বিশেষ সংবাদদাতা
১৯৭২-৭৩ থেকে শুরু করে ২০১৮-২০১৯ এই ৪৬ অর্থবছরে বাংলাদেশে কালো টাকার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৮৮ লাখ ৬১ হাজার কোটি টাকা। একই সময়ে বিদেশে অর্থপাচার হয়েছে আট লাখ কোটি টাকা।
গতকাল ইস্কাটনে অর্থনীতি সমিতির অডিটোরিয়ামে ‘বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির বিকল্প বাজেট প্রস্তাবনা ২০২২-২৩ একটি জনগণতান্ত্রিক বাজেট প্রস্তাব’ শীর্ষক সংবাদ সম্মেলনে সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ড. আবুল বারকাত এ তথ্য জানান। তিনি আগামী ২০২২-২৩ অর্থবছরের জন্য ২০ লাখ ৫০ হাজার ৩৬ কোটি টাকার ‘বিকল্প বাজেট’ প্রস্তাব উপস্থাপন করেন। এটি চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের মূল বাজেটের তুলনায় ৩ দশমিক ৪ গুণ বেশি। চলতি অর্থবছরে সরকার ঘোষিত বাজেটের আকার হচ্ছে ৬ লাখ ৩ হাজার ৬৮১ কোটি টাকা।
সভায় দুর্নীতি, অর্থপাচার ও কালো টাকা উদ্ধারে একটি স্বাধীন কমিশন গঠনের প্রস্তাব দিয়ে আবুল বারকাত বলেন, ৪৬ বছরে দেশের পুঞ্জীভূত কালো টাকা থেকে দুই শতাংশ বাজেটের আয় খাতে ব্যবহার করার প্রস্তাব করছি। এতে এক লাখ ৭৭ হাজার ২৮৮ কোটি টাকা উদ্ধার হবে। পাশাপাশি একই সময়ে বাংলাদেশ থেকে পাচার হওয়া অর্থের ১০ শতাংশ উদ্ধার করে বাজেটে যুক্ত করার প্রস্তাব দেন তিনি।
সমিতির প্রস্তাবিত বাজেটকে ‘একটি জনগণতান্ত্রিক বাজেট প্রস্তাব’ দাবি করে তিনি বলেন, আমাদের লক্ষ্যÑ পূর্ণ কর্মনিয়োজন, শিশুর জন্য সুস্থ জীবন, সবার জন্য আবাসন, মূল্যস্ফীতি রোধ। এ ক্ষেত্রে বাজেট কোনো অভীষ্ট বা লক্ষ্য হবে না, বাজেট হবে লক্ষ্য অর্জনের মাধ্যম মাত্র।
ড. বারকাত বলেন, প্রচলিত বাজেটে জিডিপি বাড়লেও বাড়তে পারে; মাথাপিছু আয় বাড়লেও বাড়তে পারে, কিন্তু‘বৈষম্য-অসমতা নিরসন হবে না, হবে না মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বা অভীষ্ট বাস্তবায়ন। বাংলাদেশ এখন উচ্চ আয় বৈষম্যের দেশ এবং ‘বিপজ্জনক আয় বৈষম্যের’ দেশ। মানুষের ক্ষুধার দারিদ্র্যসহ বহু মাত্রিক দারিদ্র্য বেড়েছে। বহু মাত্রিক দারিদ্র্য আরো বাড়ছে, বাড়বে। করোনার কারণে ৬ কোটি ৭০ লাখ দরিদ্র হয়ে পড়েছে।
সমিতির বাজেট প্রস্তাবে উল্লেখ করা হয়, মোট রাজস্ব থেকে আয় হবে ১৮ লাখ ৭০ হাজার ৩৬ কোটি টাকা, যা সরকার প্রস্তাবিত চলমান অর্থবছরের (২০২১-২২) চেয়ে ৪.৭৬ গুণ বেশি। সরকারের রাজস্ব আয় বাড়াতে ২৭টি নতুন উৎস প্রস্তাব করা হয়েছে। সার্বিক ঘাটতি ধরা হয়েছে ১ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা (চলতি অর্থবছরের মূল বাজেটে সার্বিক ঘাটতি ২ লাখ ১১ হাজার ১৯১ কোটি টাকা প্রাক্কলন করা হয়েছে)। তবে এ বাজেট ঘাটতি পূরণে সরকারকের অভ্যন্তরীণ ব্যাংকব্যবস্থা ও বৈদেশিক উৎস থেকে কোনো ঋণ গ্রহণ করতে হবে না। বাজেট ঘাটতি পূরণে সঞ্চয়পত্র খাত থেকে ৫০ হাজার কোটি টাকা, সরকারি-বেসরকারি যৌথ অংশীদারিত্ব থেকে ৩০ হাজার কোটি টাকা এবং বন্ড, বিদেশে বসবাসকারী দেশের নাগরিক, বিভিন্ন কোম্পানি ও অন্যান্য খাত থেকে ১ লাখ কোটি টাকা সংগ্রহের প্রস্তাব করা হয়েছে।
