নিত্যপণ্যের বাজার চড়া বহু দিন ধরে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি। জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়ায় কষ্টে আছে দেশের মানুষ। এ গরমের মধ্যেই জ্বালানিসংকটের কারণে শুরু হয়েছে বিদ্যুতের লোডশেডিং। চাপে পড়েছে সরকারের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড। এসব নিয়ে চিন্তিত ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। এ অবস্থায় দীর্ঘদিন চলতে থাকলে জনগণ অস্থির হয়ে উঠতে পারে বলেও মনে করছেন দলটির নীতিনির্ধারকেরা।
আওয়ামী লীগের নীতনির্ধারণী পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে কথা বলে তাঁদের এ মনোভাবের কথা জানা গেছে। তবে দলটির নেতারা এ–ও মনে করছেন, বর্তমান পরিস্থিতির মূলে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, সংকট বৈশ্বিক।
উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সরকার কৃচ্ছ্রসাধনে যেসব সিদ্ধান্ত নিচ্ছে, আপাতত এর আর কোনো বিকল্প নেই। তবে জনগণের মধ্যে যাতে আতঙ্ক তৈরি না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। দ্রুত পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে দৃশ্যমান উদ্যোগ নিতে হবে।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে, সেখানে আমাদের কোনো হাত নেই। তাই বলে সরকার বসে নেই।
আব্দুর রাজ্জাক, সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য আ.লীগ ও কৃষিমন্ত্রী
তবে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের দীর্ঘদিনের মিত্র ১৪ দলের শরিক এবং জাতীয় পার্টি (জাপা) বর্তমান সংকটের পেছনে সরকারের ভুল নীতি দেখছে। তারা বলছে, আন্তর্জাতিক কারণে বর্তমান সংকটের শুরু—এ কথা ঠিক। তবে সরকারের ভুল নীতি, দুর্নীতি, দেশ থেকে টাকা পাচার এবং সাধারণ মানুষের সঙ্গে আওয়ামী লীগের নেতা–কর্মীদের ক্রমে দূরত্ব বৃদ্ধি সংকট আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে সরকারের ব্যর্থতার দায় নিতে রাজি নয় তারা।
১৪ দলের শরিক ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন বলেন, সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশ এখন কঠিন পরিস্থিতি পার করছে। এর কারণ বৈশ্বিক। তবে সরকারের ভুল নীতি ও দুর্নীতির দায় আছে। তিনি বলেন, গুটিকয় ব্যবসায়ীর স্বার্থে সরকার আমদানিনির্ভর জ্বালানি নীতি নিয়েছে। দেশের গ্যাস উত্তোলনে ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। মেনন মনে করেন, দ্রব্যমূল্যের কারণে মানুষের কষ্ট কমাতে হলে কৃষি উৎপাদনে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া দরকার।
জাতীয় সংসদের বিরোধী দলের উপনেতা ও জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদের মনে করেন, রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধ বর্তমানের সংকটের জন্য এককভাবে দায়ী নয়। যুদ্ধ সংকট ত্বরান্বিত করেছে। যুদ্ধ না হলেও ভবিষ্যতে সংকট হতো। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, দেশের সর্বত্র একটা বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি ও অব্যবস্থাপনা চলছে। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে মানুষ খুব কষ্টে আছে। মেগা প্রকল্পে দুর্নীতি, বাড়তি ব্যয়ের অভিযোগ আছে। রেলের টিকিট কাটা থেকে শুরু করে মেগা প্রকল্প—সর্বত্র দুর্নীতি। লাখ লাখ কোটি টাকা পাচারের তথ্য এসেছে। এসব টাকা কোথা থেকে গেছে?
আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী সূত্র বলছে, বিশ্বব্যাপী জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি, বৈদেশিক মুদ্রার ওপর চাপ সৃষ্টি—এ পরিস্থিতিতে সরকারের সামনে দুটি পথ খোলা ছিল। ১. সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হবে—এ বিবেচনায় আবেগতাড়িত হয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া। এ ক্ষেত্রে ভর্তুকি দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন আগের মতো চালিয়ে যেতে পারত সরকার। এতে দেশ ও দেশের অর্থনীতি দীর্ঘ মেয়াদে গভীর সংকটে পড়ে যেত। ২. আবেগতাড়িত না হয়ে কৃচ্ছ্রসাধনসহ নানা সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেওয়া। সরকার এ পথেই হাঁটেছে। সম্ভাব্য বিকল্পের মধ্যে সরকার ঠিক বিকল্পই বেছে নিয়েছে বলে দলের দায়িত্বশীল নেতারা মনে করছেন।
তবে সরকারের সতর্কতামূলক ব্যবস্থা জনমনে আতঙ্ক ছড়াচ্ছে কি না, এমনটাও ভাবছেন আওয়ামী লীগের কোনো কোনো নেতা। এর মধ্যে দলের সভাপতিমণ্ডলীর তিনজন এবং উপদেষ্টা পরিষদের দুজন জ্যেষ্ঠ নেতার সঙ্গে এই প্রতিবেদকের কথা হয়। একজন নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, দেশের মানুষ দক্ষিণ এশিয়ার দেশ শ্রীলঙ্কার টালমাটাল অবস্থা প্রত্যক্ষ করছে। বাংলাদেশও তেমন পরিস্থিতির পথে যাচ্ছে কি না, এমন আলোচনা বিরোধী দলগুলো তুলেছে। সাধারণ মানুষের মধ্যেও একধরনের আতঙ্ক আছে।
আরেকজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা বলেন, দেশ সংকটে পড়লে সরকার সমালোচিত হয়, এটা স্বাভাবিক। এ সময় দুর্নীতি–অর্থ পাচারের মতো বিষয় সামনে আসে। এ সংকটের মধ্যেও বিভিন্ন স্থানে দলীয় সংসদ সদস্যদের নানা অপ্রীতিকর ঘটনায় জড়িয়ে পড়ার খবর আসছে। আছে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব-সংঘাত। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন স্থানে যৌন হয়রানিসহ বিভিন্ন অপরাধের ঘটনায় ছাত্রলীগের নেতাদের নাম আসছে। সাম্প্রদায়িক অপ্রীতিকর ঘটনায়ও তৃণমূলের ক্ষমতাসীন দলের লোকজনের নাম আসছে।
আরেকজন কেন্দ্রীয় নেতা বলেন, এমনিতে ক্ষমতাসীন দল হিসেবে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্যদের অনেকের গ্রহণযোগ্যতা অনেক নিচুতে। এর সঙ্গে অর্থনীতির চাপ যোগ হয়ে দলের নীতিনির্ধারকদের কৌশল প্রণয়ন কঠিন করে দিয়েছে।
আওয়ামী লীগের দলীয় ছয়জন সংসদ সদস্যের সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তাঁরা বলছেন, এত দিন দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির বিষয়ে মানুষের নানা প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়েছে। এখন বিদ্যুতের লোডশেডিং যোগ হয়েছে। এ পরিস্থিতিতে কত দিন চলবে, এর কোনো সুস্পষ্ট ধারণা পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে মানুষকে আশ্বস্ত করা একটা বড় চ্যালেঞ্জ।
একজন সংসদ সদস্য বলেন, চলমান বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সমস্যা কত দীর্ঘ হবে, এ বিষয়ে দলের কৌশল কী হওয়া উচিত, এসব বিষয়ে আওয়ামী লীগের নেতা ও জনপ্রতিনিধিরা অনেকটাই অন্ধকারে। তাঁরা নিজেদের মতো করে সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বা পর্যায় থেকে সমস্যাগুলো বোঝার চেষ্টা করছেন। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতি মানুষকে বোঝানোর জন্য কী ব্যাখ্যা দেওয়া উচিত, সেটি এখনো স্পষ্ট নয়।
এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য পীযূষ কান্তি ভট্টাচার্য বলেন, বৈশ্বিক সংকটের কারণে সৃষ্ট বর্তমান পরিস্থিতি সামাল দিতে সরকার যেসব উদ্যোগ নিয়েছে, তা সঠিক। তবে এসব সিদ্ধান্ত ঠিকভাবে বাস্তবায়িত হচ্ছে কি না, তা তদারক করতে হবে।
আওয়ামী লীগের নেতারা মনে করছেন, আগামী শীতের আগে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের একটা সুরাহা হতে পারে। তখন জ্বালানি খাতের অস্থিরতা কিছুটা কমে আসতে পারে।
তবে দলের নীতিনির্ধারকদের অনেকে মনে করছেন, এ কঠিন পরিস্থিতি নিয়ে ছয় মাস হয়তো মানুষকে মানানো যাবে। কিন্তু সংকট আরও দীর্ঘ হলে মানুষ অস্থির হয়ে উঠবে। এতে আওয়ামী লীগও ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। কেননা, জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির পাশাপাশি পশ্চিমা দুনিয়ায় রপ্তানিতে টান পড়ার আশঙ্কা করছেন অর্থনীতিবিদেরা। রপ্তানি ও প্রবাসী আয়ের ওপর নির্ভরশীল বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে চাপ বাড়লে পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক বলেন, ‘রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে, সেখানে তো আমাদের কোনো হাত নেই। তাই বলে সরকার বসে নেই। সরকার খরচ কমানো এবং উৎপাদন বাড়ানোর ওপর জোর দিয়েছে। এ মুহূর্তে এটাই হচ্ছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।’ তিনি বলেন, বর্তমান সরকার করোনা মহামারিসহ সব ধরনের সংকটের সময় জনগণকে স্বস্তি দেওয়ার চেষ্টা করেছে, সফল হয়েছে। এ দফায়ও সরকার সফল হবে।