দুই সপ্তাহের বেশি সময় আগে সরকারের ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর ২০টি জেনেরিকের ৫৩ ধরনের ওষুধের দাম বাড়িয়েছে। তবে জনসাধারণকে জানাতে সেগুলোর তালিকা ও মূল্য প্রচারে উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। এদিকে মূল্যবৃদ্ধির অজুহাতে ইতোমধ্যেই ফার্মেসিগুলো অধিকাংশ ওষুধের বেশি দাম রাখছে।
এমন পরিস্থিতিতে ঔষধ প্রশাসন সংশ্লিষ্টরা দাবি করছেন, মূল্য নির্ধারণ তাদের কাজ হলেও প্রচারের দায়িত্ব উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মূল্য নির্ধারণের সঙ্গে তা প্রচার ও প্রকাশের দায়িত্বও ঔষধ প্রশাসনের। না হলে ক্রেতা-বিক্রেতাদের মধ্যে অধিদপ্তর ও কোম্পানির প্রতি অসন্তোষ তৈরি হবে। সাধারণ মানুষ আস্থা হারাবে।
ঔষধ প্রশাসন অধিপ্তর সূত্র জানায়, ওষুধের মূল্য বৃদ্ধির জন্য গত ৮ জুন টেকনিক্যাল সাবকমিটির সভা অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো নিয়মানুযায়ী আবেদন করা ওষুধের দাম নির্ধারণ করে মূল্য নিয়ন্ত্রণ কমিটিতে উপস্থাপনের সিদ্ধান্ত নেয়। কমিটির সিদ্ধান্ত অনুসারে প্রাইস ফিক্সেশন পলিসি অনুসরণ করে ৫৩টি ওষুধের খুচরা মূল্য অনুমোদনের আলোচনা হয়। এরপর গত ৩০ জুন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে অনুষ্ঠিত ওষুধের মূল্য নির্ধারণ কমিটির ৫৮তম সভায় এসব ওষুধের পুনর্র্নির্ধারিত দাম অনুমোদন করা হয়। সেখানে বলা হয়, এর আগে ২০১৫ সালে কয়েকটি কম্বিনেশনের মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছিল। সেই হিসাবে সাত বছর পরে অতিপ্রয়োজনীয় ওষুধের মূল্য নির্ধারণ করা হলো।
ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের পরিচালক মো. আইয়ুব হোসেন বলেন, তারা দাম নির্ধারণ করলেও তা জানানোর দায়িত্ব উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর। তাছাড়া বিজ্ঞাপন দেওয়ার কিছু নেই। এতে জনসাধারণ মনে করবে অধিদপ্তর নিজে ওষুধের দাম বাড়িয়েছে। তবে সর্বোচ্চ খুচরা মূল্যটাই নির্ধারিত থাকবে। কেউ যদি আগের উৎপাদিত ওষুধ বর্তমান মূল্যে বিক্রি করে সেটা অপরাধ হবে।
তিনি বলেন, ওষুধ উৎপাদনে ব্যবহৃত কাঁচামাল, এক্সিপিয়েন্ট, প্যাকেজিং উপকরণ, পরিবহণ ও বিতরণ ব্যয়, ডলারের বিনিময় মূল্য ও মূল্যস্ফীতি বেড়েছে। ফলে ওষুধ উৎপাদনের ব্যয় বেড়েছে। প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার জন্য তালিকাভুক্ত ১১৭টি জেনেরিকের বিভিন্ন ওষুধের বর্তমান উৎপাদন ব্যয় বেশি হওয়ায় বাজারে ঘাটতি দেখা দিয়েছে। ফলে বিভিন্ন উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ৫৩টি ওষুধের খুচরা মূল্য আপডেটের সিদ্ধান্ত হয়েছে।
তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লিনিক্যাল ফার্মেসি ও ফার্মাকোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক আব্দুর রহমান বলেন, ওষুধের দাম বৃদ্ধির ক্ষেত্রে একটা কমিটি থাকে। কমিটি আলোচনা করে যে সিদ্ধান্ত নেয় সেটা গোপন রাখার কিছু নেই। তাছাড়া এটি জনস্বাস্থ্যের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিষয়। অধিদপ্তর কেন এমন করছে বুঝে আসছে না। যেহেতু অধিদপ্তর দাম নির্ধারণ করেছে। ফলে সেটি প্রচারের দায়িত্বও তাদের। না হলে ক্রেতা-বিক্রেতা উভয় কোম্পানি ও অধিদপ্তরের প্রতি আস্থা হারাবে। এজন্য তেমন কোনো উদ্যোগ নিতে হবে না। গণমাধ্যমে বিজ্ঞপ্তি ও সংশ্লিষ্ট বরাবর চিঠি দিলেই হয়। না হলে বিষয়টি প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারে।
এদিকে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর ওষুধের দাম বাড়ানো, সাধারণ নাগরিকদের জন্য ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’ বলে মনে করে সাধারণ নাগরিকরা। নাগরিক সমাজ সংগঠনের আহ্বায়ক মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘দেশে প্রত্যেক পরিবারে মাসে গড়ে দুই থেকে আড়াই হাজার টাকার ওষুধ লাগে। সেখানে নিত্যপ্রয়োজনীয় ওষুধের মূল্য এভাবে বাড়ালে জীবনযাত্রায় ব্যাপক প্রভাব পড়বে। তাছাড়া মূল্য নির্ধারণ প্রক্রিয়ায় ভোক্তা প্রতিনিধিদের রাখার বাধ্যবাধকতা থাকলেও তা করা হয়নি। ব্যবসায়ীদের সুবিধা দিতেই নাগরিক প্রতিনিধিদের পাশ কাটানো হয়ছে। গত কয়েক বছরে জীবন বাঁচানোর উপকরণ এই ওষুধের মূল্য দফায় দফায় বাড়িয়েছে তারা।’
জানা গেছে নতুন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী প্যারাসিটামলের ১০টি ও মেট্রোনিডাজলের ছয়টি জেনেরিকের দাম বেড়েছে। মেট্রোনিডাজল ২০০ এমজি ট্যাবলেটের আগে দাম ছিল ৬০ পয়সা, যা বেড়ে হয়েছে এক টাকা। এমোক্সিসিলিন বিপি ৫০০ এমজি ইনজেকশনের আগের দাম ছিল ২৪ টাকা ১০ পয়সা, বর্তমানে বেড়ে হয়েছে ৫৫ টাকা। এছাড়া জাইলোমেট্রোজালিন, প্রোকলেপেরাজিন, ডায়াজেপাম, মিথাইলডোপা, ফ্লুরোসেমাইড, ফেনোবারাবিটাল, ওআরএস, লিডোকেইন, ফলিক অ্যাডিস, ক্লোরফেনিরামিন, বেনজাথিন বেনজিলপেনিসিলিন, অ্যাসপিরিন ফেনোক্সিমিথাইল পেনিসিলিন, নরগেস্টেরেল ও ফেরোসের দাম ৫০ থেকে ১০০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে।
এদিকে কয়েকদিন ধরে নগরীর ফার্মেসিগুলোতে একই ওষুধ ভিন্ন দামে বিক্রি হতে দেখা গেছে। ব্র্যান্ডভেদে কোনো কোনো ওষুধের দাম ভিন্ন রাখা হচ্ছে। যেমন সেফট্রিএক্সজন ৫০০ মিলিগ্রাম বেক্সিমকো, ইনসেপ্টা ও একমি বিক্রি করছে ১৩০ টাকা, অন্যদিকে রেডিয়েন্ট ফার্মা বিক্রি করছে ২২০ টাকা করে। রিভাসটিগমাইন পপুলার, জেনারেল ও সান ফার্মা ২৩ টাকা করে বিক্রি করলেও ইবনে সিনা বিক্রি করছে ১০ টাকা করে।
ভুক্তভোগীরা বলছেন, বাজারে এমন শত শত ওষুধের ব্র্যান্ডভেদে দামের পার্থক্য ১০ থেকে ১৫ রকম। যদিও ওষুধ কোম্পানির দাবি কাঁচামালের দামের পার্থক্যের কারণে দামের তারতম্য। কার্যকারিতা প্রায় সমান হলে বেশি দামের কাঁচামাল কেন আমদানি করবে বাংলাদেশ। আর কার্যকারিতা কম হলে কম দামে কাঁচামাল আমদানির অনুমতি দেবে কেন ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর। সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোর এমন ভূমিকা অসহায় রোগী ও তাদের পরিবারগুলো নিঃস্ব হচ্ছে বলে মন্তব্য করছেন তারা।