মাথাপিছু ঋণ ৯৬ হাজার টাকা

মাথাপিছু ঋণ ৯৬ হাজার টাকা

দেশের মানুষের কাঁধে ঋণের বোঝা বাড়ছে। বর্তমানে দেশের প্রতিটি নাগরিকের মাথাপিছু ঋণের পরিমাণ ৯৫ হাজার ৬শ টাকা। আজ যে শিশুটি জন্ম নেবে, তার মাথায়ও সমপরিমাণ ঋণের দায় চাপবে। গত এক বছরে মাথাপিছু ঋণ বেড়েছে ১০ হাজার ৮৩০ টাকা। আগামী এক বছরে এটা আরও প্রায় ১৫ হাজার টাকা বাড়বে। ফলে ওই সময়ে মাথাপিছু ঋণের স্থিতি দাঁড়াবে ১ লাখ ১১ হাজার টাকা।

এ কারণে ২০২২-২৩ অর্থবছরেও প্রস্তাবিত বাজেটেও ঋণের সুদ পরিশোধ চতুর্থ সর্বোচ্চ বরাদ্দ রেখেছে সরকার। অন্যদিকে প্রস্তাবিত বাজেটে মানুষের মাথাপিছু বরাদ্দ ৪১ হাজার ৯৩৩ টাকা। এ হিসাবে ঋণ মাথাপিছু বরাদ্দের দ্বিগুণেরও বেশি। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, কর আদায় করতে না পারায় সরকারকে বেশি ঋণের আশ্রয় নিতে হচ্ছে। আর এ অবস্থা চলতে থাকলে আগামী ৪ থেকে ৫ বছরের মধ্যে ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে।

জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, সরকার প্রতিবছর দেশীয় উৎস থেকে যে হারে ঋণ নিচ্ছে, তা অর্থনীতি ব্যবস্থাপনার জন্য ইতিবাচক নয়। কারণ সুদের হার বেড়ে যায়, যা বিনিয়োগকে বাধাগ্রস্ত করে। তিনি বলেন, প্রতিযোগী দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশে কর আদায়ের হার অত্যন্ত কম। বর্তমানে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) তুলনায় কর আদায় ১০ শতাংশের কম। অর্থনীতিকে আরও শক্তিশালী করতে হলে জিডিপির অনুপাতে কর আহরণ অন্তত ১৫ থেকে ১৬ শতাংশ থাকা উচিত। তিনি বলেন, করের হার বাড়াতে পারলে ঋণ কমবে। আর উচ্চ সুদে ঋণ নিয়ে বাজেট ঘাটতি মেটানো ভালো পদক্ষেপ নয়। এতে আর্থিক খাতের শৃঙ্খলা নষ্ট নয়।

অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে পাওয়া তথ্য অনুসারে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত দেশের অভ্যন্তরীণ ঋণের পরিমাণ ১৫ লাখ ৪৬ হাজার ২৪০ কোটি টাকা। এর মধ্যে বেসরকারি খাতে ঋণ ১২ লাখ ৭৮ হাজার ৮৫৫ কোটি এবং সরকারি ও রাষ্ট্রায়ত্ত মিলিয়ে ২ লাখ ৬৭ হাজার ৩৮৩ কোটি টাকা।

এ ছাড়াও এই পরিমাণ ঋণ জিডিপির প্রায় ৩৫ শতাংশের বেশি। অন্যদিকে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ তথ্য অনুসারে বর্তমানে দেশের জনসংখ্যা ১৬ কোটি ১৭ লাখের কিছু বেশি। এ হিসাবে প্রতিটি নাগরিকের মাথাপিছু ঋণ ৯৫ হাজার ৬শ টাকা। আগের বছরের একই সময়ে যা ছিল ৮৪ হাজার ৭৭০ টাকা। এ হিসাবে এক বছরে বেড়েছে ১০ হাজার ৮৩০ টাকা।

এরপর আগামী অর্থবছরে আরও ২ লাখ ৪১ হাজার ৭৯৪ কোটি টাকা ঋণ নিতে যাচ্ছে সরকার। এর মধ্যে বিদেশি ঋণ ৯৫ হাজার ৪৫৮ কোটি টাকা, বিভিন্ন ব্যাংক থেকে ঋণ ১ লাখ ৬ হাজার ৩৩৪ কোটি টাকা এবং সঞ্চয়পত্রের মাধ্যমে ৩৫ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেওয়া হবে। ফলে মাথাপিছু ঋণের স্থিতি আরও প্রায় ১৫ হাজার টাকা বাড়বে।

এই ঋণ অত্যন্ত ব্যয়বহুল। কারণ সঞ্চয়পত্রের মাধ্যমে যে ঋণ নেওয়া হয়, তার বিপরীতে সরকারকে বছরে ১০ শতাংশের বেশি সুদ গুনতে হচ্ছে। এ কারণে আগামী ২০২২-২৩ অর্থবছরে ঋণের সুদ পরিশোধে ৮০ হাজার ৩৯৪ কোটি টাকা বরাদ্দ রেখেছে সরকার, যা তিনটি পদ্মা সেতুর নির্মাণ ব্যয়ের প্রায় সমান। এক্ষেত্রে ঋণ না কমলে এই টাকা বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে ব্যয় করা যেত।

এ ব্যাপারে মির্জ্জা আজিজ আরও বলেন, আমাদের অভ্যন্তরীণ ঋণ অনেক ব্যয়বহুল। সেই ঋণের একটা মোটা অংশ যদি হয় সঞ্চয়পত্র, তাহলে তা আরও ব্যয়বহুল। সরকার ব্যয়বহুল ঋণ বেশি নিচ্ছে, এর অর্থই হচ্ছে স্বাস্থ্য ও শিক্ষার মতো অগ্রাধিকার খাতগুলোয় সরকার প্রয়োজন অনুযায়ী বরাদ্দ রাখতে পারছে না।

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, বাজেট মেটাতে অর্থায়নের বড় অংশই দেশীয় ঋণ। বিদেশি সহায়তা বাড়ানোর ওপর জোর দেন তিনি।

তিনি বলেন, ঋণ নির্ভরতা কমানোর জন্য রাজস্ব আয় বাড়াতে হবে। এক্ষেত্রে রাজস্ব খাতে বিভিন্ন সংস্কার জরুরি।

পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুরের মতে, সরকার ঠিকমতো ঋণ ব্যবস্থাপনা করতে পারছে না বলেই এর দায় নিতে হচ্ছে জনগণকে। তুলনামূলকভাবে বিদেশি ঋণ অনেক সাশ্রয়ী। কিন্তু সরকার সহজ পথ হিসাবে বেছে নেয় বেশি সুদের অভ্যন্তরীণ উৎসকে। এতে আর্থিক খাতে চাপ বেড়ে যায়।

বর্তমানে দেশে ব্যাপক মুদ্রার পরিমাণ ১৬ লাখ ২০ হাজার ৯৩৬ কোটি টাকা। এর মধ্যে মেয়াদি আমানত ১৪ লাখ ৮ হাজার ৬৬৬ কোটি টাকা এবং জনগণের হাতে নগদ টাকা ২ লাখ ১২ হাজার ২৭০ কোটি টাকা। আবার আমানতের মধ্যে মেয়াদি আমানত ১২ লাখ ৪৯ হাজার ১৬৩ কোটি টাকা এবং তলবি আমানত ১ লাখ ৫৯ হাজার ৫০৩ কোটি টাকা।

অর্থ বাণিজ্য জাতীয়