নিজস্ব প্রতিবেদক
নভেল করোনাভাইরাসের সংক্রমণের ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে যখন সবে ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে বিশ্ব, ঠিক তখনই নতুন করে সংক্রমণ বৃদ্ধির শঙ্কা দেখা দিয়েছে। গতকাল ভারতে শনাক্তের সংখ্যা সর্বশেষ তিন মাসের রেকর্ড ছুঁয়েছে। একদিনেই দেশের ৮ হাজার ৫৮২ জন কভিড পজিটিভ হয়েছে। অন্যদিকে চীনের সাংহাইতে নতুন করে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কায় গণহারে পরীক্ষা শুরু হয়েছে। সরকারের জিরো কভিড নীতির পরও সেখানে একদিনে ৬১ জনের শরীরে ভাইরাসটির অস্তিত্ব শনাক্ত হওয়ায় নড়েচড়ে বসেছে চীন।
কেবল ভারত বা চীনই নয়, ধীরে হলেও বাংলাদেশে আবারো সংক্রমণ বাড়তে শুরু করেছে। গত প্রায় দুই মাস দেশে কভিড-১৯ রোগে আক্রান্ত শনাক্তের সংখ্যা কম ছিল। তবে চলতি মাসের শুরু থেকে প্রতিদিনই ধীরগতিতে বাড়ছে আক্রান্ত শনাক্তের সংখ্যা। গতকাল বাংলাদেশে নতুন ১০৯ জনের শরীরে এ ভাইরাসের সংক্রমণ পাওয়া যায়। আক্রান্তের এ সংখ্যা আশঙ্কাজনক না হলেও তাতে স্বস্তিবোধ করার সুযোগ নেই বলেই মনে করছেন রোগতত্ত্ব ও জনস্বাস্থ্যবিদরা।
সরকারের করোনাবিষয়ক তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ১২ দিন ধরে সংক্রমণ ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। গত শনিবার দৈনিক শনাক্তের সংখ্যা ছিল ৭১। একদিনের ব্যবধানে গতকাল তা দাঁড়ায় ১০৯-এ। এর আগে সর্বশেষ ২৫ মার্চ ১০০ জনের বেশি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়েছিল। যদিও চলতি মাসে এখন পর্যন্ত কোনো রোগীর মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়নি।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দেয়া দৈনিক করোনাবিষয়ক বিজ্ঞপ্তি বলছে, জুনের প্রথম দিন ৩৪ জনের শরীরে ভাইরাসটির সংক্রমণ শনাক্ত হয়। এরপর ২ জুন ২২ জন, ৩ জুন ২৯, ৪ জুন ৩১, ৫ জুন ৩৪, ৬ জুন ৪৩, ৭ জুন ৫৪, ৮ জুন ৫৮, ৯ জুন ৫৯ ও ১০ জুন ৬৪ জনের শরীরে এ ভাইরাসের উপস্থিতি পাওয়া যায়।
সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, দেশে এ পর্যন্ত কভিড-১৯ রোগে আক্রান্ত হয়েছে ১৯ লাখ ৫৪ হাজার ১১৫ জন। আর মারা গেছে ২৯ হাজার ১৩১ জন। সর্বশেষ ৯১ জন করোনা আক্রান্ত রোগী সুস্থ হয়ে ওঠায় মোট সুস্থতার সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৯ লাখ ৫ হাজার ২৬৬। এ পর্যন্ত দেশে মোট নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে ১ কোটি ৪১ লাখ ৮১ হাজার ৭৭৪ জনের। সারা দেশে সরকারি ও বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় ৮৭৯টি ল্যাবে গত ২৪ ঘণ্টায় ৫ হাজার ২৮০ জনের নমুনা পরীক্ষা করা হয়।
গত ২৪ ঘণ্টায় নমুনা পরীক্ষায় শনাক্তের হার ২ দশমিক শূন্য ৬ শতাংশ। এ পর্যন্ত নমুনা পরীক্ষা বিবেচনায় শনাক্তের হার ১৩ দশমিক ৭৮ শতাংশ। শনাক্ত বিবেচনায় সুস্থতার হার ৯৭ দশমিক ৫০ ও মৃত্যুহার ১ দশমিক ৪৯।
