রাজধানী ঢাকায় এখন ভয়ঙ্কর আতঙ্কের নাম ছিনতাইকারী চক্র। প্রতিদিন অসংখ্য যাত্রী ও পথচারী অজ্ঞান পার্টি ও ছিনতাইকারী কবলে পড়ে সর্বস্ব হারাচ্ছেন। ছিনতাইয়ে বাধা দিলেই জখম হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন অনেকেই।
চলতি বছরে ঢাকায় ছিনতাইকারীদের ছুরিকাঘাতে আহত হয়েছেন শতাধিক ব্যক্তি। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় ২০০ স্পটে ৫০টি ছিনতাইকারী চক্র সক্রিয়।
ঢাকায় প্রতি মাসে অন্তত ৩৫টি বড় ধরনের ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটছে। এসব সংঘবদ্ধ অজ্ঞান পার্টি ও ছিনতাইকারী চক্রের তৎপরতা দিন দিন বেপরোয়া হয়ে উঠছে।
ছিনতাইয়ের দৌরাত্ম্য বন্ধে চালানো হচ্ছে বিশেষ অভিযান। কিন্তু এতেও কোনো ফায়দা হচ্ছে না। অভিযানে আটক হলেও এসব অপরাধীরা অল্প দিনে জামিনে ছাড়া পেয়ে নতুন চক্র তৈরি করে।
পুলিশ বলছে, অভিযানে আটক এসব ছিনতাইকারীদের বিরুদ্ধে শক্ত কোনো প্রমাণ জোগাড় করতে না পারায় তারা সহজেই রেহাই পেয়ে যায়।
এদিকে পুলিশি তদন্ত পদ্ধতির পরিবর্তন এনে এসব মামলার তদন্ত কার্যক্রম দ্রুত সম্পন্ন করা গেলে এ পরিস্থিতির উন্নতি হবে বলে মনে করছেন আইন বিশেষজ্ঞরা।
র্যাব সূত্রে জানা যায়, রাজধানীতে ছিনতাই নিয়ন্ত্রণের জন্য গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে প্রায়ই বিশেষ অভিযান পরিচালিত হয়।
গত মঙ্গলবার রাতে রাজধানীর শাহবাগ, গুলিস্তান, ইত্তেফাক মোড়, হাতিরঝিল ও রমনা এলাকায় অভিযান চালিয়ে সংঘবদ্ধ এই মলম পার্টি ও ছিনতাইকারী চক্রের ৪৪ সদস্যকে গ্রেপ্তার করে র্যাব ৩-এর একাধিক দল। অজ্ঞান পার্টি ও ছিনতাইকারী চক্রের এসব সদস্যদের বেশির ভাগই মাদকাসক্ত।
এর আগে গত ২৬ মে রাজধানীর খিলগাঁও, শাহজাহানপুর, মুগদা, পল্টন এবং বংশাল থানা এলাকায় পৃথক অভিযান চালিয়ে ২৬ সদস্য গ্রেপ্তার করে দলটি। এসময় তাদের কাছ থেকে ছিনতাইয়ে ব্যবহূত ক্ষুর, চাকু ও নগদ টাকা উদ্ধার করা হয়।
অনুসন্ধানে দেখা যায়, এসব চক্র সালাম পার্টি, মলম পার্টি, অজ্ঞান পার্টি ও হ্যান্ডশেক পার্টি নামে পরিচিত। তাদের ছিনতাই ও অপরাধের ধরনও আলাদা। তারা বিভিন্ন বিভিন্ন কৌশলে কাজ করে।
এই চক্রের সদস্যরা অধিকাংশই গার্মেন্টসকর্মী, সিএনজি চালক ও ইটভাটার শ্রমিক। তারা সারা দিন কাজ করে রাতে সংগঠিত হয়ে এসব অপরাধ করছে। আসন্ন ঈদুল আজহাকে সামনে রেখে সংগঠিত হতে শুরু করেছে এসব অপরাধী চক্র। বিভিন্ন গরুর হাটেও এদের টার্গেটে রয়েছে।
র্যাব-৩ এর অতিরিক্তি পুলিশ সুপার (অপারেশন্স) বীণা রানী দাস বলেন, ‘অপরাধীদের গ্রেপ্তার করেও তেমন কোনো ফল পাওয়া যায় না। আমরা এসব অপরাধীকে ধরে পুলিশের কাছে হস্তান্তর করি। মামলা তদন্তের দায়িত্ব থাকে থানা পুলিশের ওপর। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এসব অপরাধী মাস না পেরোতেই জামিনে বেরিয়ে আসে। জামিনে বেরিয়ে আবার ছিনতাই শুরু করে। আর এদিকে একটা মালার তদন্ত্র শেষ করতে লেগে যায় চার থেকে পাঁচ বছর।
একটি গোয়েন্দা সূত্র বলছে, রাজধানীতে প্রতি মাসে ৩৫টি ছিনতাই সংঘটিত হচ্ছে। এ মুহূর্তে রাজধানীতে ২০০ স্পটে ৫০টি ছিনতাইকারী চক্র সক্রিয় রয়েছে। চক্রের সদস্যরা ছিনতাইয়ের সময় বাধা পেলে মরণ আঘাত করতেও পিছপা হয় না। চলতি বছরের পাঁচ মাসে এ পর্যন্ত ছিনতাইকারীদের ছুরিকাঘাতে আহত হয়েছেন শতাধিক ব্যক্তি। এসব ঘটনায় ৪১টি মামলা হয়েছে।
