৫ মে ছয়জনকে আসামি করে মামলা করে পুলিশ। পরবর্তী সময়ে মামলাটি তদন্তের দায়িত্ব পায় দুদক। তদন্ত শেষে গত ২৫ এপ্রিল দুদকের প্রধান কার্যালয় থেকে চার্জশিট অনুমোদন দেওয়া হয়। চার্জশিটে বিশ^বিদ্যালয়ের ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য মো. শাহজাহান, ছাত্রলীগের বহিষ্কৃত সহসভাপতি তরিকুল ইসলাম মুমিন, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সাবেক ব্যক্তিগত কর্মকর্তা মো. নাজিম উদ্দিন, ডেসপাচ রাইডার মো. রুবেল, এয়ার কমোডর (অবসরপ্রাপ্ত) এম আব্দুস সামাদ আজাদ, ছাত্রলীগ নেতা মো. ফরহাদ হোসেন ওরফে মোরশেদ আলম ওরফে মিকি এবং প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সাবেক অফিস সহায়ক ফাতেমা খাতুন ও তার ছেলে রবিউল আওয়ালসহ আটজনকে আসামি করা হয়। শিগগিরই সংস্থাটির উপ-পরিচালক মো. ফরিদ আহমেদ পাটোয়ারি আদালতে চার্জশিট দাখিল করবেন।
দুদকের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা আমাদের সময়কে বলেন, অভিযোগের বিষয়ে কয়েকজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে।
দুদকের টেবিলে থাকা অভিযোগ সূত্রে জানা গেছে, আজিম উদ্দিন আহমেদ এবং এম এ কাসেম সিন্ডিকেট দীর্ঘদিন ধরে প্রতিষ্ঠানটি লুটেপুটে খাচ্ছেন। এই সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে বিশ^বিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) নির্দেশনা অমান্য করে কয়েকগুণ শিক্ষার্থী ভর্তি ও একটির অনুমতি নিয়ে একাধিক প্রোগ্রাম পরিচালনার অভিযোগ রয়েছে। গত ছয়-সাত বছরে এসব অভিযোগ একাধিকবার তদন্ত করে ইউজিসি। এখন এসব অভিযোগ দুদকে এসেছে।
অভিযোগে আরও বলা হয়, টিউশন ফির টাকায় ২০১৯ সালের জুনে বিলাসবহুল আটটি রেঞ্জ রোভার ও একটি মার্সিডিজ বেঞ্জ গাড়ি কেনা হয়। রেঞ্জ রোভার ২০১৯ মডেলের প্রতিটি গাড়ির ব্যয় দেখানো হয় প্রায় তিন কোটি টাকা। এসব গাড়ি ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্যরা ব্যবহার করছেন। গাড়িগুলো কেনার সময় বিওটির চেয়ারম্যান ছিলেন এমএ কাসেম। তিনি এখন পর্যন্ত চারবার বিওটির চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন। চারবার চেয়ারম্যানের দায়িত্বে ছিলের অপর সদস্য আজিম উদ্দিন আহমেদও।
অভিযোগে বলা হয়, শিক্ষার্থীদের টিউশন ফি থেকে প্রতি বছর এনএসইউ’র আয় প্রায় ৫০০ কোটি টাকা। বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনায় এর অর্ধেকও খরচ হয় না। এনএসইউ’র বার্ষিক অনুন্নয়ন ও উন্নয়ন ব্যয়ের পরিমাণ ২৫০ কোটির কম। প্রতি বছর বেঁচে যাওয়া বড় অংকের এ অর্থ যুক্ত হচ্ছে নর্থ সাউথের তহবিলে। উদ্বৃত্ত অর্থে ক্রমেই ফুলেফেঁপে উঠছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটির তহবিল।
অভিযোগে আরও বলা হয়, বর্তমানে তহবিলে প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা আছে। ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যানের দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিরা এই অর্থ তাদের নিজেদের পছন্দের এবং স্বার্থসংশ্লিষ্ট ব্যাংক কিংবা আর্থিক প্রতিষ্ঠানে জমা রাখেন। যদিও স্বার্থের সংঘাতজনিত অভিযোগ উঠতে পারে এমন কোনো কর্মকা- পরিচালনা না করার বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় ট্রাস্টিদের প্রতি নির্দেশনা রয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের। শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও ইউজিসির তথ্যমতে, দেশের আর কোনো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের তহবিলে এত অর্থ নেই। এমনকি আয়ের পরিমাণ ও উদ্বৃত্ত তহবিলের দিক থেকে এনএসইউ এখন দেশের অনেক বড় ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানকেও ছাড়িয়ে গেছে।
জানা গেছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় ৪০০ কোটি টাকা ট্রাস্ট্রিদের মালিকাধীন ব্যাংকে জমা রাখা হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি অর্থ আছে সাউথইস্ট ব্যাংকে। এ ব্যাংকের বসুন্ধরা শাখায় মেয়াদি আমানত হিসেবে জমা আছে ৩৪৭ কোটি টাকা। সাউথইস্ট ব্যাংকের উদ্যোক্তা পরিচালকদের অনেকেইে নর্থ সাউথের ট্রাস্টি। ট্রাস্টির বর্তমান চেয়ারম্যান আজিম উদ্দিন আহমেদ সাউথইস্ট ব্যাংকের উদ্যোক্তা পরিচালক। এছাড়া ব্যাংকটির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান এমএ কাশেমও ট্রাস্টি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। এ কারণে প্রতিষ্ঠানটির বেশি অর্থ ওই ব্যাংকে রাখা হয়েছে। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়টির অর্থ আমানত হিসেবে জমা রাখা হয়েছে দ্য সিটি ব্যাংক ও ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক (ইউসিবি) লিমিটেডে। পিকে হালদারের লুটপাটের শিকার আর্থিক প্রতিষ্ঠানেও শিক্ষার্থীদের টিউশন ফি’র ১০ কোটি টাকার বেশি জমা রাখা হয়েছে। এই টাকা দীর্ঘদিন চেষ্টা করেও ফেরত পাচ্ছে না বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।
