পরিস্থিতি সামাল দিতে দ্রুত সমন্বিত পদক্ষেপ নেওয়ার পরামর্শ অর্থনীতিবিদদের

পরিস্থিতি সামাল দিতে দ্রুত সমন্বিত পদক্ষেপ নেওয়ার পরামর্শ অর্থনীতিবিদদের

পেট্রল, ডিজেল, কেরোসিন ও অকটেনের দাম বাড়ানোর কারণে বিভিন্ন ক্ষেত্রে উৎপাদন বাধাগ্রস্ত হবে, বাড়বে বিভিন্ন পণ্যের দাম। ফলে মূল্যস্ফীতি আরও বেড়ে যাবে। চাপে পড়বে নিম্নআয়ের মানুষ। এমন পরিস্থিতি সামাল দিতে দ্রুত সমন্বিত পদক্ষে নেওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন অর্থনীতিবিদরা।

তারা বলছেন, জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর ফলে এখন উৎপাদন, ব্যাংকিং, বাণিজ্য, রপ্তানি- সব জায়গায় প্রভাব পড়বে। পণ্যমূল্য বেড়ে যাবে। মধ্যবিত্তের জীবন অসহনীয় হয়ে উঠবে। যাদের সঞ্চয় আছে, তাদের সঞ্চয় ভাঙতে হতে পারে।

এমন পরিস্থিতিতে জ্বালানি, রপ্তানি, বাণিজ্য সবক্ষেত্রের জন্য দ্রুত অন্তর্বর্তীকালীন, মধ্যবর্তীকালীন এবং দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। তা না হলে চ্যালেঞ্জগুলো আরও প্রকট হবে, এমনটাই অভিমত তাদের।

তারা আরও বলছেন, বৈদেশিক মুদ্রা আয় বাড়ানোর পদক্ষেপ নিতে হবে। এ জন্য রপ্তানি বাড়ানোর কৌশল নিতে হবে। রপ্তানিপণ্য ও রপ্তানির গন্তব্য বহুমুখী করতে হবে। সেই সঙ্গে দক্ষ জনবল বাইরে পাঠানোর ব্যবস্থা করতে হবে, যাতে রেমিট্যান্স বাড়ে। সেই সঙ্গে মানুষের জীবিকা এবং জীবনব্যবস্থার উন্নয়ন হয় এমন পদক্ষেপ নিতে হবে।

এ বিষয়ে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর ফলে সাধারণ মানুষের জীবনব্যবস্থা, শিল্প, বাণিজ্য সব ক্ষেত্রে প্রভাব পড়বে। পণ্যমূল্য বেড়ে যাবে। যাদের ফিক্সড ইনকাম আছে এবং যারা মধ্যবিত্ত তাদের জীবন অসহনীয় হয়ে যাবে। এমনিই তাদের আয় বাড়ছে না। এ পরিস্থিতিতে তাদের খাবার-দাবার, অন্যান্য জিনিসপত্র ক্রয় করতে হবে।

‘এমনিতেই অনেকে মানবেতর জীবনযাপন করে, সেটা আরও খারাপ হবে। যাদের সঞ্চয় আছে, সঞ্চয় ভেঙে ফেলবে। তাদের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত। এ রকম বাড়ানোটা (জ্বালানি তেলের দাম) ঠিক হয়নি। এত হারে বাড়ানো কোনোভাবে যুক্তিসংগত নয়’ বলেন এই অর্থনীতিবিদ।

তেলের দাম বাড়ানোর ফলে এখন যে পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে তা কীভাবে সামাল দেওয়া যেতে পারে- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, পদক্ষেপ আরও আগে নেওয়া উচিত ছিল। দেরি হয়ে গেছে। ইন্ডিপেন্ডেন্ট পাওয়ার প্রজেক্টে টাকা দিয়ে যাচ্ছেন, ভর্তুকি দিচ্ছেন। এগুলো নিয়ে আরও আগে থেকে চিন্তা করা উচিত ছিল। এটা কিন্তু এখন শুধু জ্বালানি না, এটা উৎপাদন, ব্যাংকিং, বাণিজ্য, রপ্তানি- সব জায়গায় প্রভাব ফেলবে। হাসপাতালের খরচ বেড়ে যাবে। আবার এদিকে গ্যাসের দাম এবং ওয়াসা পানির দাম বাড়াবে। এটা দুর্বিষহ ব্যাপার।

তিনি বলেন, ইমিডিয়েন্ট একটা সমন্বিত পদক্ষেপ নিতে হবে। খালি স্লোগান দিয়ে, পলিটিক্যাল বক্তব্য দিয়ে লাভ হবে না। প্রয়োজন হলে বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে বসে কী করা যায় তা ঠিক করতে হবে। অন্তর্বর্তীকালীন, মধ্যবর্তীকালীন এবং দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিতে হবে। শুধু জ্বালানি নয়, রপ্তানি, বাণিজ্য- সব ক্ষেত্রের জন্য। তা না হলে আমাদের চ্যালেঞ্জগুলো আরও প্রকট হবে।