সম্প্রতি আলিমুজ্জামান নামে এক ব্যবসায়ী সম্প্রতি ২৩ লাখ ৬০ হাজার টাকা নিয়ে আদাবর থেকে রিকশায় ধানমন্ডি যাচ্ছিলেন। রিকশাটি মোহাম্মদপুর সাত মসজিদ রোডের ব্যাংক এশিয়ার সামনে পৌঁছলে একটি সুজুকি জিক্সার মোটরসাইকেলে করে তিন ছিনতাইকারী তার গতিরোধ করে এবং জোর করে টাকার ব্যাগ ছিনিয়ে নিয়ে চলে যায়। পোশাক ও কাগজের ব্যবসায়ী আলিমুজ্জামান এ ঘটনায় মোহাম্মদপুর থানায় একটি মামলা করেন।
মামলার বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা মহানগরীর তেজগাঁও বিভাগের মোহাম্মদপুর জোনের একজন পুলিশ কর্মকর্তা সাথে কথা বললে তিনি জানান, ছিনতাইয়ের টাকা উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। মামলাটি পুলিশ পিবিআইতে (পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন) পাঠানো হয়েছে। এখন মামলাটি তারা দেখছে। সাজ্জাদ মাহমুদ খান একটি দৈনিক পত্রিকার সাংবাদিক।
গত ৩০ মে অফিস শেষে তেজগাঁও শিল্প এলাকা থেকে রাত সাড়ে ৯টার দিকে রিকশাযোগে বাসায় ফিরছিলেন। কারওয়ান বাজার এফডিসির বিপরীত দিকের ফাঁকা রাস্তায় পৌঁছালে এক লোক রিকশা আটকে সামনে দাঁড়ায়। তার গায়ে রিকশা তুলে দেয়া হয়েছে এমন দাবি করে চালককে অশ্লীল গালি দিতে শুরু করে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই পাশ থেকে আরও তিন থেকে চারজন যোগ দিয়ে রিকশা টানতে টানতে গলিতে নিয়ে যায়।
তিনি বলেন, আমি সাহস করে নিজেকে সাংবাদিক পরিচয় দিলে ছিনতাই চক্রটি কিছুটা ভড়কে যায়। মিথ্যা বলছি এমন সন্দেহ করে প্রথমে আমার আইডি কার্ড দেখতে চায় তারা। পরে আইডি কার্ড দেখিয়ে ছাড়া পাই।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্ত জানান, ঢাকার রাস্তায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতার মাঝেও বেড়েছে ছিনতাইয়ের ঘটনা। বেপরোয়া হয়ে উঠেছে ছিনতাইকারী চক্র। সুযোগ পেলেই ছোঁ মেরে মোবাইল ফোনসহ জিনিসপত্র ছিনিয়ে নেয়। মধ্যরাত থেকে ভোর পর্যন্ত নগরীতে ছিনতাইয়ের ঘটনা বেশি ঘটছে। পথে পথে ওঁৎপেতে থাকা ছিনতাইকারী দলের সদস্যরা দিনে-দুপুরেও ছিনতাই করে।
তবে এসব ঘটনায় ভুক্তভোগীর বেশির ভাগই কোনো আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সহযোগিতা নেন না। তাই শক্ত প্রমাণ ও সাক্ষীর অভাবে অপরাধীরে শাস্তির আওতায় আনা সম্ভব হয় না। আর ছিনতাই মামলা দণ্ডবিধির ৩৯৩ ধারায় করা হয়, এটা অত্যন্ত দুর্বল হওয়ায় অপরাধী সহজে জামিন পাওয়া যায়।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যপক ড. সরকার আলী আক্কাস বলেন, ‘রাজধানীতে ছিনতাই চক্রের সাথে জড়িতদের ক্ষেত্রে অপরাধ প্রমাণ করা কঠিন হয়ে যায়। যখন দেখা যায় অপরাধের প্রমাণ পায় না বা প্রমাণ করা যায় না তখনই অপরাধী খালাস পেয়ে যায়। জামিনযোগ্য মামলা হলে বা অপরাধ প্রমাণ না করা গেলে বিচারককে বধ্য হয়েই জামিন দেন।
তবে আমাদের দেশে যে পুলিশের সাহায্যে তদন্ত করা হয়, এ সিস্টেম পরিবর্তন করা প্রয়োজন। এক্ষেত্রে আলাদা তদন্ত সেল করা যেতে পারে। দ্রুত তদন্তের ব্যবস্থা থাকতে হবে। অন্যান্য দেশে তদন্তের জন্য আলাদা ব্যবস্থা থাকে। তদন্তের জায়গায় আমাদের বড় দুর্বলতা রয়েছে।
তিনি আরও বলেন, দেশে রিমান্ড মানেই শাস্তি বা অত্যাচার মনে করা হয়। কিন্ত রিমান্ড মানেই অত্যাচার বা নির্যাতন না। রিমান্ড হলো জিজ্ঞাসাবাদের জন্য। আমার বিশ্বাস, রিমান্ড এবং তদন্তের পদ্ধতি পরিবর্তন করলে এই পরিস্থিতির উন্নতি হবে। এ ছাড়াও রাজধানীতে পুলিশি টহল বাড়াতে হবে।
ডিএমপির মুখপাত্র ফারুক হোসেন বলেন, ছিনতাইসহ যেকোনো অপরাধ নিয়ন্ত্রণে থানাগুলোতে টহল জোরদার করা ও নজরদারি বাড়ানোর নির্দেশ দেয়া হয়েছে।