রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে আঘাত হেনেছে প্রচণ্ড কালবৈশাখী ঝড়। সেইসঙ্গে হয়েছে মাঝারি ধরণের বৃষ্টিও। এতে করে সারাদেশের তাপমাত্রা ২ থেকে ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত কমে এসেছে। কমেছে বাতাসের আর্দ্রতাও। এইসঙ্গে দুটি জেলায় বয়ে যাওয়া তাপপ্রবাহও দূর হয়েছে। তবে ঝড়ের ছোবলে দেশের বহু এলাকা লণ্ডভণ্ড হয়েছে এবং চার জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে।
শনিবার (২১ মে) সন্ধ্যায় আবহাওয়া অধিদফত এ তথ্য জানায়।
অধিদফতর জানায়, শনিবার (২১ মে) ভোরে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে কালবৈশাখী ঝড় ও বৃষ্টি হয়েছে। তীব্র ঝড়ে কোথাও কোথাও গাছসহ বিভিন্ন স্থাপনা ভেঙে পড়েছে। ভোর ছয়টার কিছু আগে ঢাকায় শুরু হয় তীব্র কালবৈশাখী। কিছুক্ষণ ঝড়ের পর শুরু হয় বৃষ্টি। সকাল ৯টা পর্যন্ত গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি হয়েছে। এরপর ধীরে ধীরে মেঘ কেটে গিয়ে দেখা মেলে সূর্যের। শুক্রবার সন্ধ্যা ৬টা থেকে শনিবার সকাল ৬টা পর্যন্ত দেশের সব বিভাগেই বৃষ্টি হয়েছে। এ সময়ে সবচেয়ে সবচেয়ে বেশি ৬৫ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে নীলফামারীর ডিমলায়। এ সময় ঢাকায় হয়েছে ৪২ মিলিমিটার বৃষ্টি।
আমাদের বগুড়ার স্টাফ রিপোর্টার জানান, শনিবার ভোরের কালবৈশাখী ঝড়ে জেলায় দেয়াল ও গাছ চাপায় দুই উপজেলায় দুই ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে। এদের মধ্যে একজন কাহালুতে নিজ ঘরে দেয়াল চাপায় মারা গেছেন। অন্যজন শাজাহানপুর উপজেলায় ঝড়ে ভেঙে পড়া গাছ সরাতে গিয়ে আহত হন। পরে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়। নিহতরা হলেন- কাহালু উপজেলার মাছপাড়া গ্রামের দিনমজুর শাহিন (৪৫) এবং শাজাহানপুর উপজেলার কুষ্টিয়া গ্রামের আব্দুল হালিম (৫১)।
ঝিনাইদহ সংবাদদাতা জানান, জেলায় শনিবার সকালে হঠাৎ বজ্রবৃষ্টি ও কালবৈশাখী ঝড় আঘাত হানে। সেসময় বজ্রপাতে শৈলকুপা উপজেলার কুলচারা গ্রামে রুপা বেগম (৩৫) নামে এক নারীর মৃত্যু হয়েছে। ঝিনাইদহ সদর উপজেলার ডেফলবাড়ি গ্রামে এক কৃষকের ২টি মহিষ বজ্রপাতে মারা গেছে। কালবৈশাখী ঝড়ে কালীগঞ্জ উপজেলার ৩টি ইউনিয়ন ও হরিণাকুণ্ডু উপজেলার ১টি ইউনিয়নের বেশ কয়েকটি গ্রামের বাড়ি-ঘর ও মাঠের ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে।
বরিশাল প্রতিনিধি জানান, মেহেন্দীগঞ্জে গজারিয়া নদীতে শনিবার সকালে ঝড়ের কবলে পড়ে নৌকাডুবে শামসুল হক আকন (৫০) নামে এক জেলে মারা গেছেন। মেহেন্দিগঞ্জের গজারিয়া নদীর চরএকরিয়া ও জয়নগর এলাকার মাঝামাঝি স্থানে শনিবার ভোরে ঝড়ের কবলে পড়ে জেলেনৌকাটি ডুবে যায়। বেলা ১১টার দিকে স্থানীয়রা লাশটি ভাসতে দেখে উদ্ধার করে। পরে তারা থানায় জানালে পুলিশ এসে লাশটি উদ্ধার করে পরিবারের কাছে হস্তান্তর করে।
