বাংলাদেশের স্বপ্ন, সমৃদ্ধির প্রতীক, অন্যতম স্থাপনা ‘পদ্মা সেতু

বাংলাদেশের স্বপ্ন, সমৃদ্ধির প্রতীক, অন্যতম স্থাপনা ‘পদ্মা সেতু

যোগাযোগ ক্ষেত্রে নতুন দিগন্তের উন্মোচন করতে যাচ্ছে স্বপ্নের পদ্মা সেতু। দেশের দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে ব্যাপক পরিবর্তন আনবে বহুল প্রতীক্ষিত এ সেতু। যান চলাচলের জন্য প্রায় শতভাগ প্রস্তুত বহুমুখী পদ্মা সেতু। এখন শুধু অপেক্ষা উদ্বোধনের। শেষ মুহূর্তে সেতুর ওপর মার্কিং সাইন, রং ও লাইটিংয়ের কাজ চলছে। শতাংশের হিসাবে ৯৯ ভাগ কাজ সম্পন্ন হয়েছে এরই মধ্যে। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে আগামী ২৫ জুন সকাল ১০টায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাঙালির গর্বের এই সেতু উদ্বোধন করবেন। এ জন্য পদ্মার দুই পাড়েই উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের ব্যাপক প্রস্তুতি চলছে। নিজস্ব অর্থায়নে এত বড় অবকাঠামোর বাস্তবায়ন রীতিমতো অসম্ভবকে সম্ভবে পরিণত করা হয়েছে। বৃহৎ এই প্রকল্প নিজস্ব অর্থায়নে বাস্তবায়ন করে উন্নত বিশ্বকে নিজেদের সামর্থ্যরে বার্তা দিল বাংলাদেশ।

এটি শুধু সেতুই নয়, এটি বাঙালি জাতির আবেগ, অনুভূতিও। কোনো এক দুঃস্বপ্নকে হাতের মুঠোয় এনে বিশ্ববাসীকে নিজেদের সামর্থ্য দেখিয়ে দেওয়া। এই সেতুর ফলে দক্ষিণের অন্তত ২১টি জেলার বাসিন্দাদের চলাচলের অনেক বঞ্চনা ও যাতনার শেষ হতে যাচ্ছে। এ অঞ্চলের উন্নয়ন ত্বরান্বিত হবে দ্রুতগতিতে। জাতীয়ভাবে অন্তত ১ দশমিক ২ শতাংশ জিডিপি বাড়বে পদ্মা সেতু বাস্তবায়নের ফলে। ওপারের ২১ জেলার ক্ষেত্রে জিডিপি বাড়বে অন্তত ২ দশমিক ৩ শতাংশ। স্বপ্নের এই সেতু নিয়ে নানা ষড়যন্ত্র, বিতর্ক, দুর্নীতির অভিযোগ সবকিছুকে মিথ্যা প্রমাণিত করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাহসী ও দৃপ্ত পদক্ষেপে অবাস্তবকে বাস্তবে রূপ দিয়েছে বাঙালি জাতি। যা সত্যিই বিশ্বের অনেক দেশের জন্য দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।

