ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক যেন এখন বৃদ্ধ মোস্তাফিজুর রহমান বাবলুর কাছে আতঙ্কের নাম। দুই যুগ আগে এ সড়কেই প্রাণ হারান তার ছোট ভাই ফজলুল হক। ২০০৪ সালে নিহত হয় বাবলুর ছোট ছেলে শামসুল হক। আর এবার বড় ছেলে, পুত্রবধূ ও নাতনিকে কেড়ে নিল। সবারই কবর দেওয়া হয়েছে পাশাপাশি, বাড়ির উঠানে। সেখানেই দাঁড়িয়ে কাঁদছিলেন সত্তরোর্ধ্ব প্রতিবন্ধী বাবলু। তবে চর জেগেছে বিরহী হৃদয়ে, শুকিয়ে কাঠ নয়নধারা। তাই কাঁদলেও দুচোখ বেয়ে আর জল গড়ায় না। গলা ধরে আসা কণ্ঠে শুধু বললেন, ‘আমি কী নিয়ে বাঁচব, আল্লাহ আমাকে কোন পরীক্ষায় ফেলেছেন? তবে আমার যত কষ্টই হোক, যতদিন বেঁচে আছি আমার ছেলের রেখে যাওয়া মেয়েকে বুকে আগলে রাখব।’
ত্রিশাল উপজেলার মঠবাড়ী ইউনিয়নের রায়মনি মোস্তাফিজুর রহমানদের বাড়ি। গতকাল রবিবার সকালে গিয়ে দেখা যায়, ঘরের সামনেই উঠানে পাশাপাশি তিনটি নতুন কবর। যেখানে শায়িত হয়েছেন দিনমজুর জাহাঙ্গীর আলম, তার স্ত্রী রত্না বেগম ও মেয়ে সানজিদা। একসঙ্গে তিনজনকে হারিয়ে কবরগুলোর পাশে বসেই অনবরত বিলাপ করছিলেন জাহাঙ্গীরের বৃদ্ধ মা সুফিয়া আক্তার। একটু দূরেই ঠায় দাঁড়িয়ে জাহাঙ্গীর-রত্না দম্পতির শিশুকন্যা জান্নাত ও ছেলে এবাদত। দুজনই বাকরুদ্ধ। স্বজনদের ভিড়ে কেবল মা-বাবাকেই খোঁজে ফিরছিল তাদের শিশুনয়ন।
মোস্তাফিজুর রহমান বাবলু ও স্ত্রী সুফিয়া আক্তার দুজনই শারীরিক প্রতিবন্ধী। তারা জানান, জায়গা-জমি না থাকায় বাড়ির উঠানেই বানিয়েছেন কবরস্থান। থাকার ঘরটিও ভাঙা টিন আর মাটির তৈরি। দরিদ্র পরিবারে জাহাঙ্গীরই ছিল উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। তাকেসহ তিনজনকে একসঙ্গে হারিয়ে আরও অসহায় হয়ে পড়েছেন তারা। এখন নবজাতকসহ তিন সন্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে এই বৃদ্ধ দম্পতি পড়েছেন অনিশ্চয়তার মুখে। নিহত জাহাঙ্গীরের চাচাতো ভাই সাগর হোসেন জানান, বৃদ্ধ বাবলু ছোট একটা টং দোকান দিয়ে সংসার চালাতেন। কিন্তু এখন আর পেরে উঠেন না। তাই পরিবারে একমাত্র উপার্জনক্ষম ছিলেন নিহত জাহাঙ্গীর। তার বড় মেয়ে জান্নাত স্থানীয় ব্র্যাক স্কুলে চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ে। আরেকজন ছেলে এখনো ছোট স্থানীয় মক্তবে যাওয়া-আসা করে। এর আগেও জাহাঙ্গীরের ছোট ভাই সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয় বলে জানান সাগর।
এদিকে পরিবারটির খোঁজ-খবর নিতে গতকাল দুপুরে তাদের বাড়িতে গিয়েছিলেন উপজেলা নির্বাহী অফিসার আক্তারুজ্জামান। এ সময় জাঙ্গীরের ছোট দুই সন্তানকে কোলে নিয়ে সান্ত¡না দেন। উপজেলা পরিষদ থেকে অনুদান দেন নগদ ১০ হাজার টাকা।
ত্রিশালের কোর্টভবন এলাকায় সড়ক পারাপারের সময় গত শনিবার ট্রাকচাপায় প্রাণ হারান অন্তঃসত্ত্বা রত্না বেগম (৩২), স্বামী জাহাঙ্গীর আলম (৪০) এবং তাদের ছয় বছরের মেয়ে সানজিদা। এ সময় অলৌকিকভাবে মায়ের গর্ভ ফেটে ভূমিষ্ঠ হয় ফুটফুটে এক নবজাতক। সঙ্গে সঙ্গে ছুটে যায় পুলিশ ও আশপাশের লোকজন। পরে নবজাতকটিকে উদ্ধার করে নেওয়া হয় উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। সেখানেই জানা যায় জীবিত আছে সেই নবজাতক। প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে তাকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও উন্নত চিকিৎসার জন্য নেওয়া হয় ময়মনসিংহ সদরের সিবিএমসি হাসপাতালে। তবে এক্সরে রিপোর্টে জানা যায়, নবজাতকের ডান হাতের দুটি হাড় ভেঙে গেছে। পরে ময়মনসিংহের লাবীব হাসপাতালের পরিচালক নিজ দায়িত্বে চিকিৎসা ব্যবস্থাসহ দেখভালের দায়িত্ব নেন।
