বায়ু এবং শব্দদূষণে বিশ্বে শীর্ষের তালিকায় উঠে এসেছে ঢাকা

বায়ু এবং শব্দদূষণে বিশ্বে শীর্ষের তালিকায় উঠে এসেছে ঢাকা

মানুষের হাঁটার গতির চেয়েও কম রাজধানীতে চলাচলকারী পরিবহনের গতি। বায়ু এবং শব্দদূষণে বিশ্বে শীর্ষের তালিকায় উঠে এসেছে ঢাকার নাম। তীব্র যানজটে গরমে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কালো ধোঁয়ায় রাস্তায় কাটছে কর্মঘণ্টা। এই বিরূপ পরিবেশ প্রভাব ফেলছে রাজধানীবাসীর শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যে। যানজট, দূষিত বায়ু-পানি, অতিরিক্ত শব্দ ডেকে আনছে নানা রোগ। গত ৩ এপ্রিল রমজানের প্রথম দিন ঢাকার মূল সড়কগুলোতে গাড়ির গতির ওপর এক গবেষণা চালিয়েছে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অ্যাকসিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউট। যাতে দেখা গেছে সেদিন ঢাকায় গাড়ির গড় গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় চার দশমিক আট কিলোমিটার। ২০০৫ সালে বিশ্বব্যাংকের গবেষণায় দেখা গিয়েছিল, সেসময় ঢাকা শহরে ঘণ্টায় গাড়ির গড় গতি ছিল প্রায় ২১ কিলোমিটার। ইনস্টিটিউটের করা আরেক গবেষণায় দেখা গেছে, ঢাকায় যানজটের কারণে স্বাস্থ্যগত যে সমস্যা তৈরি হয় তার দৈনিক ক্ষতি গড়ে ৮ কোটি ৭৪ লাখ টাকা। আর ঢাকা শহরের ট্রাফিক সিগন্যালে দুর্ঘটনার কারণে আর্থিক ক্ষতি দৈনিক ১ কোটি ৫৫ লাখ টাকা। দুর্ঘটনার শিকার ব্যক্তিদের চিকিৎসা খরচ, তাদের পরিবারের অন্যান্য নানা খরচ, মৃত ব্যক্তির পরিবার তার আয় বন্ধ হয়ে যাওয়ায় যে ক্ষতির শিকার হচ্ছে এসব বিষয় বিবেচনা করে এই সংখ্যা দাঁড় করানো হয়েছে। শুধু ব্যস্ত সড়কে, পিক আওয়ারে ট্রাফিক সিগন্যালে দুর্ঘটনার সংখ্যার ওপর ভিত্তি করে এই হিসাব করা হয়েছে।

বুয়েটের অ্যাকসিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের পরিচালক, গণপরিবহন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক মো. হাদিউজ্জামান  বলেন, ‘ঢাকা শহরের হৃদস্পন্দন ভয়াবহভাবে কমে গেছে। গাড়ির ঘণ্টা প্রতি গতি একজন সুস্থ মানুষের হাঁটার গতির চেয়ে কম। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যমতে একজন সুস্থ মানুষ যদি স্বাভাবিক গতিতে হাঁটেন তাহলে তিনি ঘণ্টায় পাঁচ কিলোমিটার বেগে হাঁটতে সক্ষম। জোরে হাঁটতে হবে না, স্বাভাবিক গতিতে হাঁটলেই হবে। ঢাকায় এখন একজন সুস্থ মানুষ হেঁটে গাড়ির আগে যেতে পারবেন।’ তিনি আরও বলেন, ‘ঢাকার যানজট পাঁচ ধরনের আর্থিক ক্ষতির কারণ। এর মধ্যে দুই ধরনের আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে যানজট থেকে সৃষ্ট ঢাকাবাসীদের স্বাস্থ্যগত জটিলতা এবং দুর্ঘটনার কারণে। ধরুন বায়ুদূষণের জন্য যেসব অসুখ হচ্ছে সেজন্য একজন মানুষকে ডাক্তারের কাছে যেতে, ওষুধ খেতে হচ্ছে, কাজে যেতে পারছে না। এরও তো একটা খরচ আছে, আর্থিক ক্ষতি আছে। যাত্রীরা যখন দীর্ঘসময় রাস্তায় বসে আছে, তাদের মধ্যে একধরনের মনস্তাত্ত্বিক অস্থিরতা কাজ করে। ট্রাফিক পুলিশ যখন যাওয়ার ইশারা দেন তখন যাওয়ার জন্য সবার মধ্যে যে প্রতিযোগিতা তৈরি হয় কে কার আগে যেতে পারে, সিগন্যাল বন্ধ হওয়ার আগেই টান দিয়ে চলে যাওয়ার চেষ্টা, এই মনস্তাত্ত্বিক অস্থিরতার কারণে দুর্ঘটনা হচ্ছে। এরও একটা আর্থিক ক্ষতি আছে।’