উদ্বোধনী প্রস্তুতি : ২৫ জুন মুন্সীগঞ্জের মাওয়া থেকে এ প্রকল্পের উদ্বোধনের পর সেতু পেরিয়ে শরীয়তপুরের জাজিরা প্রান্তে যাবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। জাজিরা প্রান্তের টোল প্লাজার সামনে উদ্বোধনী ফলক উন্মোচনের পর তিনি যোগ দেবেন জনসভায়। মাদারীপুরের শিবচরের কাঁঠালবাড়ীতে উদ্বোধনী জনসভার মঞ্চটি হবে পাল তোলা নৌকার আদলে। পদ্মা সেতুর উদ্বোধনী জনসভা সফল করতে আওয়ামী লীগের নেতারা তৎপরতা শুরু করেছেন। এর অংশ হিসেবে জনসভার জন্য নির্ধারিত স্থান পরিদর্শন করেছেন দলের নেতারা। জনসভায় দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলার ১০ লাখ মানুষের সমাগম ঘটানোর আশা করছেন তারা। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দুটি ম্যুরাল স্থাপন করা হচ্ছে সেতুর উভয় প্রান্তে। যার কাজও প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। ৬ দশমিক ১ কিলোমিটার দীর্ঘ এই সেতুর কাজ শেষ হতে সময় লাগল সাড়ে সাত বছর। এতে ব্যয় হয়েছে ৩০ হাজার কোটি টাকারও বেশি। এই সেতুর ওপর দিয়ে প্রতিদিন বিভিন্ন রকমের অন্তত ২৪ হাজার গাড়ি চলবে। যা থেকে টোল আদায় হবে সাড়ে ৪ কোটি টাকার মতো। আনুষ্ঠানিকভাবে সেতুর কাজ শুরু হয় ২০১৪ সালের ৭ ডিসেম্বর। উদ্বোধন হতে যাচ্ছে ২৫ জুন-২০২২। সেতুর ওপর দিয়ে চলবে বিভিন্ন রকমের যানবাহন। আর নিচ দিয়ে রেললাইন স্থাপন করা হচ্ছে। যদিও তা পিছিয়ে গেছে নানা জটিলতায়। কথা ছিল সেতুর ওপর দিয়ে একই দিনে যান ও ট্রেন চলবে। কিন্তু তা করা সম্ভব হয়নি। রেললাইন স্থাপনের কাজ চলছে।
কাজের অগ্রগতি : সেতুর কাজ প্রায় শতভাগই শেষ হয়ে গেছে। বাংলাদেশের স্বপ্ন, সমৃদ্ধির প্রতীক, অন্যতম স্থাপনা ‘পদ্মা সেতু’। এই সেতুর মাধ্যমে দেশের মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত হবে ২১ জেলা। এতে দেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থার ব্যাপক পরিবর্তন ঘটবে। ২৫ জুন থেকেই যান চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া হচ্ছে স্বপ্নের পদ্মা সেতু। তবে রেললাইন স্থাপনের কাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত চলবে না ভারী কোনো যানবাহন। এমনকি রেলের স্লিপার স্থাপনের কাজ নির্বিঘ্ন করতে রাতের ৬ থেকে ৮ ঘণ্টা সেতুতে ধীরগতিতে যান চলাচলের নির্দেশনা দেওয়া হতে পারে। পদ্মা সেতু প্রকল্পে চলছে শেষ সময়ের ফিনিশিংয়ের কাজ।

সেতু বিভাগের সচিব ও বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের নির্বাহী পরিচালক মো. মনজুর হোসেন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘২৫ জুনকে টার্গেট করেই পদ্মা সেতু প্রকল্পের কাজ চলছে। সব ধরনের কাজ প্রায় শেষ। এখন চলছে উদ্বোধনের প্রস্তুতি। শেষ হয়েছে পিচ ঢালাইয়ের কাজ। সেতুতে বসেছে সবকটি ল্যাম্পপোস্ট। রোড মার্কিংয়ের কাজও শেষ পর্যায়ে।

গ্যাস পাইপলাইন, ওয়াকওয়েসহ নির্মাণের কাজও শেষের দিকে। সেতুটি চালু হলেও নিচের অংশে রেললাইনের কংক্রিট ঢালাইয়ের কাজ বাকি রয়েছে। ঢালাই দেওয়া অবস্থায় সেতু দিয়ে যান চলাচলে যে কম্পন সৃষ্টি হবে তাতে রেললাইনের ঢালাইয়ে সমস্যা দেখা দিতে পারে। ধরতে পারে ফাটল। রেল কর্তৃপক্ষের চাহিদা অনুযায়ী ঢালাইয়ের সময় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সেতুতে যান চলাচলের পর কম্পনের মাত্রা কতটুকু হয় তা পর্যবেক্ষণ করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। রেলের অংশের কাজ শুরুর পর লাইন বসাতে অন্তত ছয় মাস লাগবে। সে হিসাব অনুযায়ী এ বছরের ডিসেম্বর নাগাদ পদ্মা সেতু দিয়ে রেল চলাচল করতে পারবে বলে আশা করছে রেল কর্তৃপক্ষ।