প্রায় দুই সপ্তাহ ধরেই করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বাড়ছে। এখনো সংখ্যায় অনেক বেশি হয়নি বলে তা আলোচনায় আসছে না। মার্চের শেষ দিকে দৈনিক শনাক্তের সংখ্যা ছিল ৫০০-এর বেশি। এরপর শনাক্তের সংখ্যা ১০-এও নেমে আসে। সংক্রমণ রোধে সাবধানতা অবলম্বন করার বিষয়ে সাধারণ মানুষের উদাসীনতার কারণে আক্রান্তের সংখ্যা আবারো বাড়তে শুরু করেছে বলে মনে করছেন রোগতত্ত্ববিদরা।
দেশে করোনা সংক্রমণের পরিসংখ্যানে উন্নতি দেখা গেলেও ধীরে ধীরে আক্রান্তের সংখ্যা বৃদ্ধির পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে বলে মনে করেন রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) উপদেষ্টা ও সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মুশতাক হোসেন। তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, বিভিন্ন দেশে আবারো নভেল করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বাড়তে শুরু করেছে। কভিড-১৯ এমনই একটি সংক্রামক রোগ, যাকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে বেশকিছু পদক্ষেপ নিতে হয়। সংক্রমণ বাড়লেও যেন হাসপাতালে চাপ না বাড়ে এজন্য টিকা কার্যক্রম জোরদার করতে হবে। ভাইরাসের গতিবিধির দিকে নজর রাখতে হবে। সংক্রমণ বাড়লে যেন ব্যবস্থা নেয়া যায় এজন্য পূর্বপ্রস্তুতি নিতে হবে। যেহেতু টিকা নেয়া আছে সেহেতু পরিস্থিতি খারাপ হওয়ার আশঙ্কা কম। তবে করোনার সংক্রমণ থেকে বাঁচতে হলে স্বাস্থ্যবিধি মানার বিকল্প নেই বলে মনে করেন এ রোগতত্ত্ববিদ।
এর আগে গত বছরের মার্চে নভেল করোনাভাইরাসের অতিসংক্রামক ধরন ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের কারণে সংক্রমণ বাড়তে শুরু করেছিল। এ পর্যায়ে উদ্বেগজনক পরিস্থিতি তৈরি হয় গত জুলাইয়ে। সংক্রমণ বেড়ে সে সময় দৈনিক শনাক্তের হার ৩০ শতাংশ ছাড়িয়ে যায়। সে সময় দেশে মৃত্যুহারও বেশি ছিল। এরপর নতুন ধরন ওমিক্রনের সংক্রমণ শুরু হয় গত বছরের ডিসেম্বরে। সে সময়ও সংক্রমণ ও মৃত্যু বাড়তে শুরু করে। তবে সে সময়ের পরিস্থিতি ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট সময়ের মতো ভয়াবহ হয়নি।
গত মে মাসের শুরুতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) বলেছিল, বাংলাদেশে করোনাভাইরাসে মৃতের সংখ্যা সরকারি হিসাবের তুলনায় পাঁচ গুণ বেশি। এছাড়া বিশ্বে কভিড-১৯ রোগে মোট মৃত্যু দেশগুলোর সরকারের প্রকাশিত সংখ্যার চেয়ে তিন গুণ বেশি। অনেক ক্ষেত্রে আক্রান্ত রোগীরা পর্যাপ্ত স্বাস্থ্যসেবা না পাওয়ায় মৃত্যু প্রভাবিত হয়েছে বলেও উল্লেখ করে জাতিসংঘের এ সংস্থা।
তবে নভেল করোনাভাইরাসের সংক্রমণ কম হোক বা বেশি হোক সবসময়ই সর্বোচ্চ প্রস্তুতি রাখা হচ্ছে বলে দাবি করেছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (প্রশাসন) অধ্যাপক ডা. আহমেদুল কবীর। তিনি বলেন, যেকোনো সময় আরো সংক্রমণ বাড়তে পারে সে বিবেচনা করেই আমরা প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নিয়ে রাখছি। সারা দেশে সরকারি হাসপাতালগুলোকে প্রস্তুত রাখা হয়েছে। অক্সিজেন থেকে শুরু করে জরুরি চিকিৎসার বিষয়গুলো আমরা বাড়িয়েছি। তবে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে জনসাধারণকেও সচেতন হতে হবে। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে।