পৌরসভাও ছাড়তে নারাজ এমপিরা ♦ হতে চান উপদেষ্টা, আইন সংশোধনের চাপ সংসদীয় স্থায়ী কমিটির ♦ মেয়রসহ স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে বৈঠক করবে স্থানীয় সরকার বিভাগ

পৌরসভাও ছাড়তে নারাজ এমপিরা ♦ হতে চান উপদেষ্টা, আইন সংশোধনের চাপ সংসদীয় স্থায়ী কমিটির ♦ মেয়রসহ স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে বৈঠক করবে স্থানীয় সরকার বিভাগ

জেলা পরিষদ-উপজেলা পরিষদের মতো পৌরসভায়ও উপদেষ্টা হতে চান স্থানীয় এমপিরা (সংসদ সদস্য)। এ বিষয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি সুপারিশ করেছে। বিষয়টি নাকচ করে দিয়ে মন্ত্রণালয় সাফ জানিয়ে দেয়, বিদ্যমান আইনে পৌরসভায় স্থানীয় এমপিদের উপদেষ্টা করার সুযোগ নেই। কিন্তু নিজেদের অবস্থানে অটল এমপিরা। তারা যে কোনো মূল্যে উপদেষ্টা হতে চান। এজন্য স্থানীয় সরকার (পৌরসভা) আইনে প্রয়োজনীয় সংশোধন আনার ফের সুপারিশ করেছে সংসদীয় স্থায়ী কমিটি। এর জবাবে স্থানীয় সরকার বিভাগ বলেছে, এ বিষয়ে পৌর মেয়রসহ সংশ্লিষ্ট অংশীজনদের সঙ্গে বৈঠক করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এদিকে এমপিরা পৌরসভার উপদেষ্টা হলে তা হবে সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলে মন্তব্য করেছেন স্থানীয় সরকার ও সংবিধান বিশেষজ্ঞরা। তাঁদের মতে, এমপিদের কাজ আইন প্রণয়ন। তাঁদের স্থানীয় উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে যুক্ত হওয়া অসাংবিধানিক। আর এ বিষয়ে কঠোর আপত্তি জানিয়েছে পৌর মেয়রদের সংগঠন বাংলাদেশ পৌর মেয়র অ্যাসোসিয়েশন। তারা বলছেন, এমপিরা পৌরসভার উপদেষ্টা হলে স্থানীয় উন্নয়ন কর্মকাণ্ড ব্যাহত হবে। প্রশাসনিক কাজে দ্বন্দ্ব ও জটিলতা আরও বাড়বে।

পৌরসভায় এমপিদের উপদেষ্টা করা হলে তা সংবিধান পরিপন্থী বলে মন্তব্য করেছেন স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ও সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার। তিনি গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘বিএনপি সরকার আমলে জেলা মন্ত্রী নিয়ে আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর করা এক মামলায় বিচারপতি খায়রুল হক ও বিচারপতি ফজলে কবীরের এ-সংক্রান্ত একটি রায় রয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে- এমপিরা স্থানীয় উন্নয়নকাজে যুক্ত হতে পারবেন না। এটা অসাংবিধানিক। এমপিদের পৌরসভার উপদেষ্টা করতে হলে শুধু আইন সংশোধন করলেই হবে না এজন্য সংবিধানও সংশোধন করতে হবে।’

এমপিদের স্থানীয় উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে জড়িত হওয়া অসাংবিধানিক বলে আদালতের রায় আছে