দুর্ঘটনার বিষয়ে ত্রিশাল থানার ওসি মাইন উদ্দিন বলেন, ‘এ ঘটনায় একটি মামলা হয়েছে। ঘাতক ট্রাকটিকে আটক করে থানায় নিয়ে আসা হয়েছে। আসামিকেও গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।’
বেঁচে যাওয়া শিশুর দেখভালে ক্ষতিপূরণ চেয়ে আবেদন : সড়ক দুর্ঘটনায় অলৌকিকভাবে বেঁচে যাওয়া শিশুর বিষয়টি হাইকোর্টের নজরে এনেছেন সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার মাহাসিব হোসেন। বিচারপতি ভীষ্মদেব চক্রবর্তী ও বিচারপতি এসএম মনিরুজ্জামানের হাইকোর্ট বেঞ্চে গতকাল বিষয়টি তিনি নজরে আনেন। বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদন উপস্থাপন করে মাহাসিব হোসেন শিশুর দেখভাল ও ভবিষ্যতের জন্য ক্ষতিপূরণ দিতে আদালতের কাছে স্বপ্রণোদিত আদেশ প্রার্থনা করেন। তখন আদালত তাকে বিষয়টি আবেদন আকারে নিয়ে আসতে বলেন।
ব্যারিস্টার মাহাসিব হোসেন বলেন, ‘ময়মনসিংহের ত্রিশালে ট্রাকচাপায় নিহত হন এক অন্তঃসত্ত্বা নারী, তার স্বামী ও মেয়েসহ তিনজন। ওই ঘটনায় বিভিন্ন মাধ্যমে খবর দেখার পর রাত থেকে কিছুই ভালো লাগছিল না। তাই কোর্টে আবেদন করব বলে ভাবছিলাম। তবে এত দ্রুত আবেদন প্রস্তুত করা সম্ভব না হওয়ায় বিষয়টি আদালতের নজরে এনে সুয়োমোটো আদেশ দেওয়ার আর্জি জানিয়েছিলাম। কিন্তু আদালত আবেদন আকারে নিয়ে যেতে বলেছেন। এখন দেখি শিশুসহ ওই পরিবারের বেঁচে থাকা সদস্যদের দায়িত্ব কেউ নেন কি-না। তরপরে আবেদনের চিন্তা রয়েছে।’
নবজাতককে বুকের দুধ খাওয়াচ্ছেন প্রসূতি মায়েরা : ট্রাকচাপায় মা, বাবা ও বোন হারানো সেই নবজাতক এখন ময়মনসিংহ নগরীর চরপাড়া এলাকার লাবীব হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। তাকে বুকের দুধ খাওয়াচ্ছেন হাসপাতালে ভর্তি থাকা প্রসূতি মায়েরা। এ বিষয়ে লাবীব হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. শাহজাহান বলেন, ‘নবজাতকের পাশের বেডে ভর্তি থাকা এক প্রসূতি মা ওই নবজাতককে বুকের দুধ পান করাচ্ছেন। এতে বাচ্চাটির খাবারের চাহিদা পূরণ হচ্ছে। আশা করছি সে দ্রুতই পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠবে।’ হাসপাতালের নার্স সুরাইয়া ইয়াসমিন বলেন, ‘শনিবার রাতে এক প্রসূতি তার বুকের দুধ দিয়েছিলেন। গতকাল তার ছুটি হয়ে গেছে। পরে নাছিমা বেগম নামে আরেক প্রসূতি তিনবার দুধ দিয়েছেন। গতকাল তারও ছুটি হয়ে যায়। তবে হাসপাতালে আরও প্রসূতি আছেন। তারা স্বেচ্ছায় ওই শিশুকে বুকের দুধ খাওয়ানোর জন্য রাজি আছেন।’
দায়িত্ব নিতে চান ব্যবসায়ী : দিনমজুর জাহাঙ্গীর আলমের নবজাতকের চিকিৎসা ব্যয়ভারসহ সব দায়িত্ব নিতে চান ত্রিশালের এক ব্যবসায়ী। এদিকে অনেকেই দত্তক নিতে চাইলেও শিশুটিকে দত্তক দেওয়া হবে না বলে জানিয়েছেন স্বজনরা।