কেন্দ্রীয় ব্যাংকও ঋণ শ্রেণিকরণের ক্ষেত্রে কড়াকড়ি আরোপ করছে না। এত ছাড়ের মধ্যেও গত জুন পর্যন্ত খেলাপি ঋণ বেড়ে সোয়া লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেল। যা বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ। একই সঙ্গে এত বেশি অঙ্কে কখনোই খেলাপি ঋণ বাড়েনি।
ঋণ শ্রেণিকরণ ও প্রভিশনিংয়ের বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একটি হালনাগাদ প্রতিবেদন থেকে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। প্রতিবেদনটি বৃহস্পতিবার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর অনুমোদন করেছেন।
সূত্র জানায়, গত বছরের ডিসেম্বরে ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ ছিল ১ লাখ ৩ হাজার কোটি টাকা। গত জুনে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকার বেশি। আলোচ্য ছয় মাসে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ২২ হাজার কোটি টাকা।
২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত খেলাপি ঋণ বেড়েছিল ১০ হাজার ১৬৭ কোটি টাকা। গত মার্চ প্রান্তিকে খেলাপি ঋণ ছিল ১ লাখ ১৩ হাজার ৪৪০ কোটি টাকা। মার্চ থেকে জুন পর্যন্ত বেড়েছে আরও ১১ হাজার ৮১৮ কোটি টাকা। ওই ছয় মাসে বেড়েছে ২২ হাজার কোটি টাকা। গত বছরের জুনে খেলাপি ঋণ ছিল ৯৯ হাজার ২০৫ কোটি টাকা।
এক বছরে অর্থাৎ গত বছরের জুনের তুলনায় গত জুনে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ২৬ হাজার ৬৩ কোটি টাকা। এর আগেও এবার খেলাপি ঋণ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে ছিল। পরে তা আবার কমে আসে। কিন্তু কখনোই সোয়া লাখ কোটি টাকা ছাড়ায়নি। এবারই প্রথম খেলাপি ঋণ সোয়া লাখ কোটি ছাড়াল।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সবশেষ তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালের জুন মাস শেষে ব্যাংকিং খাতের মোট বিতরণ করা ঋণের অঙ্ক দাঁড়িয়েছে ১৩ লাখ ৯৮ হাজার ৫৯২ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপিতে পরিণত হয়েছে এক লাখ ২৫ হাজার ২৫৮ কোটি টাকা, যা মোট বিতরণ করা ঋণের ৮ দশমিক ৯৬ শতাংশ।
যা এযাবৎকালের এটাই সর্বোচ্চ খেলাপি ঋণের অঙ্ক।
সূত্র জানায়, কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো পরিদর্শন করেও অনেক ঋণকে ভালো মানের না পেলে তা খেলাপি করত। এখন কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিদ্যমান পরিস্থিতিতে এ খাতে ছাড় দিয়েছে। তারপরও খেলাপি ঋণ বাড়ছে।
এর বাইরে আদালতের নিষেধাজ্ঞার কারণে আরও কিছু ঋণকে খেলাপি হিসাবে দেখাতে পারছে না। ব্যাংকগুলোও খেলাপি ঋণের তথ্য গোপন করছে। এর বাইরে আরও প্রায় ৫৩ হাজার কোটি টাকার খেলাপি ঋণ অবলোপন করা হয়েছে। যা খেলাপি ঋণ হিসাবে দেখানো হচ্ছে না। এসব মিলে খেলাপি ঋণ আরও বেশি হবে।
খেলাপিদের বিশেষ ছাড় বন্ধ না হলে খেলাপি ঋণ কমবে না বলে মন্তব্য করেছেন অর্থনীতি বিশ্লেষক ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা মো. আজিজুল ইসলাম।
তিনি বলেন, ছাড় পেতে পেতে এমন অবস্থা হয়েছে যে, খেলাপিরা এখন মনে করছে আমি ঋণ পরিশোধ না করলে আগামীতে আরও ছাড় পাব। এ কারণে যতদিন ছাড় থাকবে ততদিন এ খেলাপি বাড়তেই থাকবে।
