বিশেষ প্রতিনিধি ও নিজস্ব প্রতিবেদক
রাজধানীর একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন রফিকুল ইসলাম। দুই সন্তান-স্ত্রীসহ পাঁচজনের পরিবার। নিজের ২৫ হাজার ও স্ত্রীর ১৫ হাজার টাকাসহ মাসিক আয় ৪০ হাজার টাকা। ১০ হাজার টাকায় খিলগাঁওয়ের বাগিচা এলাকায় একটি বাসায় ভাড়া থাকেন। বুয়ার বেতন, ময়লার বিল, বিদ্যুৎ বিল ও বাসা ভাড়া মিলিয়ে ১৫ হাজার টাকা চলে যায়। বাচ্চাদের স্কুল ও পড়ালেখার খরচ ১০ হাজার টাকা। ৫ হাজার টাকা নিজের হাত খরচ। বাকি টাকা বাজার ও অন্যান্য প্রয়োজনে ব্যয় করেন। সাধারণত শনিবার রফিক দম্পতি বাজার করেন। কারণ শুক্রবার বেশিরভাগ মানুষ বাজার করে তাই দাম একটু চড়া থাকে। গতকাল শনিবার দাম কম পাওয়ার আশায় কারওয়ান বাজারে এসে হতাশায় ভেঙে পড়েন তারা।
রফিকুল ইসলাম এ প্রতিবেদককে বাজারের ব্যাগ দেখিয়ে বলেন, ‘দ্যাখেন, মনে হয় সোনা কিনতে এসেছি। মসুরের ডালের দাম বাড়তি দেখে অ্যাংকর ডাল কিনতে গেলাম। গত মাসে কিনেছি ৪৫ টাকায়; এখন বলছে ৭৫ টাকা। ঈদের আগে রসুন কিনেছি; শেষ হয়ে গেছে। ভেবেছিলাম রসুনের দাম তো বাড়বে না। সেখানেও আগুন; ১০০ টাকার রসুন এখন ১৭০ টাকা হয়ে গেছে। এক মাস আগের তুলনায় দেড় হাজার টাকার বাজার এখন আড়াই হাজার টাকায়ও সম্ভব নয়। ঘরে শিশু ও বৃদ্ধ মা আছেন। তাদের পুষ্টি তো দূরের কথা, আমার এই বেতনে দুই বেলা ভাতও খাওয়ানো অসম্ভব হয়ে পড়ছে।’
রফিকুল ইসলামের স্ত্রী বলেন, ‘আমাদের তো আয় বাড়েনি। খরচ বেড়েছে। শুনেছি বিদ্যুতের দাম বাড়বে। তাতে আরেক দফা সবকিছুর দাম বাড়বে। আমাদের কোনো উপায় নেই। সবকিছুর ওপর যা হবে তা হলো পেটে হাত পড়বে। এখনই তিনটা ডিম একটা পেঁয়াজ দিয়ে ভেজে তিনজন খাচ্ছি। স্কুলে পড়া ছেলেমেয়েদের দুধ খাওয়ানোও বন্ধ করে দিয়েছি বলা যায়।’
কাছের বাজারে না গিয়ে ‘বাগিচা’ থেকে এত দূরে কেন এলেন এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘কারওয়ান বাজারে খুচরা বাজারের তুলনায় ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা সাশ্রয় হয়। তাই এখানে আসি। খুচরা বাজারের কোনো বাপ-মা নেই। একেক দোকানে একেক দাম। কারওয়ান বাজার থেকে ৩০০ টাকায় যে সবজি কিনি সেটা এলাকার বাজারে দ্বিগুণ হয়ে যায়। তাই একসঙ্গে কিনি। সয়াবিন তেলের দাম বাড়ায় সরিষার তেল কিনতে ভাঙানির দোকানে গেলাম। তারা বলল, লিটারপ্রতি ৬০ টাকা বেড়েছে।’
গতকাল কারওয়ান বাজার, মালিবাগ, খিলগাঁও বাজারসহ রাজধানীর কয়েকটি পাইকারি ও খুচরা বাজার ঘুরে ব্যবসায়ী ও ক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দাম বাড়েনি এমন কোনো ভোগ্যপণ্য আর নেই বললেই চলে। মাছের আড়তে খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, পোয়া, বড় রুই, ছোট রুই, বড় রূপচাঁদা, পাবদা, কাঁচকি, মলা, চাপিলাসহ প্রায় সব মাছের দাম এক সপ্তাহের ব্যবধানে বেড়েছে কেজিপ্রতি ২০-২৫ টাকা।