আমাদের কুষ্টিয়ার স্টাফ রিপোর্টার জানান, কালবৈশাখী ঝড় ও বৃষ্টিতে লণ্ডভণ্ড হয়ে গেছে আম, লিচুসহ মৌসুমি ফলের বাগান। উড়ে গেছে শত শত ঘরের টিনের চালা। উপড়ে গেছে অনেক গাছ। গাছের ডাল পড়ে তার ছিঁড়ে অনেক স্থানে বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। শনিবার (২১ মে) সকাল থেকে ঝড় শুরু হয়ে প্রায় ২০ থেকে ২৫ মিনিট স্থায়ী ছিল।
সরেজমিনে দেখা যায়, জেলার বিভিন্ন উপজেলায় ঝড়ের তাণ্ডবে শত শত গাছপালা ভেঙে রাস্তায় পড়ে আছে। শত শত হেক্টর জমির আম, কাঁঠাল, লিচুসহ বিভিন্ন মৌসুমি ফল ও ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। বিভিন্ন এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ রয়েছে।
নওগাঁ প্রতিনিধি জানান, জেলার ধামইরহাটে শনিবার ভোরের কালবৈশেখী ঝড় ও ব্যাপক বৃষ্টিপাতের ফলে মাঠের ধান, ঘর-বাড়ি, আম-লিচর বাগানু, শাকসবজি ও কলার বাগানসহ গাছপালার ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। উপজেলার আলমপুর ইউনিয়ন, ইসবপুর, খেলনা, উমার, আগ্রাদ্বিগুন, জাহানপুর ও ধামইরহাট সদর ইউনিয়নে সড়কের ধারে লাগানো অসংখ্য গাছপালা ভেঙ্গে সড়কের আশেপাশের ধানক্ষেতে পড়ে যাওয়াসহ মাটির দেয়াল ও টিনশেডের ঘরের টিন দুমড়ে-মুচড়ে সড়কের আশেপাশে গাছের ডালে ঝুলে থাকতে দেখা গেছে। এছাড়াও কোথাও কোথাও গাছের ডাল ভেঙ্গে বিদ্যুতের সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে।
নওগাঁর রাণীনগর উপজেলা প্রনিনিধি জানান, ঝড়ের ব্যাপক তাণ্ডবে লন্ডভন্ড হয়ে গেছে উপজেলার প্রায় শতাধিক ঘর বাড়ি। গত দুই রাতে উপজেলার কামতা, হাড়াইল, শংঙ্করপুর ও খট্টেশ্বর গ্রামসহ বেশ কয়েকটি গ্রামে এসব ঘর বাড়ি ঝড়ে বিধ্বস্ত হয়।
ভোলা সংবাদদাতা জানান, শনিবার ভোরে জেলায় কালবৈশাখী ঝড়ে একটি বালুবোঝাই বাল্কহেড ডুবে গেছে। এ সময় তিনটি দোকান দুমড়েমুচড়ে যায়। সকালে সদর উপজেলার ধনিয়া তুলাতুলী মাছঘাট এলাকায় মেঘনা নদীতে এ ঘটনা ঘটে। এতে হতাহতের কোনো খবর পাওয়া যায়নি। স্থানীয়রা জানায়- ভোর থেকে গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি হচ্ছিল। সকাল সাড়ে ৭টার দিকে হঠাৎ নদী উত্তাল হয়ে ওঠে। এক পর্যায়ে ঝড়ের কবলে পড়ে নদীতে থাকা এমভি তামিম-শামিম নামে একটি বালুবোঝাই বাল্কহেড ডুবে যায়। এ সময় বাল্কহেডে থাকা ছয়জনকে উদ্ধার করা হয়।
হাতিয়া প্রতিনিধি জানান, নোয়াখালীর দ্বীপ উপজেলা হাতিয়ায় কালবৈশাখী ঝড়ে একটি মসজিদসহ তিনটি গ্রামের প্রায় ২৫টি ঘরবাড়ী বিধ্বস্ত হয়েছে। শনিবার সকালের ঝড়ে উপজেলার জাহাজমারা, সুখচর ও নলচিরা ইউনিয়নের তিনটি গ্রামে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে। তবে এসময় সবাই ঘরের বাহিরে বের হয়ে যাওয়ায় কোনো হতাহতের ঘটনা ঘটেনি।
