মামলায় আসামি করা হয়েছে সাব-কন্ট্রাক্টর ও মেসার্স জাকির এন্টারপ্রাইজের মালিক মো. জাকির হোসেন, মূল ঠিকাদার মেসার্স রানা বিল্ডার্স প্রাইভেট লিমিটেডের মালিক মোহাম্মদ আলম, মেসার্স এসএ ট্রেডিং করপোরেশনের মালিক সালেহ আহমেদ, ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকের ফার্স্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট ও ব্যাংকটির কুমিল্লা শাখার সাবেক হেড অব ব্রাঞ্চ মোহাম্মদ সারোয়ার আলম, অ্যাসিস্ট্যান্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট মো. আনিসুজ্জামান, ফার্স্ট অ্যাসিস্ট্যান্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট সাইফুল আলম মজুমদার, সিনিয়র এক্সিকিউটিভ অফিসার মাহমুদুল ইসলাম আরেফিন এবং ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক লিমিটেডের সিনিয়র এক্সিকিউটিভ অফিসার দেবু বোশকে।
এজাহারে বলা হয়েছে, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের ‘ইমপ্রুভমেন্ট অব পোর্ট কানেক্টিং রোড’ প্রকল্পটি বাস্তবায়নের জন্য ৫০ কোটি ৮৪ লাখ ৭০ হাজার ৪৭৩ টাকা সর্বনিন্ম দরদাতা রানা বিল্ডার্স-ছালেহ আহমেদ (জেভি)-কে ২০১৭ সালের ১৬ নভেম্বর কার্যাদেশ দেয়া হয়। সে অনুযায়ী ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের মালিক মোহাম্মদ আলম সিটি করপোরেশনের সঙ্গে চুক্তিপত্রে স্বাক্ষর করেন।
এরপর মোহাম্মদ আলম দরপত্রের শর্ত ভঙ্গ করে অবৈধভাবে নোটারি পাবলিকের মাধ্যমে এক হাজার টাকার নন-জুডিশিয়াল স্ট্যাম্পে আমমোক্তারনামার মাধ্যমে ২০১৮ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি কাজটি বাস্তবায়নের জন্য মো. জাকির হোসেনকে আমমোক্তার নিয়োগ করেন। জাকির হোসেন ওই আমমোক্তারনামা ব্যবহার করে মিথ্যা পরিচয়ে ‘রানা বিল্ডার্স-ছালেহ আহমেদ (জেভি)’-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) হিসেবে ভুয়া সিল ও স্বাক্ষর ব্যবহার করে ইউসিবিএলের কুমিল্লা শাখায় হিসাব খোলেন। আমমোক্তারনামা, মিথ্যা পরিচয় ও স্বাক্ষর যাচাই না করেই ব্যাংক কর্মকর্তারা তাকে সহায়তা করেন।
ঠিকাদার মোহাম্মদ আলম চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের প্রকল্পের কার্যাদেশপ্রাপ্ত হয়ে চুক্তিপত্র বা দরপত্রের শর্ত ভঙ্গ করেছেন এবং মো. জাকির হোসেনকে অবৈধভাবে কাজ বাস্তবায়নের জন্য সার্বিক দায়দায়িত্ব হস্তান্তর করেছেন। যেখানে চুক্তিপত্র অনুযায়ী কাজটি সম্পাদন না করে অসমাপ্ত অবস্থায় ফেলে রেখে চরম গণভোগান্তি সৃষ্টি করেছেন। পাশাপাশি সরকারের দুই কোটি ৭৬ লাখ ৩৮ হাজার টাকার আর্থিক ক্ষতিসাধন করেছেন।