২০১৭ সালে যুক্তরাজ্যভিত্তিক প্রতিষ্ঠান জিপজেটের করা এক গবেষণায় দেখা গেছে, এশিয়ার শহরগুলোর মধ্যে ঢাকায় বাস করা সবচেয়ে স্ট্রেসফুল বা মানসিক চাপের ব্যাপার। এর একটি কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছিল ঢাকার যানজট। যানজটে গাড়ির ইঞ্জিন চালু থাকায় সৃষ্ট হয় ধোঁয়া। গাড়ির ধোঁয়ায় রয়েছে সিসা। এ ছাড়া গাড়ি এক জায়গায় আটকে থাকার কারণে যে ধোঁয়া নির্গত হয় সেটিকে বলা হয় ইন-কমপ্লিট কমবাস্টন। এতে কার্বন মনোক্সাইড, ডাইঅক্সিন, নাইট্রিক অক্সাইড, সালফার অক্সাইড এ রকম নানা গ্যাস বাতাসের সঙ্গে মানুষের ফুসফুসে চলে যাচ্ছে। চিকিৎসকরা বলেন, এতে সুস্থ ফুসফুসেও শ্বাসকষ্ট হয়। দীর্ঘদিন এই গ্যাস দ্বারা দূষিত বাতাসে নিঃশ্বাস নিতে থাকলে এসব গ্যাস রক্তে মিশে যায়, তখন তা ফুসফুসের স্থায়ী ক্ষতি করে। ফুসফুসের রোগ যেমন হাঁপানি, ক্রনিক অবস্ট্রাক্টিভ পালমোনারি ডিজিজ, ইন্টারস্টিসিয়াল লাঙ ডিজিজের প্রবণতা বেড়ে যায়। এমনকি ফুসফুসে ক্যান্সারও হতে পারে। যারা ইতোমধ্যেই ফুসফুসের নানা ধরনের রোগে আক্রান্ত, তাদের ক্ষেত্রে রোগটি আরও অনেক খারাপ পর্যায়ে চলে যেতে পারে। পানি দূষণে ঢাকায় ডায়রিয়া, জন্ডিস, টাইফয়েডে আক্রান্ত হওয়া নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। দীর্ঘদিন এই দূষিত পানি ব্যবহারের ফলে মানুষ কিডনি, লিভারের বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। এই দূষিত পরিবেশে বসবাসের কারণে মানুষ স্ট্রোক, হৃদরোগের মতো দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হচ্ছে।
জনস্বাস্থ্যবিদ অধ্যাপক ডা. চিন্ময় দাস বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘দীর্ঘ সময় যানজটে বসে থাকার কারণে মানসিক চাপ তৈরি হয়। এর ফলে হরমোন নিঃসরণ হয় এবং মানসিক অস্থিরতা তৈরি হয়। দীর্ঘ সময় গরম, কালো ধোঁয়া, ধুলায় বসে থেকে হার্ট, শ্বাসতন্ত্রের ক্ষতি হচ্ছে। রাতে না ঘুমানো, কোষ্ঠকাঠিন্য, শ্রবণ ক্ষমতা কমে যাওয়া, মনোযোগ নষ্ট হওয়ার সমস্যায় ভুগছে মানুষ। অ্যাজমা, ব্রংকাইটিসে আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ। মানুষের অসংক্রামক রোগে আক্রান্ত হওয়ার বড় কারণ ঢাকার মতো দূষিত যানজটের শহরে বসবাস।’

‘ফ্রন্টিয়ারস ২০২২ : নয়েজ, ব্লেজেস অ্যান্ড মিসম্যাচেস’ শীর্ষক এ প্রতিবেদন বলছে, ঢাকায় শব্দের সর্বোচ্চ তীব্রতা ১১৯ ডেসিবল, যা এ প্রতিবেদনে আসা শহরগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ১৯৯৯ সালের গাইডলাইন অনুযায়ী, আবাসিক এলাকার জন্য শব্দের গ্রহণযোগ্য সর্বোচ্চ মাত্রা ছিল ৫৫ ডেসিবল, বাণিজ্যিক এলাকার জন্য ৭০ ডেসিবল। ২০১৮ সালের সর্বশেষ হালনাগাদ গাইডলাইনে সড়কে শব্দের তীব্রতা ৫৩ ডেসিবলের মধ্যে সীমিত রাখার সুপারিশ করা হয়। এই হিসাবে ঢাকার বাসিন্দাদের পথ চলতে গিয়ে জাতিসংঘের বেঁধে দেওয়া সীমার দ্বিগুণ মাত্রার শব্দের অত্যাচার সহ্য করতে হয়।

সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নাক-কান-গলা বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. মণিলাল আইচ লিটু বলেন, ‘শব্দদূষণের ফলে শ্রবণ ক্ষমতা কমে যায়। অতিরিক্ত শব্দের মাঝে বসবাস করলে মাথা ঘোরে, কানে শব্দ হয়, ঘুম কমে যায়, অমনোযোগী হয়ে যায় মানুষ। কোনো কিছুতে গভীর মনোযোগ দিতে পারে না। আচরণ খিটখিটে হয়ে যায়, অসহিষ্ণু হয়ে ওঠে। গ্যাসট্রিক, আলসার, হৃদরোগ, হৃদস্পন্দন বেড়ে যাওয়া, উচ্চ রক্তচাপের সমস্যায় ভোগে মানুষ। গর্ভবতী নারী ও বৃদ্ধদের ক্ষেত্রে শব্দদূষণের প্রভাব আরও মারাত্মক হয়।’

জাতীয় পরিবেশ