বাস্তবায়নকাল : সব জল্পনা ও অনিশ্চয়তার অবসান ঘটিয়ে ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজ শুরু হয়। ২০১৭ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর ৩৭ ও ৩৮ নম্বর খুঁটিতে প্রথম স্প্যান বসানোর মধ্য দিয়ে দৃশ্যমান হয় পদ্মা সেতু। এরপর একে একে ৪২টি পিলারে ১৫০ মিটার দৈর্ঘ্যরে ৪১টি স্প্যান বসিয়ে ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ পদ্মা সেতু পুরোপুরি দৃশ্যমান হয়েছে ২০২০ সালের ১০ ডিসেম্বর। একই সঙ্গে চলতে থাকে রোডওয়ে, রেলওয়ে স্লাব বসানোসহ অন্যান্য কাজ। সেতুর মূল আকৃতি দোতলা। মূল সেতু নির্মাণের জন্য কাজ করছে চীনের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি (এমবিইসি) আর নদী শাসনের কাজ করছে দেশটির আরেকটি প্রতিষ্ঠান সিনো হাইড্রো করপোরেশন। দুটি সংযোগ সড়ক ও অবকাঠামো নির্মাণ করেছে বাংলাদেশের আবদুল মোনেম লিমিটেড। কংক্রিট ও স্টিল দিয়ে নির্মিত হয়েছে এ সেতুর কাঠামো। পদ্মা সেতুর সৌন্দর্য দেখতে সেতুর দুই পাশে প্রতিদিন হাজারো মানুষ ভিড় করে; যা মিলনমেলায় পরিণত হয়। আগামী ২৫ জুন পদ্মা বহুমুখী সেতু যান চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের।

শুরুর কথা : ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী জোরেশোরে শুরু হয় পদ্মা সেতু নির্মাণ প্রক্রিয়া। প্রথমদিকে বিশ্বব্যাংক, জাইকা ও এডিবি এবং আইডিবি এ প্রকল্পে অর্থায়নে আগ্রহী হয়। এ প্রকল্পে ১২০ কোটি ডলার ঋণ দেওয়ার কথা ছিল বিশ্বব্যাংকের। কিন্তু ২০১১ সালে হঠাৎ করেই দুর্নীতির চেষ্টার অভিযোগ এনে ২০১২ সালে এ প্রকল্প থেকে সরে দাঁড়ায় বিশ্বব্যাংক। অভিযোগ ছিল, কানাডীয় কোম্পানি এসএনসি-লাভালিনকে কাজ পাইয়ে দিতে দুর্নীতির চেষ্টা হচ্ছে। এতে সরকারি, বেসরকারি কর্মকর্তা ও এসএনসি-লাভালিনের কর্মকর্তারা জড়িত। এ নিয়ে কানাডার আদালতে মামলা হয়। পরবর্তীতে ২০১৪ সালে দুর্নীতির চেষ্টা অভিযোগকে মিথ্যা আখ্যা দিয়ে কানাডার আদালত থেকে রায় দেওয়া হয়। এরপর বিশ্বব্যাংক অর্থায়নে ফিরে আসতে চাইলেও সরকার সংস্থাটির সে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে। সেই বছরের ডিসেম্বরেই এ প্রকল্পের আনুষ্ঠানিকভাবে কাজ শুরু হয় নিজস্ব অর্থায়নে।