তিনি আরও বলেন, শুধু কোডিভ এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের দোষ দিলে হবে না, আমাদের নিজস্ব সমস্যাগুলো বহুদিন সমাধান করিনি। অর্থের অপচয়, অর্থপাচার, জবাবদিহির অভাব, অপ্রয়োজনীয় প্রকল্পে টাকা ব্যয়- এগুলো এখন কমাতে হবে। লোক দেখানো প্রকল্প বন্ধ করতে হবে। মানুষের জীবিকা এবং জীবনব্যবস্থার উন্নয়ন হয় সেগুলো করতে হবে।

সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, আমাদের সামাজিক উন্নয়ন, কোয়ালিটি অব লাইফের দিকে নজর দেওয়া হয়নি এতদিন। খালি গ্রোথ গ্রোথ, প্রবৃদ্ধি প্রবৃদ্ধি আমরা ফলাওভাবে প্রচার করেছি। প্রবৃদ্ধির সুফল তো সাধারণ মানুষ পায়নি।

বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ড. আবুল বারকাত বলেন, আমাদের রিজার্ভ ম্যানেজমেন্টে বড় ধরনের সমস্যা আছে। এটা অনেক আগে থেকে ভাবার বিষয় ছিল, কিন্তু ভাবা হয়নি। আমি ২০১০-১১ সালের দিকে কুইক রেন্টাল নিয়ে কথা বলেছি। আমি সবসময় বলে এসেছি কুইক রেন্টাল হলো যুদ্ধপরবর্তী সমাধান। ২০০৫-০৭ সালে তো কোনো যুদ্ধ হয়নি। তাহলে ২০০৯-১০ সালে কুইক রেন্টাল করা হলো কেন? এখন নিশ্চয় দেখছেন কুইক রেন্টাল গলার কাঁটা।

তিনি বলেন, অতীত থেকে আমাদের শিক্ষা নিতে হবে। কিন্তু অতীত থেকে শিক্ষা না নেওয়াটাই একটা বড় ইতিহাস বলে মনে হয় আমাদের দেশে। যেকোনো বড় সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে তার কনসিকোয়েন্সগুলো ভালো করে জানা দরকার। বিদ্যুৎ উৎপাদন আপনি বহু করেছেন, এটা সত্য কথা। কিন্তু আপনি কতটুকু দিতে পারছেন। আপনি লোডশেডিং দিচ্ছেন, কৃচ্ছসাধনের নাম দিয়ে আরও কতকিছু করছেন। কিন্তু যারা কৃচ্ছসাধন করার কথা তারা করছে কি না আমার সন্দেহ আছে।

এই অর্থনীতিবিদ বলেন, কৃচ্ছ্রসাধন স্বল্পসময়ের জন্য সমাধান হতে পারে। কিন্তু কৃচ্ছ্রসাধন সবার জন্য নয়। আপনি গরিব মানুষকে কৃচ্ছ্রসাধন করতে বলবেন কীভাবে? একটা মধ্যবিত্ত মানুষকে আপনি বলছেন, তুমি কম খাও। ঠিক আছে, কিন্তু কয়দিন? আমরা একটা অনিশ্চিত পরিস্থিতির মধ্যে পড়ে যাচ্ছি। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য যতটা সম্ভব বৈদেশিক মুদ্রার আয় বাড়াতে হবে।

তিনি বলেন, বৈদেশিক মুদ্রার আয় বাড়ানোর তিনটা পথ আছে। দুটি সরাসরি, একটা রপ্তানি বাড়ানো। রপ্তানি বাড়ালে আপনি বৈদেশিক মুদ্রা আয় করতে পারেন। এটা কীভাবে করবেন, সেটা নীতিনির্ধারক যারা আছেন, তাদের সঙ্গে বসতে হবে। দ্বিতীয়, রপ্তানি আপনি যা করছেন, সেখানে খরচ কমানোর কোনো সুযোগ আছে কি না তা দেখতে হবে। খরচ কমানোর সুযোগ থাকলে সেগুলো ব্যবহার করতে হবে।

‘তৃতীয়, ট্রেডিশনাল রপ্তানিপণ্য এবং ট্রেডিশনাল রপ্তানি গন্তব্য- এ দুটিই বহুমুখীকরণ করতে হবে। আপনার প্রধান গন্তব্যস্থল যেটা, সেখানে কিন্তু যুদ্ধ। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বাধিয়েছে, পুরো ইউরোপে কিন্তু যুদ্ধাবস্থা। সেখানে মানুষের জীবনব্যবস্থা খারাপ অবস্থার দিকে যাচ্ছে। সেটাও মাথায় রাখা। আর একটা হলো প্রচলিত পণ্য নয়, মানুষ। যাদের মাধ্যমে রেমিট্যান্স পান। দক্ষ মানুষ (দেশের) বাইরে পাঠানোর ব্যবস্থা করতে হবে’- যোগ করেন আবুল বারকাত।