অন্যদিকে মো. জাকির হোসেন অন্যান্য আসামির সঙ্গে পরস্পর যোগসাজশে অবৈধভাবে আমমোক্তার নিয়োগপ্রাপ্ত হয়ে নিজের পরিচয় গোপন করে রানা বিল্ডার্স-ছালেহ আহমেদ (জেভি)-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে ভুয়া সিল ও স্বাক্ষর দিয়ে ইউসিবিএল, কুমিল্লা শাখায় হিসাব খুলে ২০ কোটি টাকা এবং নিজ প্রতিষ্ঠানের নামে আরও ২০ কোটি টাকার ঋণ নিয়েছেন। সুদের আংশিক পরিশোধ করলেও মূল টাকা পরিশোধ না করে সমুদয় অর্থ আত্মসাৎ করেছেন।
ব্যাংক কর্মকর্তা মোহাম্মদ সরোয়ার আলম, মো. আনিসুজ্জামান, সাইফুল আলম মজুমদার, মাহমুদুল ইসলাম ও দেবু বোশ লাভবান হওয়ার জন্য অবৈধ আমমোক্তারনামা, মিথ্যা পরিচয় ও স্বাক্ষর যাচাই বা নিশ্চিত না হয়েই ব্যাংকের নিয়মনীতি লঙ্ঘন করে হিসাব খোলেন এবং অপর্যাপ্ত সম্পদ বন্ধক (মর্টগেজ) রেখে মোট ৪০ কোটি টাকার ঋণ দেন। আসামিদের বিরুদ্ধে দণ্ডবিধি ৪০৯/৪২০/১০৯ এবং দুর্নীতি প্রতিরোধ আইন, ১৯৪৭-এর ৫(২) ধারায় অভিযোগ আনা হয়েছে।
অনুসন্ধানে ব্যাংকটির অ্যাসিস্ট্যান্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট মো. আনিসুজ্জামান ও তৎকালীন হেড অব ব্রাঞ্চ মোহাম্মদ সরোয়ার আলমের অবহেলার প্রমাণ পাওয়া যায়। এছাড়া মো. জাকির হোসেন একই নথিপত্র ব্যবহার করে নিজ প্রতিষ্ঠান মেসার্স জাকির এন্টারপ্রাইজের নামে আরও একটি লোন হিসাব খোলেন।
জাকির হোসেন রানা বিল্ডার্স-ছালেহ আহমেদ (জেভি) নামীয় কার্যাদেশের বিপরীতে ঋণ আবেদন করলে ২০১৮ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি ইউসিবিএল থেকে ৯০ দিনের জন্য সাড়ে তিন কোটি টাকার ঋণ মঞ্জুর করা হয়, যা পরে ২০ মাসের মেয়াদে ঋণসীমা ১২ কোটি টাকায় উন্নীত করা হয়। এরপর ধাপে ধাপে মোট ২০ কোটি টাকা ঋণ মঞ্জুর করিয়ে নেন জাকির হোসেন। অনুরূপভাবে মেসার্স জাকির এন্টারপ্রাইজের নামের একই প্রক্রিয়ায় অন্য হিসাবে আরও ২০ কোটি টাকার ঋণ মঞ্জুর করা হয়।
মোট ৪০ কোটি টাকার ঋণ ছাড় করা হলেও বিপরীতে জাকির হোসেন সামান্য সম্পত্তি বন্ধক রাখেন, যার মধ্যে রয়েছে কুমিল্লায় তিন শতক জমির ওপর পাঁচতলা ভবন, যার বাজারমূল্য এক কোটি ৯০ লাখ টাকা। এছাড়া বুড়িচং উপজেলার শরীয়তপুর মৈাজার ৮১ শতাংশ জমি, যার বাজারমূল্য ৬০ লাখ টাকা; বুড়িচং উপজেলার উত্তর বিজয়পুর মৌজার ২৫ শতাংশ জমি, যার বাজারমূল্য ৮৮ লাখ টাকা; কুমিল্লা শহরে ১৩ শতক ও এক হাজার ২৩৫ বর্গফুটের দুটি ফ্ল্যাট, যার বাজারমূল্য এক দশমিক ৫৮ কোটি টাকা। অর্থাৎ মোট চার কোটি ৯৬ লাখ টাকার সম্পত্তি বন্ধক রাখেন জাকির হোসেন।
২০২১ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট, জাইকার কনসালটেন্ট ও এলজিইডির প্রকৌশলীদের উপস্থিতিতে যৌথভাবে প্রকল্পটির কাজ সরেজমিনে পরিমাপ করা হয়। পরিমাপের পর মোট ৩৫ কোটি এক লাখ ৩৩ হাজার ৫৫৭ টাকার কাজ পাওয়া যায়। অবশিষ্ট ১৫ কোটি ৮৩ লাখ ৩৬ হাজার ৯১৬ টাকার কাজ শেষ করার জন্য নতুন করে দরপত্র আহ্বান করে ২০ কোটি ৯ লাখ ৩৬ হাজার ১০৫ টাকার কার্যাদেশ দেয়া হয়। নতুন দরপত্র অনুযায়ী দুই কোটি ৭৬ লাখ ৩৮ হাজার টাকার আর্থিক ক্ষতি হয়েছে বলে দুদকের অনুসন্ধানে প্রমাণ পাওয়া যায়।