নিজস্ব প্রতিবেদক
ফেব্রুয়ারি মাসের শেষদিকে ইউক্রেনে হামলা চালায় রাশিয়া। চলমান যুদ্ধ পরিস্থিতিতে দেশ দুটি থেকে বাংলাদেশে গম ও সার আমদানির পথ বন্ধ হয়ে যায়। তবে রাশিয়ায় উৎপাদিত কৃষি ও চিকিত্সাপণ্য আমদানিতে কোনো নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়নি বলে সম্প্রতি জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেজারি বিভাগ। ঢাকায় মার্কিন দূতাবাসের মাধ্যমে পাঠানো একটি ফ্যাক্ট শিটের মাধ্যমে এ তথ্য নিশ্চিত করা হয়।
ফ্যাক্ট শিটে উল্লেখ করা হয়েছে, রাশিয়া ফেডারেশন-সংশ্লিষ্ট সারসহ কৃষিপণ্যের উৎপাদন, বিক্রয়, পরিবহন, কৃষি খাতে ব্যবহূত যন্ত্রাংশ অথবা ওষুধের ওপর যুক্তরাষ্ট্র কোনো নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেনি। কৃষিপণ্য, কৃষি যন্ত্রাংশ, ওষুধ ও চিকিত্সা খাতে ব্যবহূত যন্ত্রাংশের ক্ষেত্রে লেনদেনের সুবিধার্থে জেনারেল লাইসেন্স ইস্যু করেছে ট্রেজারি বিভাগের অফিস অব ফরেন অ্যাসেট কন্ট্রোল (ওএফএসি)। রাশিয়ায় উৎপাদিত বা রাশিয়া হয়ে আসা সারের ক্ষেত্রেও কোনো নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়নি বলেও জানানো হয়েছে ফ্যাক্ট শিটে।
রাশিয়া ও ইউক্রেন থেকে মূলত গম আমদানি করে বাংলাদেশ। উল্লেখযোগ্য পরিমাণ সারও আমদানি হয় রাশিয়া থেকে। যুদ্ধের কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে গমের দাম অনেকখানি বেড়ে যাওয়ায় উদ্বিগ্ন বাংলাদেশের সংশ্লিষ্টরা। তবে ট্রেজারি বিভাগের ঘোষণা বাস্তবায়ন হলে সেই উদ্বেগ দূর হবে বলে জানিয়েছেন তারা।
খাদ্য মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, ইউক্রেন-রাশিয়া থেকে পণ্য পরিবহনের যে পথ ব্যবহার হতো তা কৃষ্ণ সাগর। সেই পথ দিয়ে কোনো পণ্য পরিবহন করা যাচ্ছিল না। ফলে আমদানি বাধাগ্রস্ত হচ্ছিল। দ্বিতীয়ত, ব্যাংকের মাধ্যমে লেনদেনও বাধাগ্রস্ত হচ্ছিল। এ দুভাবেই আমদানি বাধাগ্রস্ত হচ্ছিল। যুক্তরাষ্ট্র ট্রেজারি বিভাগের ঘোষণাটি বাংলাদেশসহ আমদানিনির্ভর সব দেশের জন্য সুবিধাজনক হবে।
যুক্তরাষ্ট্র ট্রেজারি বিভাগের ঘোষণার প্রভাব সম্পর্কে জানতে চাইলে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. ইসমাইল হোসেন এনডিসি বলেন, ‘প্রভাব অবশ্যই ইতিবাচক। এ ঘোষণা যখন বাস্তবায়ন হবে তখন ইউক্রেন-রাশিয়া থেকে গম বা খাদ্যশস্য আমদানির বিষয়টি বাধাগ্রস্ত হবে না। দামও ন্যায্য হবে। সামগ্রিকভাবেই আমাদের জন্য এটা ইতিবাচক একটি খবর।’
ব্যক্তি খাতের উদ্যোক্তারাও বিষয়টিকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন, তবে গম আমদানিকারকদের মধ্যে এখনো ঘোষণার যথাযথ বাস্তবায়ন নিয়ে দ্বিধা রয়েছে। দেশের অন্যতম ভোগ্যপণ্য আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান বিএসএম গ্রুপের চেয়ারম্যান আবুল বশর চৌধুরী বলেন, ট্রেজারি বিভাগের এ ঘোষণার কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন রয়ে গেছে। ইউক্রেনে আক্রমণ শুরুর পর যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়ার