তিনি বলেন, বাংলাদেশে সম্পদ কর আইন আছে। কিন্তু সম্পদ কর নেওয়া হয় না। প্রথম এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় অতিরিক্ত মুনাফার ওপর কর বসানো হয়েছিল। বর্তমান পরিস্থিতিতে অতিরিক্ত মুনাফার ওপর কর বসানো উচিত। সেই সঙ্গে কালো টাকা, অর্থপাচারসহ যত ধরনের দুর্নীতি আছে তা যতটুকু সম্ভব কমাতে হবে। এই চেষ্টা শক্ত হাতে করতে হবে। আমরা অনেক সময় বলি, কিন্তু করতে পারিনি। কারণ সরষের মধ্যে ভূত থাকলে ভূত তাড়ানো খুব কঠিন।

আইএমএফ’র শর্তের বিষয়ে এই অর্থনীতিবিদ বলেন, আইএমএফ’র শর্তগুলো খুব বিষময় হয়। আইএমএফ কখনো বিষময় শর্তের বাইরে শর্ত দেয় না, যদি না আপনি তাদের প্রিয়পাত্র হন। আমরা মনে হয় তাদের খুব প্রিয়পাত্র না। এটা আমার কাছে একটা খারাপ দিক মনে হয়। ২০১৪ সালে নির্বাচন হয়েছিল, বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতুর অর্থায়ন বন্ধ করেছিল ২০১২ সালে, নির্বাচনের এক-দেড় বছর আগে। এখনো তো নির্বাচনের এক-দেড় বছর বাকি। অর্থাৎ একই আচরণ কি না?

তিনি বলেন, রেমিট্যান্সের যে ফিগার আছে, সেটা কি আসল ফিগার? কারণ খোলাবাজারে ডলার যদি ১১০-১১২ টাকা হয়, আর সরকারিভাবে ৯৩-৯৪ টাকা হয় তাহলে এই পার্থক্যের কারণে কোনো পাগল ব্যাংকিং চ্যালেনে রেমিট্যান্স পাঠাবে? এমন পাগল পাওয়া কঠিন। এই সমস্যার সমাধান করতে না পারলে বৈদিশক মুদ্রা পাওয়া যাবে না, ফলে ঘুরে ফিরে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর চাপ পড়তেই থাকবে।

তিনি আরও বলেন, রিভার্জ ৪০ বিলিয়ন ডলার আপনি বলতে পারেন। কিন্তু ৪০ বিলিয়ন ডলার নেই। ওখান থেকে ৮-৯ বিলিয়ন ডলার মাইনাস হবে। কারণ কতগুলো ফিগার আছে, যেগুলো অ্যাসেট। সে ফিগারগুলো ফরেন কারেন্সি নয়। ফরেন ডিরেক্ট ইনভেস্টমেন্টকে আপনি ফরেন কারেন্সি বলতে পারেন না।

তিনি বলেন, জিডিপিতে সঞ্চয়ের হার একসময় ৩১-৩২ ছিল। এখন সেটা ২৪-২৫ এ নেমে এসেছে। এর মানে মানুষের সঞ্চয় করার ক্ষমতা কমে গেছে। সঞ্চয় করার ক্ষমতা কমে গেলে জীবনযাপনের ব্যবস্থা যার যতটুকু ছিল তার নিচে নেমে গেছে। একটা মানুষ মধ্যবিত্ত আছে, তার থেকে গরিব হচ্ছে, গরিব থেকে নিঃস্ব হচ্ছে। নীরব একটা নিঃস্বায়ন প্রক্রিয়া সম্ভবত চলমান।

শুক্রবার (৫ আগস্ট) দিনগত রাত থেকেই কার্যকর হয়েছে সরকার ঘোষিত ডিজেল, পেট্রল, কেরোসিন, ও অকটেনের নতুন দাম। দাম বেড়েছে প্রতি লিটার ডিজেলে ৩৪, কেরোসিনে ৩৪, অকটেনে ৪৬, পেট্রলে ৪৪ টাকা। দাম বাড়ার পর প্রতি লিটার ডিজেল ১১৪ টাকা, কেরোসিন ১১৪ টাকা, অকটেন ১৩৫ টাকা ও প্রতি লিটার পেট্রল ১৩০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আগে ভোক্তা পর্যায়ে খুচরা তেলের দাম ছিল প্রতি লিটার ডিজেল ৮০ টাকা, কেরোসিন ৮০ টাকা, অকটেন ৮৯ টাকা ও পেট্রল ৮৬ টাকা।

অর্থ বাণিজ্য