মূল্যস্ফীতি সামাল দেওয়ার চ্যালেঞ্জ নিয়ে শুরু করা নতুন অর্থবছরে সীমিত সম্পদের যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করতে সরকার কৃচ্ছ্রসাধনের পথে হাঁটছে। অর্থবছরের শুরুতেই প্রকল্প বাস্তবায়নে অগ্রাধিকার দিতে প্রকল্পের ক্যাটাগরি নির্ধারণ, যানবাহন কেনা বন্ধ, সরঞ্জাম কেনায় বরাদ্দের অর্ধেক অর্থ ব্যবহার, উন্নয়ন প্রকল্পের বিভিন্ন কমিটির সম্মানী ব্যয় বন্ধ রাখার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। গতকাল রবিবার অর্থ মন্ত্রণালয় এ সংক্রান্ত তিনটি পরিপত্র জারি করেছে। সরকারের এ সিদ্ধান্ত গতকাল থেকেই কার্যকর হয়েছে।
অবশ্য বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ স্থিতিশীল রাখতে আমদানিনির্ভর কম গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প বাস্তবায়ন পিছিয়ে দেওয়ার নির্দেশনা অনেক আগেই দেওয়া হয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ‘সরকার অর্থবছরের শুরুতেই একটি ইতিবাচক সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আমি এটাকে সমর্থন করি। রাজস্ব আয়ের যে অবস্থা তাতে আগে থেকেই এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ব্যয় সংকোচনের কোনো বিকল্প নেই। তবে সরকারের কৃচ্ছ্রসাধনের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের জন্য একটি নীতিমালা দরকার। চলতি অর্থবছরের বাজেট নিয়ে আমরা যে বিশ্লেষণ দিয়েছি তার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ।’
‘উন্নয়ন কর্মসূচিভুক্ত প্রকল্পসমূহের অগ্রাধিকার নির্ধারণ ও সুষ্ঠু বাস্তবায়ন’ শীর্ষক পরিপত্রে বলা হয়েছে, বর্তমান বৈশ্বিক অর্থনৈতিক অবস্থার প্রেক্ষাপটে সরকারি ব্যয়ে কৃচ্ছ্রসাধনের লক্ষ্যে, সীমিত সম্পদের যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করতে চলতি অর্থবছরের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিভুক্ত প্রকল্পগুলো ‘এ’ ‘বি’ ও ‘সি’ এই তিন ক্যাটাগরিতে ভাগ করা হয়েছে। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিভুক্ত প্রকল্পগুলো সুষ্ঠুভাবে বাস্তবায়নের লক্ষ্যে মন্ত্রণালয়/বিভাগ/অন্যান্য প্রতিষ্ঠান এবং অধীন দপ্তর/সংস্থাগুলো ‘এ’ ক্যাটাগরি চিহ্নিত প্রকল্পের বাস্তবায়ন যথানিয়মে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে চলবে। ‘বি’ ক্যাটাগরির প্রকল্পগুলোর ক্ষেত্রে সরকারি (জিওবি) অংশের ২৫ শতাংশ সংরক্ষিত রেখে অনূর্ধ্ব ৭৫ শতাংশ ব্যয় করা যাবে। ‘সি’ ক্যাটাগরির প্রকল্পগুলোর অর্থ ছাড় আপাতত স্থগিত থাকবে। তবে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়/বিভাগ/অন্যান্য প্রতিষ্ঠান প্রয়োজন অনুসারে ‘সি’ ক্যাটাগরির প্রকল্পগুলোতে বরাদ্দ করা অর্থ আবার যোগ করে (প্রযোজ্য ক্ষেত্রে পরিকল্পনা কমিশন ও অর্থ বিভাগের পূর্বানুমতি গ্রহণপূর্বক) ‘এ’ ক্যাটাগরি চিহ্নিত প্রকল্পগুলোতে ব্যয় করতে পারবে।
এ পরিপত্রে বলা হয়েছে, ‘প্রকল্পের অর্থ ছাড়ের ক্ষেত্রে অর্থ বিভাগের উন্নয়ন প্রকল্পের অর্থ অবমুক্তি ও ব্যবহার নির্দেশিকা-২০১৮-সহ বিদ্যমান আর্থিক বিধিবিধান ও নিয়মাচার যথাযথভাবে অনুসরণ করতে হবে।’
