জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির পর অস্থিতিশীল হয়ে উঠেছে রাজধানীর নিত্যপণ্যের বাজার। গত কয়েক দিনের ব্যবধানে চাল, আটা, লবণ, গুঁড়ো দুধ, সবজিসহ সব ধরনের পণ্যের দাম কেজিতে ৩-৮০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। দফায় দফায় মূল্যবৃদ্ধির মধ্যে সবচেয়ে বেশি বেড়েছে কাঁচামরিচ ও গুঁড়ো দুধের দাম। মরিচ কেজিতে ৭০-৮০ টাকা ও গুঁড়ো দুধ কেজিতে বেড়েছে ৫৫-৬০ টাকা পর্যন্ত। এদিকে রাজধানীর বাজারগুলোর মতো দিনাজপুর ও হিলির স্থলবন্দরের বাজারে পেঁয়াজ ও চালের দাম কেজিতে ৩ টাকা বৃদ্ধির খবর পাওয়া গেছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাজার ব্যবস্থাপনায় সরকারের জনবল কম থাকায় ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট পরিবহন খরচের দোহাই দিয়ে ইচ্ছেমতো ক্রেতাদের পকেট কাটছে।
দুই থেকে তিন দিন আগেও রাজধানীর বাজারগুলোতে করলা ৫০ টাকা, বরবটি ৫০, বেগুন ৬০, শিম ১৭০, টমেটো ১০০, পটোল ৪০, শসা ৫০, কচুর লতি ৬০ এবং কাঁচামরিচ ২০০-২২০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। গত ৬ দিনের ব্যবধানে পেঁপে ছাড়া সব ধরনের সবজির দাম কেজিতে ২০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে।
গতকাল বুধবার রাজধানীর রামপুরা, পলাশী ও কারওয়ান বাজার ঘুরে দেখা গেছে প্রতি হালি কাঁচকলা ৫০ টাকা, করলা ৭০-৮০, বরবটি ৬০-৬৫, বেগুন ৮০, শিম ২০০, টমেটো ১২০-১৩০, পটোল ৫০, শসা ৭০-৮০, কচুর লতি ৮০ এবং কাঁচামরিচ ২৭০-২৮০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
পাইকারি ও খুচরা বিক্রেতাদের দাবি, ডলারের বিপীরতে টাকার দরপতনের প্রভাবে আমদানি খরচ বেড়েছে। সেই সঙ্গে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার কারণে পরিবহন খরচও বেড়ে গেছে। দেশের বাজারে সব ধরনের পণ্যের দামে এর প্রভাব পড়েছে।
মাদারীপুর থেকে সবজি বিক্রি করতে কারওয়ান বাজারে আসা আলি বলেন, ‘এক সপ্তাহ আগেও ঢাকায় আসতে আমার ৩০০ টাকা খরচ হতো। কিন্তু জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির পরদিন থেকে ঢাকায় মালামাল নিয়ে আসতে আমার ৪৫০-৫০০ টাকা পর্যন্ত খরচ হচ্ছে। এত টাকা ভাড়া দিয়ে এসে আগের দামে আর সবজি বিক্রি করা যায় না। শুধু ভাড়া বাড়লেও হতো, নতুন করে সারের দাম বাড়ায় আরও বেশি বিপাকে পড়ে গ্যাছি।’
হাতিরপুল বাজারের সবজি ব্যবসায়ী আশিক দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘পরিবহন খরচ বাড়ায় পাইকারি বাজারে মরিচের দাম বেড়েছে। যার প্রভাব খুচরা বাজারেও দেখা দিয়েছে। বর্তমানে প্রতি কেজি মরিচ বিক্রি করছি ২৭০-২৮০ টাকা দরে। আমরা চাই না কোনোভাবে সবজির মূল্যবৃদ্ধি পাক। পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি পেলে আমার ব্যবসায় ভাটা পড়ে। গত কয়েক দিনে অর্ধেকের বেশি বেচাকেনা কমেছে। মানুষ তাদের চাহিদার তুলনায় খুবই কম নিচ্ছে প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি।’
এদিকে মুদি দোকানে খবর নিয়ে জানা গেছে গুঁড়ো দুধের দাম কেজিতে ৫৫-৬০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। ডানো এক কেজির প্যাকেট বিক্রি হচ্ছে ৬৪৫ টাকা, মার্কস ৭৯০ টাকা, ডিপ্লোমা ৮৫০ টাকা। তবে প্যাকেটজাত গুঁড়ো দুধের মূল্যবৃদ্ধির সুস্পষ্ট কারণ দেখাতে পারেননি ব্যবসায়ীরা। দুধের দাম অতিরিক্ত বেড়েছে স্বীকার করে তারা বলেন, এক সপ্তাহ আগেও প্রতি কেজি প্যাকেটজাত ডানো ৫৯০ টাকা, মার্কস ৭৪০ টাকা, ডিপ্লোমা ৮৫০ টাকায় বিক্রি করেছেন।
