কোরবানির জন্য পশু কেনা থেকে শুরু করে সবকিছুই করে দিচ্ছে ডিজিটাল হাট। কিন্তু নানা ধরনের প্রতারণার কারণে দিন দিন ডিজিটাল হাটের প্রতি আগ্রহ কমছে মানুষের। গতবছর ডিজিটাল হাট থেকে গরু কিনে প্রতারিত হয়েছেন খোদ বাণিজ্যমন্ত্রী।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পশুর ছবি দেখে ডিজিটাল মাধ্যমে মূল্য পরিশোধ করে দিচ্ছেন অনেকেই। ঈদের আগের দিন পর্যন্ত লালন-পালনের শর্ত থাকছে। আবার অনেকেই পশু কোরবানি করে মাংস প্যাক করে বাসায় পৌঁছে দেওয়ার কথাও বলছেন। ঝামেলা এড়াতে রাজধানীর কর্মব্যস্ত অনেক মানুষ ডিজিটাল হাটের প্রতি ঝুঁকছেন। তবে গত দুই বছরের তুলনায় এবার ডিজিটাল হাটে তেমন সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না। অনেকেই অনলাইনে পশু দেখে সরাসরি খামারে গিয়ে কিনছেন। ২০২১ সালে উদ্বোধনের পরপরই ডিজিটাল হাট থেকে গরু কেনেন তিন মন্ত্রী। ওই বছর ৪ জুন ডিজিটাল হাট উদ্বোধন হওয়ার দিনই গরুকেনেন স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রী তাজুল ইসলাম, বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি এবং যোগাযোগ-প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমদ পলক।
এর কয়েক মাস পর বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি জানান, একটি ই-কমার্স সাইটের উদ্বোধনীতে কোরবানির জন্য ১ লাখ টাকায় গরুর অর্ডার দিয়ে কাক্সিক্ষত গরু পাননি। তিনি বলেন, আমাকে যে গরুটি দেখিয়েছিল, সেটি দেয়নি। পাঁচ-ছয় দিন পর জানাল আমাকে যে গরুটি দেখানো হয়েছিল, তা বিক্রি হয়ে গেছে। পরে আমাকে কম দামে অন্য একটি গরু দিয়েছিল। সঙ্গে একটি ছাগলও পেয়েছিলাম।
বাণিজ্যমন্ত্রী আরও বলেন, গরু পাওয়ার আগে টাকা পরিশোধ করে আমি তাদের কাছে বন্দি হয়ে গিয়েছিলাম। তাই পরে ওরা যে গরুটি দিয়েছে, তাই নিয়েছি।
ডিজিটাল মাধ্যমে গরু কিনে যেখানে মন্ত্রীই প্রতারিত হচ্ছেন সেখানে সাধারণ মানুষ ঠকার আশঙ্কা আরও বেশি। এ ছাড়া সম্প্রতি ইভ্যালি, কিউকম, ই-অরেঞ্জ, ধামাকা, আলাদিনের চেরাগ ও আলেশা মার্টের মতো চমকপ্রদ অফার নিয়ে আসা ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলো প্রতারণার করাণে বন্ধ করে দিয়েছে সরকার। এসব অনলাইন শপের প্রতারণার বিষয়গুলো বেশি আলোচিত হওয়ায় মানুষের আস্থা আরও কমেছে।
ক্রেতারা বলছেন, অনলাইনে সাধারণত ছবি দেখে গরু বুকিং দেওয়া হয়। আর বুকিং দিলে তাদের টাকা দিয়ে দিতে হয়। শর্ত থাকে ঈদের আগের রাত পর্যন্ত তারাই লালন-পালন করে দেবেন। সেক্ষেত্রে ঈদের আগের রাতে একজন ক্রেতা গিয়ে যদি ছবিতে দেখা তার গরুটা না পান তা হলে তিনি আর কী করতে পারবেন?