প্রকল্প ব্যয় : পদ্মা সেতু নির্মাণে মোট খরচ করা হচ্ছে ৩০ হাজার ১৯৩ দশমিক ৩৯ কোটি টাকা। এসব খরচের মধ্যে রয়েছে সেতুর অবকাঠামো তৈরি, নদী শাসন, সংযোগ সড়ক, ভূমি অধিগ্রহণ, পুনর্বাসন ও পরিবেশ, বেতন-ভাতা ইত্যাদি। বাংলাদেশের অর্থ বিভাগের সঙ্গে সেতু বিভাগের চুক্তি অনুযায়ী, সেতু নির্মাণে ২৯ হাজার ৮৯৩ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে সরকার। ১ শতাংশ সুদ হারে ৩৫ বছরের মধ্যে সেটি পরিশোধ করবে সেতু কর্তৃপক্ষ। এর আগে ২০০৫-এ পদ্মা সেতু নির্মাণের প্রাথমিক ব্যয় প্রাক্কলন করা হয়েছিল ১২ হাজার কোটি টাকা। ২০০৭-এর আগস্ট মাসে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে একনেকের সভায় পদ্মা সেতুর চূড়ান্ত প্রাক্কলন করা হয় ১০ হাজার ১৬১ কোটি টাকা। পরবর্তীতে ২০১১ সালের ১১ জানুয়ারিতে ব্যয় সংশোধন করে ধরা হয়েছিল ২০ হাজার ৫০৭ কোটি টাকা। সময়ের পরিক্রমায় তা ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে।

আর্থ-সামাজিক অগ্রগতি : এ সেতুর বাস্তবায়নের ফলে দক্ষিণবঙ্গের ২১টি জেলার সঙ্গে ঢাকাসহ সারা দেশে সরাসরি সংযোগ স্থাপিত হতে যাচ্ছে। এতে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) অন্তত ১ দশমিক ২ শতাংশ বাড়বে। এ সেতুর বাস্তবায়ন হওয়ায় পরিবহন খাতে বিনিয়োগ হবে অন্তত ২০০ কোটি টাকা। বিপুলসংখ্যক মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে ২১ জেলাজুড়ে। তৈরি হবে নানারকমের শিল্প-কারখানা। বাড়বে কৃষিজ উৎপাদন। সহজ হবে পণ্য পরিবহন ব্যবস্থা। মানুষের আয় বাড়বে। পরিবর্তন হবে আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটের। কৃষি খাতেও আসবে ব্যাপক পরিবর্তন।

দিতে হবে টোল : মোটরসাইকেল নিয়ে পদ্মা সেতু পার হতে চাইলে টোল দিতে হবে ১০০ টাকা। কার ও জিপের জন্য ৭৫০ টাকা আর পিকআপের জন্য ১ হাজার ২০০ টাকা দিতে হবে। মাইক্রোবাসে লাগবে ১ হাজার ৩০০ টাকা। বাসের জন্য আসনের ভিত্তিতে তিন ধরনের টোল নির্ধারণ করা হয়েছে। ছোট বাসে (৩১ আসন বা এর কম) ১ হাজার ৪০০ টাকা, মাঝারি বাসে (৩২ আসন বা এর বেশি) ২ হাজার টাকা এবং বড় বাসে (৩ এক্সেল) ২ হাজার ৪০০ টাকা টোল দিতে হবে। পণ্যবাহী বাহনের ক্ষেত্রে ছোট ট্রাক (৫ টন পর্যন্ত) ১ হাজার ৬০০ টাকা, মাঝারি ট্রাক (৫ থেকে ৮ টন) ২ হাজার ১০০ টাকা, মাঝারি ট্রাক (৮ থেকে ১১ টন) ২ হাজার ৮০০ টাকা, ট্রাক (৩ এক্সেল পর্যন্ত) ৫ হাজার ৫০০ টাকা এবং ট্রেইলার (৪ এক্সেল পর্যন্ত) পার হতে ৬ হাজার টাকা টোল দিতে হবে। চার এক্সেলের বেশি হলে ট্রেইলারে ৬ হাজার টাকার সঙ্গে প্রতি এক্সেলে বাড়তি ১ হাজার ৫০০ টাকা দিতে হবে টোল বাবদ। গত ১৭ মে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের এক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে টোলের এই হার জানানো হয়েছে। এসব যানবাহন থেকে প্রতিদিন অন্তত ৪ কোটি টাকার টোল আদায় করবে সেতু বিভাগ।

জাতীয়