তিনি বলেন, শ্রীলঙ্কার ঘটনা দেখার পরে বৈদেশিক ঋণ নিঃসন্দেহে আমাদের দুশ্চিন্তার বিষয়। বৈদেশিক ঋণ, অনুদানের রাজনৈতিক অর্থনীতি সম্পর্কে বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির অবস্থান বরাবর খুবই স্বচ্ছ। ‘এই মুহূর্তে আমাদের দেশের মানুষের মাথাপিছু দেনা ৩৮ হাজার টাকা’, ‘জিডিপির তুলনায় বৈদেশিক ঋণ খুব বেশি নয়’, ‘বৈদেশিক ঋণ পরিশোধে আমাদের অবস্থা স্বস্তিদায়ক’, ‘আমরা এখন বিদেশে ঋণ দেই’- এসবই সরকারি কাথা-বার্তা এবং আপাত দৃষ্টিতে স্বস্তিদায়ক। বৈদেশিক ঋণ নিয়ে এখন পর্যন্ত আমাদের অবস্থান বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, যখন থেকে আমরা একসাথে চার থেকে পাঁচটি বৈদেশিক ঋণ নেয়া মেগা প্রকল্পের ঋণের সুদ পরিশোধ করা শুরু করব, তখন থেকে ঋণ পরিশোধ অবস্থা সবুজ না হলে লাল সঙ্কেতবাহী হওয়ার সম্ভাবনা প্রচুর। আনুমানিক সময় আমাদের হিসাবে ২০২৭-২৮ সাল।
শিক্ষা নিয়ে আমাদের নীতিগত প্রস্তাব, সরকারে যে বা যারাই থাকুন না কেন প্রথমেই নিঃশর্তভাবে স্বীকার করে নিতে হবে শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য হলো জ্ঞান সমৃদ্ধ, বিচার বোধ সম্পন্ন, নৈতিক দৃষ্টিতে উন্নত ও সৌন্দর্য বোধ সমৃদ্ধ পূর্ণাঙ্গ মানুষ সৃষ্টি করা। আমরা জানি আমাদের শিক্ষা এটার সাথে মেলে না। শিক্ষা খাতে বাজেট কোনোভাবে ব্যয় হিসেবে দেখা যাবে না, সামাজিক বিনিয়োগ হিসেবে দেখতে হবে। জিডিপির অনুপাতে শিক্ষা খাতে সরকারি বরাদ্দ নি¤œমুখী, বলেন তিনি।
সরকারের উদ্দেশে ড. বারকাত বলেন, দেশে বৈষম্য-দারিদ্র্যের বিপজ্জনক প্রবণতা, ক্রমবর্ধমান মূল্যস্ফীতি, শোভন কর্মবাজারের সঙ্কোচন, একই সাথে এই প্রবণতায় করোনাকালীন এবং ইউরোপে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের অভিঘাত, অনিশ্চয়তা এবং সম্ভাব্য ভবিষ্যৎ নিয়ে সরকারের নীতিনির্ধারকদের বাজেটসহ সব উন্নয়ন দলিলে কয়েকটি বিষয় খুব গুরুত্ব দিয়ে ভাবতে হবে। বিষয়সমূহ এ রকম : দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ বহুমাত্রিক দরিদ্র। আর ধনী-অতিধনী হলেন জনসংখ্যার সর্বোচ্চ ১ শতাংশ। কোভিড-১৯ লকডাউনের প্রভাবে ‘নিরঙ্কুশ দরিদ্র’ মানুষ ‘হতদরিদ্র-চরমদরিদ্র’ হয়েছেন। আর নি¤œমধ্যবিত্ত মানুষের ব্যাপকাংশ দরিদ্র হয়েছেন এবং মধ্য-মধ্যবিত্তদের একাংশ বিত্তের মানদণ্ডে নি¤œগামী হয়েছেন। ফলে এখন একদিকে দরিদ্র মানুষের মোট সংখ্যা কোভিড-১৯ সময়ের আগের তুলনায় কমপক্ষে দ্বিগুণ বেড়েছে। আর অন্য দিকে সৃষ্টি হয়েছে নতুন এক দরিদ্র গোষ্ঠী, যারা আগে দরিদ্র ছিলেন না এরা হলেন ‘নবদরিদ্র’।
দেশের বর্তমান অর্থনৈতিক অবস্থা নিয়ে তিনি বলেন, বিপজ্জনক আয় বৈষম্যের দেশে পরিণত হয়েছে বাংলাদেশ। ২০৩২ সাল নাগাদ বিদেশী ঋণ পরিশোধে বাংলাদেশ বিপদে পড়তে পারে। তখন বড় ধরনের রাজনৈতিক অস্থিরতা দেখা দিতে পারে।
বিকল্প বাজেট সংবাদ সম্মেলন সঞ্চালনা করেন বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ড. মো: আইনুল ইসলাম। এতে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে দেশের ৬৪টি জেলা, ১০৭টি উপজেলা ও ২১টি ইউনিয়ন থেকে বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সদস্য এবং বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার প্রতিনিধিরা যুক্ত ছিলেন।