ওপর হাজার হাজার নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। খাদ্যশস্যের বিশ্ববাজারে ইউক্রেন ও রাশিয়ার বড় অংশগ্রহণ থাকায় যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা দুনিয়াজুড়ে সংকট তৈরি করেছে। রাশিয়ার ওপর খাদ্যপণ্যের সরাসরি কোনো নিষেধাজ্ঞা না দিলেও কোনো ব্যাংকই রুশ ব্যাংকের সঙ্গে ঋণপত্র খুলছে না। রাশিয়ার ব্যাংকের সঙ্গে লেনদেনের মাধ্যমে কেউই অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়তে চাইছে না। ফলে লেনদেন পদ্ধতি অনিশ্চিত হয়ে যাওয়ায় পণ্য আমদানি করা সম্ভব নয়।
তিনি আরো জানান, রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞার মানে হলো ইউক্রেন থেকে পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে একই অবস্থা। ইউক্রেনের প্রধান বন্দর রাশিয়ার দখলে থাকায় ইউরোপের বড় শস্যক্ষেত্রটি গোটা বিশ্বের কাছ থেকে অনেকটা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। তবে বিকল্প বেশকিছু দেশের উৎপাদন বৃদ্ধি ও সরবরাহ বেড়ে যাওয়ায় গমের বৈশ্বিক বাজার সাম্প্রতিক সময়ে ১০ শতাংশ কমেছে। কিন্তু বাংলাদেশের ডলার মূল্যহার ১৫ থেকে ১৭ শতাংশ বেড়ে যাওয়ায় দাম কমার প্রভাব পড়ছে কম।
ওএফএসির ঘোষণা খুবই ইতিবাচক উল্লেখ করে এফবিসিসিআইয়ের সিনিয়র সহসভাপতি মোস্তফা আজাদ চৌধুরী বাবু বলেন, কয়েকদিন আগেও কৃষ্ণ সাগর দিয়ে ইউক্রেন ও রাশিয়া যেন সব ধরনের পণ্য রফতানি করতে পারে তা নিয়ে আলোচনা হচ্ছিল। এখন ট্রেজারি বিভাগের ঘোষণা বাস্তবায়নের মাধ্যমে যদি গম, সানফ্লাওয়ার অয়েল রফতানি হয় তাহলে আমাদের সয়াবিন তেলের দাম, গমের দাম কমে যাবে। গমজাতীয় খাদ্য বা বেকারির দামও কমে আসবে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, ২০২১-২২ অর্থবছরে আমদানি হয়েছে ৪০ লাখ টন গম। যদিও ২০২০-২১ অর্থবছরে দেশে গম আমদানি হয়েছে ৫৪ দশমিক ৪৩ লাখ টন। ২০১৯-২০ অর্থবছরে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে গম আমদানি হয়েছিল ৬৪ লাখ ৩৪ হাজার টন। এছাড়া ২০১৮-১৯ অর্থবছরে আমদানি হয়েছিল ৫৬ লাখ ২৯ হাজার টন ও ২০১৭-১৮ অর্থবছরে আমদানি হয়েছিল ৫৮ লাখ ৮১ হাজার টন গম।
কৃষি মন্ত্রণালয় ও বিএডিসি সূত্র জানিয়েছে, গত অর্থবছরে ৬৯ লাখ টন সার ব্যবহার হয়েছে বাংলাদেশে। এর মধ্যে ইউরিয়া, টিএসপি, ডিএপি ও এমওপি এ চার ধরনের সার ব্যবহার হয় ৫৭ লাখ টন। আগামী ২০২২-২৩ অর্থবছরে ওই চার ধরনের সারের চাহিদা কমিয়ে ৫৫ লাখ ৫০ হাজার টনে নামিয়ে আনা হয়েছে। দেশে প্রয়োজনীয় সারের ৮০ শতাংশই বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। এর মধ্যে এমওপি সারের বড় অংশ আসে রাশিয়া ও বেলারুশ থেকে।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব বলাই কৃষ্ণ হাজরা বলেন, ‘যতক্ষণ পর্যন্ত বাংলাদেশ ব্যাংক সার্কুলারের মাধ্যমে বিষয়টি নিশ্চিত করছে ততক্ষণ পর্যন্ত ট্রেজারি বিভাগের কোনো ঘোষণা কার্যকারিতা আমরা পাব না। যদি ঘোষণাটি বাস্তব ও কার্যকর হয় তাহলে তা অবশ্যই আমাদের জন্য মঙ্গলজনক।’