কারওয়ান বাজারের মাছ বিক্রেতা হারুন মোল্লা দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘পরিবহন খরচ বেড়েছে এবং হ্যাচারি থেকেই বাড়তি দামে মাছ কিনতে হচ্ছে আড়তদারদের। আমাদের তো কিছু করার নেই। হঠাৎ করেই সবকিছুর দাম বাড়তে শুরু করল। দাম বাড়লে আমাদের অসুবিধা। পাড়া-মহল্লায় বিক্রি কমে যায়।’ সামনে দাম আরও বাড়তে পারে বলেও জানান তিনি।
কারওয়ান বাজারের পাইকারি ব্যবসায়ী সোহাগ বলেন, ‘মুদি আইটেমের দাম প্রতিদিনই বাড়ছে। গত এক মাস ধরেই দাম বাড়তি। এর মধ্যে সয়াবিন তেলের দাম বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে হুহু করে সব জিনিসের দাম বেড়ে গেছে। ভারতের গম রপ্তানি নিষিদ্ধের ঘোষণার পর আটা ও ময়দার দাম বেড়েই যাচ্ছে। চালের দাম গত এক বছর থেকেই ঊর্ধ্বমুখী।’ তিনি আরও বলেন, ‘গত দুদিনে চাল ২-৩ টাকা এবং আটা-ময়দার দাম কেজিপ্রতি ৩-৪ টাকা বেড়েছে। খোলাবাজারে সরিষার তেল বেড়েছে লিটারপ্রতি ৫০ টাকা। দেশি রসুন আগে আমরা ৯২ টাকায় বিক্রি করতাম, এখন কিনতেই হচ্ছে ১২০ টাকা করে। আর চায়না রসুন ছিল ১২০ টাকা; এখন বিক্রি করছি ১৬০ টাকায়। আদায় কেজিপ্রতি দাম বেড়েছে ২০ টাকা। প্যাকেটজাত লবণ ৫, চিনি ৫ এবং গুঁড়ো দুধ ৩০ টাকা বেড়েছে। ডিমের দাম বেড়েছে ডজনপ্রতি ১০ টাকা।’
হঠাৎ রসুনের দাম বাড়ার কারণ জানতে চাইলে পাইকারি বাজারের একাধিক ব্যবসায়ী বলেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে প্রায় সব আমদানি পণ্যের দাম বেড়েছে। জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায় দেশের ভেতরেও পরিবহন খরচ বেড়েছে। সেই সঙ্গে শ্রমিক খরচও বেড়ে গেছে। পণ্য ঠিকমতো পাওয়া যাচ্ছে না। সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্য অনুযায়ী, গত এক সপ্তাহে রসুনের দাম ১৬ শতাংশ বেড়েছে।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, গত ৭-৮ মাস ধরেই অস্বাভাবিক হারে বাড়ছে আটা-ময়দার দাম। টিসিবির দেওয়া তথ্যমতে, খুচরা বাজারে প্রতি কেজি ময়দার (প্যাকেট) দাম এখন ৭০ টাকার বেশি। আর খোলা আটার দাম ৪৬ টাকার বেশি। টিসিবির হিসাবে, গত এক মাসে ৩১ শতাংশ বেড়েছে খোলা আটার দাম। আর গত এক বছরে খোলা ময়দার দাম বেড়েছে ৬০ শতাংশের বেশি। আটা ও ময়দার দাম মানভেদে ২ থেকে ৪ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। আর এক মাসের ব্যবধানে তা কেজিতে ১০ টাকা ছাড়িয়েছে।
ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এক সপ্তাহে নতুন করে বেড়েছে চালের দামও। অর্থাৎ আগের সপ্তাহের ৪৪ টাকা কেজি দরের মোটা চাল ১ টাকা বেড়ে এখন ৪৫ টাকায় এবং ৫৫ টাকা কেজি দরের মাঝারি মানের চালের দাম ৫৬ টাকায় গিয়ে ঠেকেছে। বড় আড়তের পর আবার পাইকারি বাজারে তা আরও ১ টাকা করে বেড়েছে। খুচরায় বেড়েছে ৩ থেকে ৪ টাকা। টিসিবি বলছে, বাজারে ভালোমানের চাল এখন ৬৮ ও মোটা চাল ৪৫ টাকা কেজি দরে পাওয়া যাচ্ছে।
এ সপ্তাহেও বেড়েছে ডিমের দাম। সপ্তাহের ব্যবধানে ফার্মের মুরগির ডিমের দাম ডজনে ১০ টাকা বেড়েছে। এখন এক ডজন ডিম বিক্রি হচ্ছে ১২০ টাকায়, যা গত সপ্তাহে ছিল ১১০ টাকা। খুচরা বাজারে ১১৫ টাকায়ও বিক্রি করতে দেখা গেছে গতকাল। খোলা সয়াবিন তেল গত সপ্তাহের মতো প্রতি লিটার বিক্রি হচ্ছে ২২০ থেকে ২৫০ টাকা। পাম অয়েল বিক্রি হচ্ছে ১৯৫ থেকে ২০০ টাকা। আর বোতলের পাঁচ লিটার সয়াবিন তেল বিক্রি হচ্ছে ৯৮০ থেকে ৯৮৫ টাকায়।