এদিকে চালের বাজারে ঘুরে দেখা যায়, খোলা বাজারে প্রতি কেজি চালে অন্তত ৩ টাকা দাম বেড়েছে। বর্তমানে বিআর-২৮ ৫৭, মিনিকেট ৭১-৭২ এবং স্বর্ণা (মোটা) ৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। চাল ব্যবসায়ী হারুনুর রশীদ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘এখনো বাজারে পুরনো চালের মূল্যবৃদ্ধি হয়নি। তবে নতুন করে আনা চাল কেজিতে খরচসহ ৩ টাকার বেশি বেড়েছে। একদিকে পরিবহন খরচ বৃদ্ধি, অপরদিকে মিলারদের থেকে বেশি দামে নতুন মূল্যের চাল কিনতে হচ্ছে। সব মিলিয়ে বাজারের অবস্থা একেবারে নাজেহাল।’
চালের মতো চিনি ও লবণের দামও বেড়েছে। প্রতি কেজি লবণে ৩ টাকা ও চিনিতে ৫ টাকা করে বৃদ্ধি পেয়েছে। বর্তমানে কেজিপ্রতি দাম বেড়ে লবণ ৩৮, খোলা চিনি ৮৫, প্যাকেট চিনি ৯০ ও আটা ১০২-১০৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
অন্যান্য দ্রব্যের মতোই বেড়েছে ব্রয়লার মুরগি দাম। ২০ টাকা বেড়ে প্রতি কেজি মুরগি বিক্রি হচ্ছে ১৯০-২০০ টাকা, লেয়ার মুরগি ২৯০-৩০০ টাকা, পাকিস্তানি মুরগি ৩২০-৩৪০ টাকা।
অন্য ব্যবসায়ীদের মতো মুরগি ব্যবসায়ীরা পরিবহন খরচ বৃদ্ধি অজুহাত দেখিয়েছেন। তারা বলছেন, যেমন একদিকে উৎপাদন খরচ বৃদ্ধির কারণে মুরগির খাদ্যের দাম বেড়েছে। অপরদিকে তেলের মূল্যবৃদ্ধির ফলে পরিবহন খরচ বৃদ্ধি পেয়েছে।
এদিকে দিনাজপুর প্রতিনিধির পাঠানো তথ্যানুযায়ী, জেলার সবচেয়ে বড় চালের পাইকারি বাজার হিসেবে পরিচিত শহরের বাহাদুর বাজারের এনএ মার্কেট। এ মার্কেট ঘুরে ও কয়েকজন পাইকারি দোকানির সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত শুক্রবার এ বাজারে মিনিকেট ৩ হাজার ২০০, আঠাশ ২ হাজার ৬৫০, ঊনত্রিশ ২ হাজার ৪৫০, সুমন স্বর্ণ ২ হাজার ৩৫০, গুটি স্বর্ণ ১ হাজার ৮৫০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। কিন্তু মাত্র ৫ দিনের ব্যবধানে গতকাল সকালে এ বাজারে মিনিকেট ৩ হাজার ৪৫০, আঠাশ ২ হাজার ৯০০, ঊনত্রিশ ২ হাজার ৬৫০, সুমন স্বর্ণ ২ হাজার ৬২০, গুটি স্বর্ণ ২ হাজার ৩০০ টাকা বিক্রি হচ্ছে। বাজারে সবচেয়ে বেশি দাম বেড়েছে গুটি স্বর্ণ চালের। তবে বাজারে গুটি স্বর্ণ চালের দেখা পাওয়া যাচ্ছে না বলে ক্রেতারা অভিযোগ করেছেন।
অপরদিকে আমদানির পরিমাণ বাড়লেও ডলারের দাম বাড়ার অজুহাতে একদিনের ব্যবধানে দিনাজপুরের হিলি স্থলবন্দরে পাইকারিতে পেঁয়াজের দাম বেড়েছে কেজিতে ৩ টাকা। একদিন আগেও বন্দরে ইন্দোর জাতের প্রতি কেজি পেঁয়াজ ২১-২২ টাকায় বিক্রি হলেও বর্তমানে তা বিক্রি হচ্ছে ২৪-২৫ টাকা দরে। এদিকে হিলি বাজারে খুচরাতে দেশি পেঁয়াজের দাম ৯ টাকা ও ভারতীয় পেঁয়াজের দাম কেজিতে ৫ টাকা করে বেড়েছে।
এ বিষয়ে কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) ভাইস প্রেসিডেন্ট নাজির হোসেন বলেন, ‘পরিবহন খরচ ও ডলারের মূল্যবৃদ্ধির অজুহাতে ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি করে যাচ্ছে ইচ্ছেমতো। ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদপ্তরের জনবল কম থাকার কারণে তারা এ সুযোগ পাচ্ছে। সরকারের প্রতি আমাদের আহ্বান থাকবে তারা যেন দ্রুত বাজার মনিটরিংয়ের বিষয়ে নজর দেয়। মানুষের খরচ বাড়লেও আয় বাড়েনি। যার ফলে মানুষ তাদের নিত্যদিনের খাদ্যাভ্যাসে কাটছাঁটের সংস্কৃতিতে প্রবেশ করেছে।’ এভাবে চলতে থাকলে দেশের মানুষ তাদের উপার্জন হারিয়ে গ্রামের ফিরে যেতে বাধ্য হবে বলেও মনে করেন ক্যাবের এই নেতা।