গায়ে আগুন দিয়ে ব্যবসায়ীর আত্মহত্যা বেশি লাভের প্রলোভনে লিখিত চুক্তি ছাড়াই হেনোলাক্সে বিনিয়োগ

গায়ে আগুন দিয়ে ব্যবসায়ীর আত্মহত্যা বেশি লাভের প্রলোভনে লিখিত চুক্তি ছাড়াই হেনোলাক্সে বিনিয়োগ

নিজস্ব প্রতিবেদক

হেনোলাক্স কোম্পানিতে কুষ্টিয়ার ব্যবসায়ী আনিসুর রহমানের (গাজী আনিস) ১ কোটি ২৬ লাখ টাকা বিনিয়োগের কোনো লিখিত চুক্তি ছিল না। বেশি লাভের প্রলোভনে পড়ে লিখিত চুক্তি ছাড়াই তিনি সেখানে বিপুল পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ করেছিলেন। তিনি স্বজন ও বন্ধুদের কাছ থেকে এসব টাকা ধার নিয়েছিলেন।

কাউকে কাউকে লভ্যাংশ দেওয়ার কথা বলে টাকা নেন। কিন্তু বিনিয়োগ করে একদিকে অর্থ পাচ্ছিলেন না, অন্যদিকে পাওনাদারদের চাপ ছিল। এ পরিস্থিতিতে মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন আনিস। সেই হতাশা থেকে তিনি আত্মহত্যা করতে পারেন। আজ বুধবার রাজধানীর কারওয়ান বাজারে র‍্যাবের মিডিয়া সেন্টারে সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানানো হয়।

গাজী আনিসকে আত্মহত্যার প্ররোচনার অভিযোগে হেনোলাক্স কোম্পানির (আমিন ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানি) ব্যবস্থাপনা পরিচালক নুরুল আমিন এবং তাঁর স্ত্রী কোম্পানির পরিচালক ফাতেমা আমিনকে গতকাল উত্তরা থেকে গ্রেপ্তার করে র‍্যাব। তাঁদেরে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদ শেষে এই সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়।

সংবাদ সম্মেলনে র‍্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, আনিস সাহিত্যচর্চা করতেন। সাহিত্যচর্চার মাধ্যমেই ২০১৬ সালে আসামিদের সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়। ধীরে ধীরে তাঁদের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা বাড়ে। ২০১৮ সালে নুরুল আমিন ও তাঁর স্ত্রীর সঙ্গে দেশের বাইরে যান আনিস। ওই সময় আসামিরা তাঁকে হেনোলাক্স কোম্পানিতে বিনিয়োগের প্রস্তাব দেন। প্রাথমিকভাবে আনিস রাজি না হলেও বেশি মুনাফা, ব্যবসায়িক অংশীদার বানানোসহ নানা প্রলোভন দেখালে তিনি রাজি হন।

খন্দকার আল মঈন বলেন, প্রথমে এক কোটি টাকা বিনিয়োগ করেন আনিস। পরে আরও বেশি লভ্যাংশের আশায় ২৬ লাখ টাকা বিনিয়োগ করেন। নুরুল আমিন ও ফাতেমা আমিনের সঙ্গে সুসম্পর্ক থাকায় কোনো লিখিত চুক্তি করেননি তিনি। কয়েক মাস লভ্যাংশও দেওয়া হয় তাঁকে। একপর্যায়ে লভ্যাংশ দেওয়া হয়ে গেলে তিনি লিখিত চুক্তির চাপ দেন। কিন্তু এই দম্পতি চুক্তি করছিলেন না, টাকাও দিচ্ছিলেন না। টাকা ফেরত না পেয়ে তিনি চাপে পড়ে যান। পরে তিনি চেক জালিয়াতিসহ কুষ্টিয়ার আদালতে দুটি মামলা করেন। সেই দুই মামলা এখনো চলছে।

গাজী আনিস গত সোমবার জাতীয় প্রেসক্লাব চত্বরে নিজের গায়ে আগুন দেন। গতকাল মঙ্গলবার শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান। এ ঘটনায় গতকাল তাঁর ভাই নজরুল ইসলাম হেনোলাক্স কোম্পানির এমডি নুরুল আমিন ও তাঁর স্ত্রী ফাতেমা আমিনকে আসামি করে আত্মহত্যার প্ররোচনার অভিযোগে শাহবাগ থানায় মামলা করেন।

