নানা পেশার আড়ালে তারা ভয়ঙ্কর ডাকাত চক্র

নানা পেশার আড়ালে তারা ভয়ঙ্কর ডাকাত চক্র

নিজস্ব প্রতিবেদক

অটোরিকশা চালক, তরকারি বিক্রেতা, রিকশাচালক কিংবা এমন নানা পেশার আড়ালে রাজধানীসহ বিভিন্ন মহাসড়ক দাপিয়ে বেড়াচ্ছে ভয়ঙ্কর ডাকাত চক্র। সাম্প্রতিক সময়ে ঢাকার আশুলিয়ায় হানিফ পরিবহন ও গোপালগঞ্জের কাশিয়ানীতে স্টার লাইন পরিবহনের বাসে ডাকাতিসহ বিভিন্ন সময়ে দূরপাল্লার বাসে ডাকাতির সঙ্গে জড়িত এমনই একটি দুর্ধর্ষ আন্তঃজেলা ডাকাত চক্রের ১০ সদস্যকে গ্রেফতার করেছে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন- র‌্যাব।

গ্রেফতারকৃতরা হলেন— চক্রের হোতা হিরা শেখ ওরফে কালাম শেখ ওরফে সোলেমান শেখ (৪০), তার সহযোগী যথাক্রমে- হাসান মোল্লা ওরফে ইশারত মোল্লা (৩৯), আরিফ প্রামাণিক ওরফে আরিফ হোসেন (৩৩), নুর ইসলাম (৫৩), রাজু শেখ ওরফে রাজ্জাক (৫৪), রেজাউল সরকার (৪৯), রতন (৩৬), শরীফুল ইসলাম (৩৯), হানিফ (৪২) এবং নজরুল ইসলাম (৩৫)।

রোববার (১২ জুন) দুপুরে র‍্যাব মিডিয়া সেন্টারে এক সংবাদ সম্মেলনে সংস্থাটির আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, গত ২৯ মে গোপালগঞ্জের কাশিয়ানীতে ঢাকা থেকে গোপালগঞ্জগামী স্টার লাইন পরিবহনে ডাকাতির ঘটনা ঘটে। ওই ঘটনার প্রেক্ষিতে গত ৮ জুন ডাকাত মহব্বত ওরফে রয়েলকে লুণ্ঠিত মালামালসহ রাজশাহী থেকে গ্রেফতার করে র‌্যাব। ডাকাত রয়েলকে জিজ্ঞাসাবাদে র‌্যাব গোয়েন্দারা বিভিন্ন ডাকাতির ঘটনা সম্পর্কে চাঞ্চল্যকর তথ্য পায়। র‌্যাব জানতে পারে ডাকাত হীরার নেতৃত্বে এই সংঘবদ্ধ ডাকাত দলটি গত এক মাসে তিনটি দূরপাল্লার বাসে দুর্ধর্ষ ডাকাতি করে। দুর্ধর্ষ এই ডাকাত চক্রটি গত ১১ মে চট্টগ্রাম হতে যশোর বেনাপোলগামী হানিফ পরিবহন, ২৫ মে ঢাকা-রাজশাহীগামী ন্যাশনাল ট্রাভেলস পরিবহন এবং ২৯ মে গোপালগঞ্জের কাশিয়ানীতে ঢাকা থেকে কোটালীপাড়াগামী স্টার লাইন পরিবহনে ডাকাতি করে বলে গোয়েন্দা সূত্রে জানা যায়। পরে র‌্যাব ওই ডাকাত চক্রটির ওপর গোয়েন্দা নজরদারি বৃদ্ধি করে। এরই ধারাবাহিকতায় গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে র‌্যাব সদর দফতরের গোয়েন্দা শাখা ও র‌্যাব-৮ এর একটি আভিযানিক দল শনিবার রাতে ঢাকার আশুলিয়া এলাকা থেকে ডাকাতির প্রাক্কালে ডাকাত সর্দার হিরা শেখসহ চক্রের ১০ সদস্যকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়। গ্রেফতারকালে তাদের কাছ থেকে ডাকাতিতে ব্যবহৃত একটি বিদেশি পিস্তল, তিন রাউন্ড গুলি, ৮টি দেশীয় অস্ত্র, ৪টি শ্যামলী এনআর ট্রাভেলসের টিকেট ও তিনটি ব্যাগ উদ্ধার করে।

প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেপ্তাররা জানায়, তারা একটি সংঘবদ্ধ ডাকাত চক্রের সদস্য। এই দলের সদস্য সংখ্যা ১২-১৫ জন। গ্রেপ্তার ডাকাত সর্দার হীরা ও তার অন্যতম সহযোগী হাসান মোল্লা বিভিন্ন ডাকাতির পরিকল্পনা করে থাকে। ডাকাত দলটি দীর্ঘদিন ধরে ঢাকা থেকে দেশের বিভিন্ন জেলামুখী যাত্রীবাহী বাসে উঠে ডাকাতি করে আসছিল। গত দুই বছরে তারা ১০-১৫টি বাসে ডাকাতি করেছে। আগেও চক্রটি ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে শ্যামলী পরিবহন ও মামুন ট্রাভেলস, ঢাকা-রাজশাহী মহাসড়কে ন্যাশনাল ট্রাভেলস ও একতা ট্রাভেলসে ডাকাতি করেছে বলে জানায়।

