যেখানে বাঘের ভয়, সেখানেই রাত হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মসনদে বসার শুরু থেকেই অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে উদ্বেগের মধ্যে ছিলেন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। এ কারণে ক্ষমতায় এসেই ২০২১ সালের মার্চে অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্রের বিষয়ে দুটো বিলও পাশ করিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু তাতে কোনো লাভ হয়নি। তার ওই বিল দুটিও ওসব কালো অস্ত্র থেকে রক্ষা করতে পারেনি নিরপরাধ মার্কিনিদের। চলতি বছরের পাঁচ মাসেই বন্দুক হামলা হয়েছে ২৭টি স্কুলে। যেন বংশপরম্পরায় যুগের পর যুগ ধরে এই ‘বিষফোঁড়া’ কাঁধে নিয়েই বাঁচতে হবে মার্কিনিদের। শুধু আগ্নেয়াস্ত্রের কারণেই দেশটিতে বছরে প্রায় ৩৫ হাজার মানুষ নিহত হন। অর্থাৎ গড়ে প্রতিদিন নিহত হন প্রায় ১০০ জন। গবেষণা বলছে, আমেরিকায় জনসংখ্যার চেয়ে আগ্নেয়াস্ত্রের সংখ্যা বেশি।
টেক্সাসের উভালদে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে স্থানীয় সময় মঙ্গলবার বন্দুকধারীদের গুলিতে ১৯ শিশু ও দুজন শিক্ষিকা নিহত হয়েছেন। চলতি বছর এমন দুর্ঘটনার শিকারের ক্ষেত্রে স্কুলটি ২৭তম। নিউইয়র্কের বাফেলো টপস সুপার মার্কেটে গুলি চালানোর মাত্র ১০ দিন পরেই এ ঘটনা ঘটল। ২০১৮ সাল থেকে স্কুলে গুলি চালানোর ঘটনা ঘটেছে ১১৯টি। গত সপ্তাহে মার্কিন রোগনিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ কেন্দ্রের দেওয়া তথ্যানুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্রে ২০২০ সালে আগ্নেয়াস্ত্রের শিকার হয়েছিলেন ১৯ হাজার ৩৫০ মার্কিনি। আগের বছরের তুলনায় এ সংখ্যা ছিল ৩৫ শতাংশ বেশি। গবেষণার তথ্য বলছে, ২০১৫ সালে দেশটিতে বন্দুক হামলার ঘটনা ঘটেছে ৩৬১টি। অর্থাৎ ওই বছর প্রায় প্রতিদিনই যুক্তরাষ্ট্রের কোথাও না কোথাও বন্দুক হামলা হয়েছে। এতে নিহত হন ৩২৬ জন। আহত হন দেড় হাজারেরও বেশি। যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রীয় প্রতিরক্ষা এবং নিরাপত্তা সংস্থার হিসাব বলছে, ১৯৭০ সাল থেকে এ পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি স্কুলে গোলাগুলির ঘটনা ঘটেছে ২০১৮ সালে। ওই বছর দেশটির স্কুলে গোলাগুলির ঘটনা ঘটেছে ৯৪টি। বন্দুকের দাপটে ভাসছে আমেরিকা। মার্কিন আগ্নেয়াস্ত্র নির্মাতারা ২০০০ সাল থেকে গত দুই দশক ধরে বাণিজ্যিক বাজারের জন্য প্রায় ১৪ কোটি বন্দুক তৈরি করেছে। দেশটি আমদানি করেছে আরও ৭ কোটি ১০ লাখ বন্দুক। এর মধ্যে রয়েছে উচ্চক্ষমতার অ্যাসল্ট রাইফেল, যা ৫০০ ডলারে পাওয়া যায়। ৯ মিলিমিটার পিস্তল যা নির্ভুল নিশানাসহ ব্যবহারে সহজ এবং স্বয়ংক্রিয় ট্রিগার পাওয়ার সমৃদ্ধ, এর দাম ২০০ ডলারেরও কম। যুক্তরাষ্ট্রে বর্তমানে প্রায় ২৭ থেকে ৩১ কোটি বন্দুকের সরবরাহ আছে। যেখানে যুক্তরাষ্ট্রের জনসংখ্যা ৩২ কোটি। অর্থাৎ প্রায় প্রত্যেকেই একটি বন্দুক রাখতে পারেন। গবেষণা সংস্থা পিস রিসার্চ সেন্টারের তথ্য অনুসারে, যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি এক-তৃতীয়াংশ পরিবারে অন্তত একজন বন্দুক বহন করেন। আগ্নেয়াস্ত্রের এই সহজলভ্যতাই দেশটিতে আগ্নেয়াস্ত্রের আতঙ্ক বাড়িয়ে দিয়েছে। একই কারণে যুক্তরাষ্ট্রে এ ধরনের হামলার ঘটনা বাড়ছে। এ ধরনের হামলা মহামারিতে রূপ নিয়েছে দেশটিতে। নিরাপত্তার অজুহাতে নাগরিকদের হাতে থাকা বন্দুকই প্রতিনিয়ত কেড়ে নিচ্ছে শিশুসহ অসংখ্য নিরীহ মানুষের প্রাণ। গবেষণা বলছে, দেশটিতে প্রতি ৬০ ঘণ্টায় একটি করে বন্দুক হামলার ঘটনা ঘটে। ২০০৯ সাল থেকে এ পর্যন্ত ২৭৪ বন্দুক হামলা হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রে। ১৫৩৬ জন গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত। ৯০০ জন আহত। ওয়াশিংটনের গান ভায়োলেন্স আর্কাইভ বলছে, গত ৫ মাসেই দেশটিতে ২১২টি বন্দুক হামলা হয়েছে।
অন্য এক গবেষণায় দেখা গেছে, যুক্তরাষ্ট্রে ২০১১ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত প্রতি ৬৪ দিনে একবার করে বন্দুক হামলার ঘটনা ঘটেছে। এর আগে ২৯ বছর ধরে এর গড় ছিল ২০০ দিনে একবার। মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনএন জানায়, ১৯৯৬ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রে বন্দুক হামলার ঘটনা ঘটেছে ৯০টি। হামলাকারীর আগাম তথ্য ও হামলা রোধে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে তেমন সাফল্য না পাওয়ায় দেশটিতে প্রশ্নের মুখে এফবিআই, সিআইএ ও এনএসএর মতো শক্তিশালী গোয়েন্দা ও নিরাপত্তা সংস্থা। অনেক ক্ষেত্রে হামলার কারণও থাকছে অজানা। দেশটিতে বন্দুক হামলা এখন যেন এক গণ-আতঙ্ক।