ঝামেলা এড়াতে মাংস বানিয়ে প্যাকেট করে দেওয়ার অনলাইন সার্ভিসেও প্রতারণার সুযোগ রয়েছে বলে জানিয়েছেন ক্রেতারা। তাদের ভাষ্য, যে গরুর ছবি দেখে টাকা পরিশোধ করা হলো, সেই গরুর মাংস না দিয়ে অন্য মাংস দিয়ে দেওয়ার সুযোগ রয়েছে। যেহেতু সরাসরি কেউ দেখছেন না।
এ ছাড়া গরু ওজন করার ক্ষেত্রেও ফাঁকফোকর রয়েছে। গরুকে বেশি পরিমাণ পানি খাইয়ে অনেকেই ওজন করে থাকেন। কিছুক্ষণ পর সেই ওজন আর থাকে না। কিন্তু টাকা পরিশোধ করতে হয় অনলাইনে দেখা ওজনেই। আবার অনলাইনে পশু রোগাক্রান্ত কি না তা যাচাই করার সুযোগ নেই। যদিও পশুর ছবি আপলোড করার সময় স্বাস্থ্য সনদের স্ক্যান কপিও আপলোড করার কথা বলছে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়।
তাই কোরবানির ক্ষেত্রে অতিরিক্ত আরামপ্রিয় না হয়ে অনলাইনে হলেও খামারে গিয়ে সরাসরি দেখে পশু কেনার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
এ প্রসঙ্গে কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, যারা অনলাইন বা ডিজিটাল প্লাটফর্ম থেকে পশু ক্রয় করবেন; তাদের অবশ্যই সতর্ক থাকতে হবে। কোনো মধ্যস্বত্বভোগীর কাছ থেকে পশু কেনা যাবে না। প্রতিষ্ঠিত খামার থেকে পশু কিনতে হবে। এতে ক্ষতিগ্রস্ত বা প্রতারিত হবে না ক্রেতারা। কেননা, এসব খামারি নিজেদের সুনাম ধরে রাখতে চান। সে কারণে এখানে প্রতারিত হওয়ার ঝুঁকি কম।
এসব প্রতারণার কারণে এ বছর এখনও তেমন সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না। ডিএনসিসির ডিজিটাল হাটসহ বেসরকারি অনলাইন প্লাটফর্মে কোরবানির পশু বেচাকেনা এখনও জমে ওঠেনি। তবে বিভিন্ন অনলাইন প্লাটফর্ম ছাড়াও ফেসবুক, ইউটিউবসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে গরু-ছাগাল বিক্রির জন্য নানা তৎপরতা চালাচ্ছেন খামারিরা। দুয়েকটি গুরু যাদের আছে এমন কৃষকও নিজের গরুর ছবি তুলে নিজের ফেসবুক ওয়াল কমিউনিটিভিত্তিক বিভিন্ন গ্রুপে শেয়ার করছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০২০ সালের ঈদুল আজহার সময় দেশে ডিজিটাল হাট শুরু হয়। তখন জনপ্রিয়তা পাওয়ায় আসন্ন ঈদে কোরবানির পশু বিক্রির জন্য অনলাইনে পশু কেনাবেচার জন্য সরকারের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, আইসিটি বিভাগের এটুআই প্রকল্প, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়, একশপ, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি), বাংলাদেশ ডেইরি ফারমার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিডিএফএ) ও ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ই-ক্যাব) ডিজিটাল হাট চালু করেছে। এ ছাড়া ভালো সাড়া পাওয়ায় এবার কেন্দ্রীয়ভাবে ‘ডিজিটাল পশুহাট’ বাসাচ্ছে সরকার।