র‍্যাবের এই পরিচালক জানান, ঢাকা রুটের বাস ছাড়াও চট্টগ্রাম-সিলেট মহাসড়কে সৌদিয়া বাসে ডাকাতির সময় তারা বাস চালকের হাতে ও হেলপারের পেটে ছুরিকাঘাত করে। এছাড়া চক্রটি ঢাকা-খুলনা মহাসড়কে ফাল্গুনী ট্রাভেলস, সুন্দরবন এক্সপ্রেস ও কনক পরিবহন, ঢাকা-বরিশাল মহাসড়কে সুরভী পরিবহন, হানিফ পরিবহন, সিলেট-রাজশাহী মহাসড়কে শ্যামলী পরিবহন ও রইস পরিবহন, ঢাকা-পাবনা মহাসড়কে পাবনা এক্সপ্রেস ও সরকার ট্রাভেলস, রাজশাহী-বরিশাল মহাসড়কে সেবা গ্রিন লাইন পরিবহন ও তুহিন পরিবহনে ডাকাতি করেছে। সর্বশেষ তারা ঢাকা থেকে গোপালগঞ্জগামী স্টার লাইন পরিবহনে ডাকাতি করে।

জিজ্ঞাসাবাদে আরো জানান, ডাকাতির জন্য তারা ঢাকা থেকে দেশের বিভিন্ন দূরপাল্লার আন্তঃজেলা বাস সমূহকে টার্গেট করে। এক্ষেত্রে চক্রটির কয়েকজন পূর্ব থেকেই কাউন্টার থেকে টিকেট কেটে বাসে ওঠে। অন্য সদস্যরা পরবর্তী বিভিন্ন কাউন্টার থেকে টার্গেটকৃত বাসে ওঠে। তবে, যে সকল দূরপাল্লার বাস কাউন্টার ব্যতীতও যাত্রী উঠায় তারা এই সকল বাসকে বেশি প্রাধান্য দিয়ে ডাকাতি করে থাকে। সাধারণত তারা মহাসড়কের নির্জন এলাকায় বাস ডাকাতির জন্য বেছে নেয়। ডাকাতি করার পর তারা পুনরায় আশুলিয়ায় ফিরে আসে। এছাড়াও, বিভিন্ন সময় তারা বাড়ি ঘরে ডাকাতি করত। ইতোপূর্বে গ্রেফতারকৃত সকলেই ডাকাতিসহ অন্যান্য মামলায় ২ থেকে ৬ বছর মেয়াদে কারাভোগ করেছে।

গ্রেফতারকৃত হোতা হিরা শেখ জিজ্ঞাসাবাদে জানান, তিনি এই ডাকাত চক্রের অন্যতম মূল হোতা। পূর্বে তিনি গার্মেন্টস পণ্য বিক্রির সাথে জড়িত ছিলেন। পরবর্তীতে ডাকাতির পেশায় জড়িয়ে পড়েন। দীর্ঘ ১০ থেকে ১২ বছর যাবৎ ডাকাতি করে আসছেন। সাম্প্রতিক সময়ে ঘটে যাওয়া বেশ কয়েকটি বাস ডাকাতির ঘটনা তার নেতৃত্বে সংঘটিত হয়েছে। প্রত্যেকটি পরিবহনে ডাকাতিতে তিনি নিজে সশরীরে অংশগ্রহণ করেন। তার নামে দেশের বিভিন্ন থানায় ডাকাতিসহ অস্ত্র আইনে মোট ৭টি মামলা রয়েছে। গ্রেফতারকৃত হাসান মোল্লার বিরুদ্ধেও দেশের বিভিন্ন থানায় ডাকাতিসহ অস্ত্র আইনে মোট ১০টি মামলা রয়েছে।

এদিকে, গ্রেফতারকৃত নুর ইসলাম, হানিফ, আরিফ, শরীফ ও রতন এই চক্রের অন্যতম সদস্য। তারা পেশায় যথাক্রমে অটোরিকশা চালক ও পিকআপ ভ্যান চালকসহ অন্যান্য পেশার আড়ালে ডাকাতির সঙ্গে সম্পৃক্ত। বিগত দশ বছর যাবত তারা বিভিন্ন স্থানে ডাকাতি করে আসছে। সম্প্রতি ঘটে যাওয়া ডাকাতিতে তারা অংশগ্রহণ করে। ডাকাতির সময় তারা বাসের ড্রাইভারকে জিম্মি করে নিজেরাই বাসের ড্রাইভিং সিটের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিত। গ্রেফতারকৃত আরিফ ও শরীফ ড্রাইভার এবং সুপারভাইজারকে অস্ত্রের মুখে গাড়ির পেছনের সীটে হাত-পা বেধে রেখে তাদের পাহারা দিতেন। গ্রেফতারকৃত শরীফের নামে বিভিন্ন থানায় ডাকাতিসহ অন্যান্য অপরাধে ৮টি মামলা রয়েছে। এছাড়াও গ্রেফতারকৃত বাকি অন্যদের বিরুদ্ধে ন্যূনতম ২ থেকে ৬টি পর্যন্ত মামলা রয়েছে।

অপরাধ