ডেঙ্গু ভাইরাসের বাহক এডিস মশা শুধু দিনের বেলায় সকালে ও সন্ধ্যায় কামড়ায়। তাই ডেঙ্গু থেকে রক্ষা পেতে এই সময়ে মশারি টানানো এবং সন্ধ্যার আগেই দরজা-জানালা বন্ধের কথা বলতেন বিশেষজ্ঞরা। তবে এবার তাঁরা বলছেন, আলো দূষণের কারণে (রাতের বেলা দিনের মতো আলো) এডিসের চরিত্র পাল্টে গেছে। শুধু দিনের বেলায়ই নয়, এই মশা কামড়ায় রাতেও।
তাই সব সময় সতর্ক থাকতে হবে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কীটতত্ত্ববিদ ও গবেষক অধ্যাপক কবিরুল বাশার কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এডিস মশা শুধু দিনের বেলায় কামড়ায়, আসলে তা নয়। এটি শুধু দিনে নয়, রাতেও কামড়ায়। মূলত লাইট পলিউশনের কারণে এডিসের চরিত্র পাল্টে গেছে। ’
মশা মারার বাজেটে গবেষণায় বরাদ্দ থাকে না উল্লেখ করে কবিরুল বলেন, ‘থেমে থেমে বৃষ্টি হলে এডিসের পরিমাণ বেড়ে যায়। কীটনাশকে এডিস নিয়ন্ত্রণ করা যায় না, বরং পরিবেশগত পরিবর্তন প্রয়োজন। উৎস নিধনই এডিস মশক নিয়ন্ত্রণের সর্বোত্তম ও কার্যকর পদ্ধতি। সেটা আমাদেরই নিশ্চিত করতে হবে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা একেক দেশে একেকভাবে এডিস নিয়ন্ত্রণ করার নির্দেশ দিয়েছে। সিঙ্গাপুর ও ঢাকার সম্প্রসারণ সম্পূর্ণ আলাদা। আমাদের দেশে জুন থেকে অক্টোবর পর্যন্ত পদক্ষেপ নিলে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। ’
তিনি বলেন, ‘সম্প্রতি এক জরিপে আমরা দেখেছি, বিকেল ৫টা থেকে ৬টা পর্যন্ত ৫২০টি মশার কামড়ের মধ্যে ১৪০টি এডিস মশার। আর সন্ধ্যা ৬টা থেকে ৭টা পর্যন্ত তিন হাজার ১৪৬টির মধ্যে ৯২টি এডিস মশা। সন্ধ্যা ৭টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত ১৯ হাজার ১৭৪টি মশার কামড়ের ১৮টি এডিস মশার। রাত ৮টা থেকে ৯টা পর্যন্ত ১৪ হাজার ৩০০টি মশার কামড় পরীক্ষা করে দেখা যায় ১২টি এডিস মশার। ’
কবিরুল বাশার বলেন, ‘আমরা দেখেছি বহুতল ভবনের নিচতলা ও বেজমেন্টে ২৭.৭৮ শতাংশ, প্লাস্টিক ড্রামে ১২.৯৬ শতাংশ, প্লাস্টিক বক্সে ২০.৩৭ শতাংশ, পানির ট্যাংকিতে ৫.৫৬ শতাংশ এবং ফুলের টব ও গাছে ৭.৪১ শতাংশ এডিস মশার জন্ম হয়।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) সূত্র বলছে, ২০২১ সালে দক্ষিণের ১০টি অঞ্চলে ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযানে প্রায় এক কোটি টাকা জরিমানা করা হয়। এর পরও মানুষের মধ্যে কোনো পরিবর্তন আসেনি। এসব কাজ করতে গিয়ে অনেক সময় মশকনিধনকর্মীদের হয়রানির স্বীকার হতে হয়েছে। অথচ বাসাবাড়িতে জমে থাকা পানিতে এডিসের লার্ভা জন্মাচ্ছে। নিজ নিজ বাড়ি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখলে মশকনিধন কার্যক্রম সফল হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
এ বিষয়ে দক্ষিণের মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস বলেন, ‘ডেঙ্গু রোগের প্রকোপ নিয়ন্ত্রণে জনগণকে আরো সচেতন হতে হবে, তাদের দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিতে হবে। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনকে সহযোগিতা করতে হবে। আমরা প্রস্তুত সব উপাদান নিয়ে, সব অস্ত্র নিয়ে, সব সরঞ্জাম নিয়ে, জনগণ নিয়ে। সবচেয়ে বড় কথা, নিষ্ঠা ও দায়িত্ববোধ নিয়েও আমরা প্রস্তুত। ’ মেয়র বলেন, ‘আপনারা নিজ দায়িত্বে এডিস মশার উৎসস্থলগুলো ধ্বংস করুন। সচেতন নাগরিক হিসেবে আমাদের তথ্য দিয়ে সহায়তা করুন। ’
এডিসের চরিত্র বদল এবং বাড়ার কারণ সম্পর্কে নগর পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, ‘বিশ্বে যত মহামারি সৃষ্টি হয়েছে, সেসবের অন্যতম কারণ অপরিকল্পিত নগরায়ণ। একইভাবে ডেঙ্গু রোগের মূল কারণও নগরায়ণ ও জলবায়ু পরিবর্তন। মশা নিয়ন্ত্রণে চারটি কাজ করতে হবে। প্রথমত, উৎস ধ্বংস, দ্বিতীয়ত, রাসায়নিক কীটনাশক ব্যবহার, তৃতীয়ত, জীববৈচিত্র্য রক্ষা এবং সবশেষে ওয়ার্কার ম্যানেজমেন্ট করা। ’ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, ‘ঢাকায় এডিস ও কিউলেক্স দুই প্রকার মশা। কিউলেক্স বেশি কামড়ালেও মৃত্যু হয় না। আর এডিস মশার কামড়ে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয় বলে আমরা বেশি গুরুত্ব দেই। ২০০০ সালে ঢাকায় এডিসের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। এটি নির্মূলের ওষুধ এখনো আবিষ্কার হয়নি। এই মশার ডিমগুলো এক বছর অক্ষত থাকে ও পানি পেলে লার্ভা হয়ে ধীরে ধীরে মশায় পরিণত হয়। ’
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, গত শুক্রবার সকাল ৮টা থেকে গত শনিবার সকাল ৮টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় আরো ৩৩ জন ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়েছে। তাদের মধ্যে রাজধানীরই ৩১ জন। গত শনিবার পর্যন্ত হাসপাতালে ভর্তি রোগীর সংখ্যা ১২৭। তাদের মধ্যে ঢাকায় ভর্তি রয়েছে ১১৮ জন।