সরকারের ডিজিটাল হাটের জন্য digitalhaat.gov.bd ওয়েবসাইট চালু করেছে আইসিটি বিভাগ। এ ওয়েবসাইটে ‘নিরাপদ থাকাটাই জরুরি এখন, হাটে না গিয়েও হাট যখন-তখন’, ‘এক ক্লিকে হাট থেকে হাতে’, ‘ডিজিটাল হাট থেকে দেশের যেকোনো প্রান্ত থেকে কিনতে পারেন পছন্দের কোরবানির পশু’- এমন সেøাগানে প্রচারণা চালানো হচ্ছে। এ ওয়েবসাইট ঘেঁটে দেখা যায়, এরই মধ্যে এতে দেশের বিভিন্ন এলাকার ৬৩টি পশুর খামার যুক্ত হয়েছে। পশুর ক্যাটাগরিতে গরু, ছাগল, ভেড়া, দুম্বা, উট, মহিষ রাখা হয়েছে। ক্রেতাদের যে পশু পছন্দ, ক্যাটাগরিতে ক্লিক করলেই বিস্তারিত তথ্য পাচ্ছেন।
এ প্রসঙ্গে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ে আন্তঃমন্ত্রণালয় থেকে বলা হয়েছে, অনলাইনে পশুর ছবি আপলোড করার আগে গবাদিপশুর স্বাস্থ্য সনদ নিতে হবে। এটি দেবেন সংশ্লিষ্ট ভেটেরিনারি সার্জনরা। প্রাণিসম্পদ অধিদফতর অনলাইনে গবাদিপশু বিক্রির জন্য খামারিদের সংশ্লিষ্ট অনলাইন প্লাটফর্মের সঙ্গে সংযোগে সহযোগিতা করবে এবং আপলোড করার ক্ষেত্রে মালিকের নাম, ঠিকানা, মোবাইল নম্বর, গবাদিপশুর বয়স, ওজন, মূল্য ও ছবি দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। আজ রোববার থেকে ডিজিটাল হাটের আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরু হওয়ার কথা রয়েছে।
খামার থেকেই পশু বুকিং : খামার থেকে অনলাইনে গরুসহ কোরবানির পশু পছন্দ করে বুকিং দিয়ে রাখছেন অনেকেই। জনপ্রিয় খামারগুলো সশরীরে গিয়েও পছন্দের পশু ক্রয় করছেন কেউ কেউ। তবে এসব পশু ঈদের আগের দিন পর্যন্ত খামারে রাখা ও খাওয়ানোর শর্তে ক্রয় করা হচ্ছে। আবার অনেকেই জায়গা ও ঝামেলা এড়াতে কোরবানি করে প্যাকেটজাত মাংস নিয়ে আসার শর্তেও পশু ক্রয় করছেন বলে জানা গেছে।
ঢাকার পাশর্^বর্তী উপজেলা সাভারের ভাকুর্তার নীলসাগর খামারের স্বত্বাধিকারী রিপন আহমেদ জানান, মে মাস থেকে কোরবানি পশু বুকিং শুরু হয়েছে। ইতোমধ্যে সিংহভাগ গরু বিক্রি শেষ। আর অল্প কিছু গরু রয়েছে, পরিচিত কিছু লোকের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে। এ সপ্তাহের মধ্যে বিক্রি হয়ে যাবে। তিনি বলেন, বেশিরভাগ গরু অনলাইনে বিক্রি হয়েছে তার। কিছু গরু ক্রেতারা সরাসরি দেখে গিয়ে, ডিজিটাল পেমেন্ট করেছে। ঈদের আগের দিন সন্ধ্যা বা ক্রেতার চাহিদা অনুযায়ী গরু খামারের ব্যবস্থাপনায় গরু পৌঁছে দেওয়া হবে।
সাদিক অ্যাগ্রোর স্বত্বাধিকারী এবং বাংলাদেশ ডেইরি ফারমার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মো. ইমরান হোসেন বলেন, গত বছর অনলাইনে সাড়ে ৩ লাখ গবাদিপশু বিক্রি হয়। এর বাজারমূল্য ছিল আড়াই হাজার কোটি টাকা। এ বছরও অনলাইনে বিক্রি হচ্ছে। এখনও সামনে কিছুদিন রয়েছে। আশা করা যাচ্ছে, এ সময়ের মধ্যে সরাসরি ও অনলাইনের বিক্রি জমে উঠবে।