‘পরিচালন ও উন্নয়ন বাজেটের কতিপয় ব্যয় স্থগিত বা হ্রাসকরণ’ শিরোনামের পরিপত্রে বলা হয়, বর্তমান বৈশ্বিক অর্থনৈতিক অবস্থার প্রেক্ষাপটে সরকারি ব্যয়ে কৃচ্ছ্রসাধনের লক্ষ্যে চলতি অর্থবছরে (২০২২-২৩) সব সরকারি, আধাসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত, রাষ্ট্রায়ত্ত, সংবিধিবদ্ধ, রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন কোম্পানি ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পরিচালন ও উন্নয়ন বাজেটে কিছু খাতে বরাদ্দ করা অর্থ ব্যয়ে সব ধরনের যানবাহন কেনা (মোটরযান, জলযান ও আকাশযান) বন্ধ থাকবে। শুধু জরুরি ও অপরিহার্য ক্ষেত্র বিবেচনায় আপ্যায়ন ব্যয়, ভ্রমণ ব্যয়, অন্যান্য মনিহারি, কম্পিউটার ও আনুষঙ্গিক, বৈদ্যুতিক সরঞ্জামাদি ও আসবাবপত্র খাতে বরাদ্দ করা অর্থের সর্বোচ্চ ৫০ শতাংশ ব্যয় করা যাবে। দেশে প্রশিক্ষণের ক্ষেত্রে প্রশিক্ষণ খাতে (প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান ব্যতীত) বরাদ্দ করা অর্থের সর্বোচ্চ ৫০ শতাংশ ব্যয় করা যাবে। এসব খাতে বরাদ্দ করা অর্থ অন্য কোনো খাতে যোগ করা যাবে না।
‘উন্নয়ন প্রকল্পের বিভিন্ন কমিটির সম্মানী বাবদ ব্যয় স্থগিতকরণ’ শীর্ষক পরিপত্রে বলা হয়েছে সব সরকারি, আধাসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত, সংবিধিবদ্ধ, রাষ্ট্রায়ত্ত, রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন কোম্পানি ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের উন্নয়ন বাজেট ও নিজস্ব তহবিলের আওতায় বাস্তবায়নাধীন সব ধরনের প্রকল্প/কর্মসূচি/স্কিমসমূহের ক্ষেত্রে প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি (পিআইসি), প্রকল্প স্টিয়ারিং কমিটি (পিএসসি), বিভাগীয় প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটি (ডিপিইসি), বিশেষ প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটি (এসপিইসি) এবং বিভাগীয় বিশেষ প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটি (ডিএসপিইসি) সভায় সম্মানী বাবদ কোনো অর্থ ব্যয় করা যাবে না।
চলতি অর্থবছরের বাজেট ঘোষণার আগেই সরকার ব্যয় সংকোচনের লক্ষ্যে বেশ কয়েকটি পদক্ষেপ নিয়েছে। করোনা মহামারীর ধাক্কা কাটিয়ে ওঠার আগে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ বিশ^বাজারে অস্থিরতা তৈরি করে। বেড়ে যায় ভোজ্য তেল, জ্বালানি তেল, খাদ্যপণ্যসহ বিভিন্ন পণ্যের দাম। বাজারে বৈদেশিক মুদ্রার প্রবাহ কমে যাওয়া এবং রপ্তানির তুলনায় আমদানি বেশি হওয়ায় মার্কিন ডলারের বাজারও অস্থির হয়ে উঠে। ফলে সরকারকে বিলাসী পণ্যের আমদানি বন্ধ, কয়েক দফা টাকার অবমূল্যায়নসহ বিভিন্ন পদক্ষেপ নিতে হয়।
গত ১১ মে সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত ও অর্থনৈতিক বিষয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠকের পর সাংবাদিকদের অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেন, ‘যেসব প্রকল্প বাস্তবায়নে বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় করা প্রয়োজন এবং সেসব প্রকল্প এখনই বাস্তবায়ন না করলে দেশের অর্থনীতিতে কোনো নেতিবাচক প্রভাব পড়বে না, সেগুলো আমরা ছয় মাস কিংবা আরও পরে বাস্তবায়ন করব।’
অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি অস্থিতিশীল ও কঠিন হয়ে পড়েছে, যার প্রভাব পড়ছে বাংলাদেশের ওপরও। যতদিন বহিঃখাতের এসব প্রভাব পুরোপুরি দূর না হবে, ততদিন বাংলাদেশকেও এ ধরনের কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘যেসব প্রকল্প এখনই বাস্তবায়ন করা না হলে অর্থনীতির ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে না, সেগুলো আমরা পরে বাস্তবায়ন করব। প্রকল্পগুলো বাতিল করা হচ্ছে না, শুধু বাস্তবায়নের সময় পিছিয়ে দেওয়া হচ্ছে।’
দেশে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ গত বছর আগস্টে ৪ হাজার ৮০০ কোটি ডলার থেকে চলতি মাসে ৪ হাজার ১০০ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে এসেছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের দ্রুত কমে যাওয়ার কারণে আমদানিনির্ভর কম গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প বাস্তবায়ন পিছিয়ে দেওয়ার কথা জানান অর্থমন্ত্রী।
গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক সেলিম রায়হান আমদানি নিয়ন্ত্রণে সরকারের প্রস্তাবিত এ কৌশলকে সমর্থন জানান। তিনি বলেন, ‘সরকার খুবই ভালো একটি সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এটা দরকার আছে। আরও কোন কোন জায়গায় কৃচ্ছ্রসাধন করা যায়, সরকারের এটা দেখা উচিত। কারণ আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর বড় একটা চাপ আছে। সরকারের আয়ের ওপরও একটা চাপ আছে। ব্যয় তো বাড়ছে অনেক। সেদিক থেকে আমি মনে করি উদ্যোগটা অবশ্যই প্রশংসনীয়। এটা বাস্তবায়ন করতে পাশাপাশি এ ধরনের আরও কিছু জায়গা আছে কি না বাজেটে সেটা বের করা দরকার। সরকারের খরচের জায়গাগুলো হয়তো আরও কমানো যেতে পারে।’
অর্থমন্ত্রী গত ৯ জুন জাতীয় সংসদে ‘কভিডের অভিঘাত পেরিয়ে উন্নয়নের ধারাবাহিকতায় পরিবর্তন’ স্লোগান সংবলিত এ বাজেট পেশ করেন। বৈশ্বিক মহামারী করোনা (কভিড-১৯) পরবর্তী অর্থনৈতিক পরিস্থিতি সফলভাবে মোকাবিলা করে চলমান উন্নয়ন বজায় রাখা ও উচ্চতর প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্য সামনে রেখে ২০২২-২৩ অর্থবছরের জন্য ৬ লাখ ৭৮ হাজার ৬৪ কোটি টাকার বাজেট প্রস্তাব করেন। ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটে পরিচালনসহ অন্যান্য খাতে ব্যয় ধরা হয়েছে ৪ লাখ ৩১ হাজার ৯৯ কোটি টাকা। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ২ লাখ ৪৬ হাজার ৬৬ কোটি টাকা।
বাজেটে মোট রাজস্ব আয় ধরা হয়েছে ৪ লাখ ৩৩ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড সূত্রে আয় ধরা হয়েছে ৩ লাখ ৭০ হাজার কোটি এবং অন্যান্য সূত্র থেকে কর রাজস্ব ধরা হয়েছে ৬৩ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে এনবিআরবহির্ভূত ১৮ হাজার কোটি, কর ব্যতীত প্রাপ্তি ৪৫ হাজার কোটি টাকা।
সামগ্রিক বাজেট ঘাটতি ২ লাখ ৪৫ হাজার ৬৪ কোটি টাকা দেখানো হয়েছে, যা জিডিপির ৫.৫ শতাংশ। ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেটে ঘাটতি ছিল জিডিপির ৬.২ শতাংশ।