অভিযোগে বলা হয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের তহবিল থেকে নিজেদের ইচ্ছামতো অর্থ ব্যয় করছে ট্রাস্টি বোর্ড। বিভিন্ন অপ্রয়োজনীয় কমিটির সভা ডেকে বড় অংকের সিটিং অ্যালাউন্স নেন ট্রাস্টিরা। সভা ভেদে সিটিং অ্যালাউন্স হিসেবে সদস্যদের কেউ কেউ ৫০ হাজার টাকাও নিচ্ছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। নিজেদের ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে কেনাকাটা কিংবা সেবার নামে মোটা অংকের অর্থ বের করে নেওয়ার অভিযোগ আছে কয়েকজন ট্রাস্টির বিরুদ্ধে। এমনকি স্ত্রীসহ স্বজনদের নামমাত্র নিয়োগ দিয়ে তাদের বেতন-ভাতা বাবদও লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ আছে।
দুদকের তথ্যমতে, ইউজিসির তদন্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী, বোর্ডের সদস্যরা অস্বাভাবিক হারে সিটিং অ্যালাউন্স নেন। একটা সময়ে বিওটির প্রতি বৈঠকের জন্য এক লাখ আর অন্য সব কমিটির বৈঠক প্রতি ৫০ হাজার টাকা করে নেওয়া হতো। মন্ত্রণালয় ও ইউজিসি থেকে চাপ তৈরির পর উভয় ক্ষেত্রে ৫০ শতাংশ কমানো হয়। একটি বৈঠকে উপস্থিত হওয়ার জন্য ৫০ বা ২৫ হাজার টাকা নেওয়ার বিষয়েও প্রশ্ন উঠেছে। এক মাসে এমন একাধিক বৈঠক করা হয়েছে। অভিযোগ আছে, সিটিং অ্যালাউন্স বাণিজ্যের লোভেই আইনের ব্যত্যয় ঘটিয়ে ২০টির বেশি কমিটি গঠন করা হয়। ইউজিসির প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, বিওটির সদস্যরা বিভিন্ন সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের বৈঠক আর চুক্তি স্বাক্ষরের জন্য যুক্তরাষ্ট্র ও অস্ট্রেলিয়ায় যান। এর খরচ জোগানো হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের তহবিল থেকে। এটা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইনের পরিপন্থী। এছাড়া বিভিন্ন প্রোগ্রামে বিওটির সদস্য ও উপাচার্যের কোটায় ছাত্রছাত্রী ভর্তি নিয়ে বাণিজ্যের অভিযোগ বহু দিন ধরেই।
অভিযোগ রয়েছে, ইউজিসি থেকে শুধু বিবিএ প্রোগ্রাম অনুমোদন নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু বিবিএ ইন ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস, বিবিএ ইন মার্কেটিং, বিবিএ ইন ম্যানেজমেন্ট, বিবিএ ইন ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেমস, বিবিএ ইন অ্যাকাউন্টিং, বিবিএ ইন ইকনোমিক্স, বিবিএ ইন এন্টারপ্রেনারশিপ, বিবিএ ইন সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্ট প্রোগ্রাম পরিচালনা করা হচ্ছে। এছাড়া প্রতি সেমিস্টারে শুধু বিবিএতে ৫০ জন ভর্তির অনুমোদন থাকলেও সেখানে ভর্তি করা হয়েছে অনেক বেশি।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে গত দুইদিন ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান আজিম উদ্দিন আহমেদের মুঠোফোনে একাধিকবার ফোন করা হয়। প্রতিবারই তার ফোন বন্ধ পাওয়া যায়।
চেয়ারম্যানসহ ছয়জনের বিচার দাবি বোর্ড অব ট্রাস্টিজের চেয়ারম্যান আজিম উদ্দিন, সদস্য এমএ কাসেমসহ ছয়জনকে গ্রেপ্তার ও তাদের বিচার দাবি করেছে ‘আইন ও মানবাধিকার সুরক্ষা ফাউন্ডেশন’। গতকাল ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে এক সংবাদ সম্মেলনে সংগঠনটির উপদেষ্টা ড. সুফী সাগর সামস এ দাবি জানান। এ সময় আইন ও মানবাধিকার সুরক্ষা ফাউন্ডেশনের নেতারা উপস্থিত ছিলেন।
সংবাদ সম্মেলনে ড. সুফী সাগর বলেন, ‘আজিম-কাসেম সিন্ডিকেটের কারণেই এনএসইউ পরিণত হয়েছে দুর্নীতি-অনিয়ম ও জঙ্গিবাদের অভয়ারণ্যে। তাই এদের বিরুদ্ধে দুদকের মামলা করার বিষয়টি প্রশংসনীয়। কিন্তু খেয়াল রাখতে হবে, অভিযুক্ত প্রত্যেকেই সমাজের প্রভাবশালী এবং ক্ষমতাধর ব্যক্তি। তাই তাদের কেউ যেন আইনের ফাঁক গলিয়ে বেরিয়ে যেতে না পারে। অভিযুক্তদের বিচারের বিষয়টি দ্রুত সুরাহা করতে হবে।’ তবে ট্রাস্টি সদস্য আজিজ আল কায়সার টিটুর নাম বাদ পড়ায় তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করেন।