মাগুরার শালিখা প্রতিনিধি জানান, কালবৈশাখী ঝড়ে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নে। সাময়ীকভাবে বন্ধ হয়ে গেছে অনেক স্থানের সড়ক যোগাযোগ ও বিদ্যুৎ সংযোগ। শনিবার সকাল সাড়ে ৫টার দিকে মাত্র ৫ মিনিটের কালবৈশাখীর ঝড়ে এ ঘটনা ঘটে। উপজেলার আড়পাড়াসহ বিভিন্ন এলাকায় গাছপালা উপড়ে পড়েছে। আবার কিছু কিছু এলাকায় ঘরের টিন দুমড়ে মুচড়ে ফেলেছে। এদিকে কাল বৈশাখী ঝড়ে বিভিন্ন গ্রামে পল্লী বিদ্যুতের ১১টি খুটি সম্পূর্ণ উপড়ে পড়েছে।
এদিকে, আবহাওয়াবিদ মো. মনোয়ার হোসেন জানান, শনিবার সন্ধ্যা ৬টা থেকে রোববার সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত রংপুর, রাজশাহী, ঢাকা, ময়মনসিংহ, সিলেট ও চট্টগ্রাম বিভাগের অনেক জায়গায় এবং খুলনা ও বরিশাল বিভাগের কিছু কিছু জায়গায় অস্থায়ীভাবে দমকা বা ঝোড়ো হাওয়ার সঙ্গে প্রবল বিজলি চমকানোসহ বৃষ্টি বা বজ্রসহ বৃষ্টি হতে পারে। একইসঙ্গে দেশের কোথাও কোথাও মাঝারি ধরনের ভারী থেকে ভারী বর্ষণ হতে পারে।
যশোর ও সাতক্ষীরা জেলার ওপর দিয়ে গত দুই দিন ধরে বয়ে চলা মৃদু তাপপ্রবাহ প্রশমিত হতে পারে জানিয়ে তিনি বলেন, রোববার সারাদেশে দিনের তাপমাত্রা ১ থেকে ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস কমতে পারে ও রাতের তাপমাত্রা প্রায় অপরিবর্তিত থাকতে পারে। ঝড়-বৃষ্টির এ প্রবণতা মঙ্গলবার পর্যন্ত অব্যাহত থাকতে পারে। ঢাকায় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা এক দিনের ব্যবধানে ৩ ডিগ্রি কমে শনিবার ছিল ৩২ দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আদ্রতার কারণে শুক্রবার ঢাকার অনুভূত তাপমাত্রা ছিলো ৪০ ডিগ্রির কাছাকাছি। তা একদিনের ব্যবধানে ৭ ডিগ্রি কমে শনিবার অনুভূত হয়েছে ৩৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
আবহাওয়া অধিদফতর জানিয়েছে, আন্দামান সাগর ও তৎসংলগ্ন মায়ানমারে সৃষ্ট লঘুচাপটি ঘনীভূত হয়ে প্রথমে সুস্পষ্ট লঘুচাপ এবং পরে নিম্নচাপে পরিণত হয়। এরপর এটি দুর্বল হয়ে আবার সুস্পষ্ট লঘুচাপ আকারে বর্তমানে থাইল্যান্ড এবং তৎসংলগ্ন মিয়ানমার এলাকায় অবস্থান করছে। লঘুচাপের বর্ধিতাংশ ভারতের বিহার, পশ্চিমবঙ্গ এবং বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চল হয়ে উত্তর বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত রয়েছে।
শনিবার সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত দেশের অভ্যন্তরীণ নদীবন্দরগুলোর জন্য আবহাওয়ার পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, নোয়াখালী, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার অঞ্চলের ওপর দিয়ে পশ্চিম বা উত্তর-পশ্চিম দিক থেকে ঘণ্টায় ৬০ থেকে ৮০ কিলোমিটার বেগে দমকা বা ঝোড়ো হাওয়াসহ অস্থায়ীভাবে বৃষ্টি বা বজ্রসহ বৃষ্টি হতে পারে। এসব এলাকার নৌবন্দরগুলোকে ২ নম্বর নৌ হুঁশিয়ারি সংকেত দেখাতে বলা হয়েছে। দেশের অন্যত্রও পশ্চিম বা উত্তর-পশ্চিম দিক থেকে ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ৬০ কিলোমিটার বেগে দমকা বা ঝোড়ো হাওয়াসহ অস্থায়ীভাবে বৃষ্টি বা বজ্রসহ বৃষ্টি হতে পারে। এসব এলাকার নৌবন্দরগুলোকে ১ নম্বর সতর্ক সংকেত দেখাতে বলেছে আবহাওয়া অফিস।