স্বজনেরা জানান, আনিসুর রহমান ১৯৯৩ সালে কুষ্টিয়া জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি ছিলেন। দুই বছর আগেও তিনি জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য ছিলেন। তাঁর গ্রামের বাড়ি কুষ্টিয়ার কুমারখালীতে। স্ত্রীর সঙ্গে তাঁর বিচ্ছেদ হয় সাত বছর আগে। তাঁর তিন মেয়ে। একজন এইচএসসি, একজন এসএসসি ও একজন প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ে। সন্তানেরা তাদের মায়ের সঙ্গে যশোরে থাকে।

র‍্যাবের মুখপাত্র খন্দকার আল মঈন বলেন, পাওনা টাকা ফেরত চেয়ে আনিস বিভিন্ন সময় আমিন দম্পতিকে অনুরোধ করেন। সর্বশেষ গত ২৯ মে জাতীয় প্রেসক্লাবে তিনি সংবাদ সম্মেলন করেন। ৩১ মে পুরো ঘটনা উল্লেখ করে ফেসবুকে পোস্ট দেন। ২৬ জুন পাওনা টাকা আদায়ের আশায় তিনি ঢাকায় আসেন। আনিস ১ কোটি ২৬ লাখ বিনিয়োগ করলেও লভ্যাংশসহ মোট পাওনা দাঁড়ায় প্রায় ৩ কোটি টাকা।

আনিসের ঘনিষ্ঠ সূত্র জানায়, আসামিরা আনিসকে চেক ও নগদে ৭৪ লাখ টাকা ফেরত দেন। বাকি টাকা দিতে গড়িমসি করছিলেন। ঢাকায় আসার পর আসামিরা তাঁকে বিভিন্ন তারিখ দিচ্ছিলেন। ৪ জুলাই তাঁকে চেক দেওয়ার কথা ছিল। ওইদিন সকালে আনিস তাঁর ভাইকে জানান, পুরো টাকা না দিলেও বড় অঙ্কের টাকা দেবে আমিন দম্পতি। কিন্তু বিকেল পর্যন্ত কোনো টাকা বা চেক না দেওয়ায় রাগে ক্ষোভে তিনি আত্মহত্যা করতে পারেন।

আমিন দম্পতির কাছে আরও কেউ টাকা পান কি না, এমন প্রশ্নে খন্দকার আল মঈন বলেন, প্রাথমিক জ্ঞিাসাবাদে তাঁরা দাবি করেছেন, তাঁদের কাছে আর কেউ টাকা পাবেন না। তা ছাড়া এখনো আর কেউ পাওনা টাকার দাবি করেননি।

র‍্যাব সূত্র জানায়, নুরুল আমিন ১৯৮১-১৯৯৬ সাল পর্যন্ত ঢাকার গোপীবাগে কাদের হোমিও হলে চাকরি করেন। চাকরিরত অবস্থায় ১৯৯১ সালে হেনোল্যাক্স কোম্পানি বানিয়ে ব্যবসা শুরু করেন। পরে সেটির নাম পরিবর্তন করে আমিন ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানি করেন। ২০০৯ সালে তিনি আমিন হারবাল নামে আরেকটি কোম্পানি গড়ে তোলেন। বাজারে হেনোলাক্সের চাহিদা কমে গেলে ২০১৬ সালে ব্যবসা বন্ধ করে দেন।

র‍্যাব জানায়, কাকরাইলে এই দম্পতির একটি ফ্ল্যাট, পুরানা পল্টনে স্কাই ভিউ হেনোলাক্স সেন্টার নামে একটি ১০ তলা ভবন, পিংক সিটিতে একটি ডুপ্লেক্স বাড়ি, মেরাজনগর কদমতলীতে হেনোলাক্স নামে চারতলা ভবন ও মোহাম্মদবাগ কদমতলী এলাকায় হেনোলাক্সের কারখানা রয়েছে।

অপরাধ