-সুজন সম্পাদক

৩১ জুলাই জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটির সভাপতি এইচ এন আশিকুর রহমানের সভাপতিত্বে দশম বৈঠক জাতীয় সংসদে অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন কমিটির সদস্য আবুল হাসান মাহমুদ আলী, আ স ম ফিরোজ, হাফিজ আহমেদ মজুমদার, র আ ম. উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী ও পনির উদ্দিন আহমেদ। সেখানে নবম বৈঠকের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন অগ্রগতিতে এমপিদের পৌরসভায় উপদেষ্টা করার বিষয়ে মন্ত্রণালয়ের কার্যপত্রের ভাষা নিয়ে ক্ষোভ ও অসন্তোষ প্রকাশ করা হয়। কমিটির সভাপতি বলেন, কার্যপত্রে বলা হয়েছে- স্থানীয় সরকার (পৌরসভা) আইন অনুযায়ী এমপিদের উপদেষ্টা করার কোনো সুযোগ নেই। এমপিরা জেলা পরিষদ ও উপজেলা পরিষদের উপদেষ্টা হতে পারলে পৌরসভার উপদেষ্টা থাকতে না পারার কোনো কারণ নেই। একজন এমপি তার নির্বাচনী এলাকার পৌরসভার উপদেষ্টা হলে তার পক্ষে এলাকার উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে সমন্বয় সাধন অধিকতর সহজ হবে। তিনি সম্প্রতি সংশোধিত স্থানীয় সরকার (পৌরসভা) আইনে এমপিদের উপদেষ্টা হিসেবে রাখার বিধান যুক্ত করার জন্য দ্রুত আইন সংশোধন কার্যক্রম শুরু করার পরামর্শ দেন। কমিটির সদস্য র আ ম উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী বলেন, কার্যপত্রে বলা হয়েছে স্থানীয় সরকার (পৌরসভা) আইন অনুযায়ী এমপিদের উপদেষ্টা করার কোনো সুযোগ নেই। এ ক্ষেত্রে সঠিক ভাষা ব্যবহার করা হয়নি। তিনি সংসদীয় কমিটিতে কার্যপত্র পাঠানোর আগে মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের ভাষাগত ব্যবহারে অধিকতর মনোযোগী হওয়ার পরামর্শ দেন। তিনি বলেন, একটি বিষয় আইনে অন্তর্ভুক্ত করলে সুযোগ তৈরি হয়ে যায়। সুযোগ নেই, কথাটি পুরোপুরি সঠিক নয় এবং কার্যপত্রে বিষয়টি যেভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে, তা সমীচীন হয়নি। পরে এমপিদের পৌরসভার উপদেষ্টা করতে স্থানীয় সরকার (পৌরসভা) আইনে প্রয়োজনীয় সংশোধন আনার সুপারিশ করার সিদ্ধান্ত হয় বৈঠকে। এর আগে কমিটির অষ্টম বৈঠকে একই সুপারিশ করে কমিটি। ওই বৈঠকে এমপি আ স ম ফিরোজ বলেন, জেলা/উপজেলা পরিষদের উপদেষ্টা হিসেবে এমপিদের রাখা হলেও পৌরসভার ক্ষেত্রে কোনো ভূমিকা নেই। তিনি উপজেলা বা জেলা পরিষদের মতো এমপিদের পৌরসভার উপদেষ্টা করার বিষয়ে পদক্ষেপ গ্রহণের পরামর্শ দেন। তাঁর বক্তব্যে সমর্থন দিয়ে সংসদ সদস্য পনির উদ্দিন আহমেদ বলেন, উপদেষ্টা হিসেবে জেলা/উপজেলা পরিষদে থাকলে পৌরসভায়ও থাকা উচিত। তিনি যে পৌরসভার বাসিন্দা সে পৌরসভার রাস্তাঘাট ও ড্রেন ভাঙা। তিনি পৌরসভার মেয়রকে বারবার বলার পরও পৌরসভার ইঞ্জিনিয়ার দিয়ে ইস্টিমেট করা হচ্ছে না। পৌরসভার মেয়র যদি নিজেই সব ক্ষমতার অধিকারী হন তাহলে জেলা প্রশাসককে অভিযোগ করে কোনো লাভ নেই। সংসদ সদস্যকে উপদেষ্টা করা হলে উন্নয়নের গতি আরও বৃদ্ধি পাবে। কমিটির সদস্য ও জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেনও পৌরসভায় এমপিদের উপদেষ্টা রাখার বিষয়ে যথাযথ ভূমিকা নেওয়ার পরামর্শ দেন। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ও ল অ্যান্ড লাইফ ফাউন্ডেশন ট্রাস্টের নির্বাহী সভাপতি ব্যারিস্টার মোহাম্মদ হুমায়ন কবির পল্লব বলেন, ‘সংবিধানের ৬৫(১) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সংসদ সদস্যদের দায়িত্ব এবং কর্তব্য হলো সংসদের মাধ্যমে রাষ্ট্রের কল্যাণে আইন প্রণয়ন করা। তৃতীয় তফসিলে নির্ধারিত শপথপত্র পাঠ করে সংসদ সদস্য হিসেবে শপথ নিতে হয়। ফলে আইন প্রণয়নসংক্রান্ত বিষয়াদি ছাড়া অন্য কোনো বিষয়ে সংসদ সদস্যদের সম্পৃক্তকরণ অসাংবিধানিক। পৌরসভা বা উপজেলা পরিষদের উপদেষ্টা হিসেবে সংসদ সদস্যদের সম্পৃক্ততা সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক ও জনস্বার্থ পরিপন্থী।’ সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, সংবিধান অনুযায়ী এমপিদের আইন প্রণয়ন করার কথা। তবে আইন প্রণয়নের চেয়ে নির্বাহী কাজে তারা ব্যস্ত থাকতে পছন্দ করেন। এমপিদের উপদেষ্টা করায় তাদের সুপারিশের বাইরে যেতে পারে না জেলা পরিষদ ও উপজেলা পরিষদ। এ ছাড়া স্থানীয় পর্যায়ে টিআর, কাবিটা, বয়স্ক ভাতাসহ সামাজিক নিরাপত্তা-বেষ্টনীর বহু প্রকল্পে তারা সংশ্লিষ্ট। এসব প্রকল্প থেকে কারা সুবিধা পাবেন তা স্থানীয় এমপির সম্মতির ভিত্তিতে হয়ে থাকে বলে অভিযোগ রয়েছে। এলাকার শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ নানা ধরনের প্রতিষ্ঠানেও এমপিদের সম্পৃক্ততা থাকে। নির্বাচনে মনোনয়ন থেকে শুরু করে প্রকল্প বাস্তবায়নে প্রভাব থাকে তাদের। ফলে স্থানীয় সরকার প্রতিনিধিরা ভোটারের চাহিদা অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন না, খর্ব হচ্ছে তাদের স্বাধীনতা।
এমন পরিস্থিতিতে সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সুপারিশ বাস্তবায়ন হলে পৌরসভায় উন্নয়ন কর্মকাণ্ড ব্যাহত হবে বলে মনে করছেন পৌর মেয়ররা। পৌর মেয়র অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব খালিদ হোসেন ইয়াদ বলেন, ‘এমপিদের উপদেষ্টা করার বিধান আইনে নেই। তার পরও যদি করা হয় তাহলে পৌরসভায় উন্নয়ন কর্মকাণ্ড ব্যাহত হবে। ক্ষমতার প্রশাসনিক জটিলতা ও দ্বন্দ্ব বাড়বে।’

জাতীয়