তবে গরুর মাংসের দাম বাড়েনি। কাপ্তান বাজারের মাংস ব্যবসায়ী তৌহিদ জানান, গরুর মাংসের ক্রেতা কম। ঈদের আগে কেজি ৭০০ টাকায় উঠে যাওয়ার পর দামে আর কোনো পরিবর্তন আসেনি। তিনি জানান, ব্রয়লার মুরগির দাম কমে এখন ১৬৫ টাকা কেজি বিক্রি হচ্ছে, যা গত সপ্তাহে ছিল ১৭০ টাকা। আর ঈদের আগে ছিল ১৮০ থেকে ১৮৫ টাকা। সোনালি মুরগির কেজি আগের মতোই ৩০০ থেকে ৩৪০ টাকা বিক্রি হচ্ছে।
গত সপ্তাহের চেয়ে মাছের দাম কেজিপ্রতি ২০ থেকে ২৫ টাকা বেড়েছে। বড় রুই ও বড় অন্য মাছের দাম বেড়েছে ৩০-৪০ টাকা। বড় রূপচাঁদার কেজি ১ হাজার টাকা, গত সপ্তাহে যা ছিল ৯৬৫-৯৭০ টাকা। ছোট রূপচাঁদা আগে ছিল ৮৮৫, এখন ৯০০ টাকা; পাবদা আগে ছিল ৫৮০ টাকা, এখন ৬০০; কাঁচকি আগে ছিল ৪৭০, এখন ৫০০ টাকা। মলা মাছ আগে ছিল ৪৭৫-৪৮০, এখন ৫০০ টাকা; চাপিলা ছিল ৫৬০-৭০, এখন ৬০০ টাকা; পোয়া মাছ ৭৮৫ থেকে হয়েছে ৮০০; বড় রুই ৪২৫-৪৩০ থেকে হয়েছে ৪৫০ এবং ছোট রুই ২৬০-২৭০ টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে কেজিপ্রতি ২৯০ টাকা।
সবজির দামেও স্বস্তি নেই জানিয়ে মালিবাগ বাজারে আসা আনিসুল বলেন, ‘ঈদের পর থেকেই দামের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে খাবার টেবিলের আয়োজন ছোট হচ্ছে। একবেলা মাছ আর আরেকবেলা সবজি খাব তারও উপায় নেই। যেটাতেই হাত দিই আগুন। একমাত্র ফার্মের মুরগি ছাড়া আর কোনো কিছুই ক্রয়সীমার মধ্যে নেই। কেজিপ্রতি ৫০ টাকার নিচে কোনো সবজি নেই। ডিমের দামও বেড়েছে। মহল্লা থেকে নিলে একটা ডিমের দাম ১২ টাকার বেশি পড়ে। খাব কী আর চলব কীভাবে? চলতে হবে পেট সাশ্রয় নীতিতে।’
বাজার ঘুরে দেখা গেছে, গাজর ১২০, লাউ ৭০-৮০, কাঁকরোল ৬০-৭০, কাঁচা পেপে ৫০, বরবটি ১০০, কাঁচা কলার হালি ৩০, ঢেঁড়স ও পটোলের কেজি ৫০ টাকা। ঝিঙে ও চিচিঙ্গা কেজিপ্রতি বিক্রি হচ্ছে ৬০ টাকা।
কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, ‘সরকার ভোগ্যপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণের সর্বাত্মক চেষ্টা করছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ এবং বৈশ্বিক মন্দার কারণে মূল্যস্ফীতি বেড়েছে এবং পাশাপাশি খাদ্য সংকট চলছে। এই মূল্যবৃদ্ধিতে সবচেয়ে বিপাকে আছেন নিম্ন মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত মানুষেরা এবং যারা শহরে ভাড়া বাড়িতে থাকেন। কারণ তাদের সীমিত আয়ে মাসের শুরুতেই বাজারের হিসাব করতে হয়। কাজেই সরকারকে এখন সাপ্লাই চেইন (সরবরাহ) ঠিক রাখতে কড়া নজরদারি রাখতে হবে। এবারের বাজেটে সরকারের আয়নীতি ও ব্যয়নীতির সমন্বয় করে ভোক্তাদের জন্য বড় ছাড় দিতে হবে। বৈশি^ক মন্দা ও যুদ্ধের প্রভাবকে ব্যবহার করে অসাধু ব্যবসায়ীরা যেন মজুদ বাড়িয়ে কৃত্রিম সংকট তৈরি করতে না পারে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। আমদানিনির্ভরতা কমিয়ে উৎপাদনের দিকে ঝুঁকতে হবে। মোটকথা, বাজার মনিটরিং আরও বেশি জোরদার করতে হবে।’