তিনি বলেন, এখন খেলাপি ঋণ কমাতে হলে একটাই পথ, সুবিধা বন্ধ করে দিয়ে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া। এছাড়া খেলাপি এক লাখ ২৫ হাজার বলা হলেও বাস্তবে অনেক বেশি। কারণ ঋণ পুনঃতফসিল, পুনর্গঠন, অবলোপন, কোর্টে রিট করা ঋণসহ বেশ কিছু তথ্য যোগ হয়নি। এটি যুক্ত হলে খেলাপি দ্বিগুণ হয়ে যাবে। এগুলো কমাতে হলে কঠিনভাবে আইন করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ইদানীং বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে অনেক ভুল সিদ্ধান্ত আসছে। যে নীতিমালাগুলো দিচ্ছে সেগুলো ঋণখেলাপিদের আরও উৎসাহিত করছে। অন্যদিকে নিরুৎসাহিত হচ্ছেন ভালো গ্রাহক। তারা মনে করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ছাড়া তো পাবই। এছাড়া ব্যাংকগুলোও খেলাপি ঋণ আদায়ে বিমুখ হয়ে পড়েছে। কারণ এর জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে তাদের জবাবদিহিতা করতে হয় না।
তিনি আরও বলেন, হঠাৎ হঠাৎ করে সিদ্ধান্ত নেওয়া কোনো কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাজ নয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাজ বা নীতিগুলো হতে হবে দীর্ঘস্থায়ী এবং ব্যাংকের জন্য মঙ্গলজনক। যাতে করে খেলাপি ঋণ, পুনঃতফসিল, প্রভিশন ঘাটতি কমে আসে। এসব সমস্যা সমাধানে একটি ব্যাংকিং কমিশন গঠন করা উচিত। এর আগেও খেলাপি সমস্যার সমাধান হয়েছে ব্যাংকিং কমিশনের মাধ্যমে।
খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, করোনা মহামারির কারণে ২০২০ সালে কোনো গ্রাহক ঋণ পরিশোধ না করলেও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা মেনে তাকে খেলাপি করা হয়নি। ফলে আদায় তলানিতে নামলেও খেলাপি ঋণ কম ছিল। ২০২১ সালে বিশেষ সুবিধার ছাড় কিছুটা কমায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এরপর খেলাপি ঋণ গিয়ে ঠেকে ১ লাখ ৩ হাজার ২৩ কোটি টাকায়। এখন কিছু সুবিধা তুলে নিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। কিন্তু তারপরও গ্রাহক ঋণ পরিশোধ করছে না। বিশেষ করে বড় ঋণগ্রহীতারা।
সবশেষ খেলাপি ঋণে কী সুবিধা দেওয়া হবে, তা নির্ধারণ করার পুরো ক্ষমতা ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের হাতে তুলে দেওয়া হয়। ৫০০ কোটি টাকার বড় অঙ্কের একটি মেয়াদি ঋণ চার দফায় ২৯ বছরের জন্য পুনঃতফসিলের সুযোগ দিয়ে গত ১৮ জুলাই সার্কুলার জারি করে বাংলাদেশ ব্যাংক।
ব্যাপক ছাড় দিয়ে ঋণ পুনঃতফসিল ও পুনর্গঠন নীতিমালা জারি নিয়ে বিভিন্ন আলোচনা-সমালোচনার মধ্যে আগের নির্দেশনায় সংশোধনী আনে বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে বলা হয়, পুনঃতফসিল করা কোনো ঋণ ৬ মাস অনাদায়ী থাকলে তা সরাসরি ক্ষতিজনক মানে শ্রেণিকরণ করতে হবে।
আর প্রকৃত আদায় ছাড়া পুনঃতফসিল করা ঋণের সুদ আয় খাতে নেওয়া যাবে না। সব ক্ষেত্রে পরিচালনা পর্ষদের অনুমোদনের বাধ্যবাধকতার শর্ত তুলে দেওয়া হয়েছে। এছাড়া পুনঃতফসিল করা কোনো ঋণ বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শনে খেলাপি করলে সেই সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হবে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, ২০২২ সালের জুন শেষে রাষ্ট্রীয় বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো মোট ঋণ বিতরণ করেছে ২ লাখ ৫২ হাজার ৭২৯ কোটি টাকা। এর মধ্যে ২১ দশমিক ৯৩ শতাংশ বা ৫৫ হাজার ৪২৯ কোটি টাকা।
বেসরকারি ব্যাংকগুলোতে আলোচিত সময়ে ঋণ বিতরণ হয়েছে ১০ লাখ ৪২ হাজার ৮৬৬ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ঋণ ৬২ হাজার ৬৭৮ কোটি টাকা বা ৬ দশমিক ০১ শতাংশ। বিদেশি ব্যাংকগুলো ৬৭ হাজার ২৬৮ কোটি টাকা বিতরণ করা ঋণের মধ্যে ২ হাজার ৯৫৭ কোটি টাকা যা মোট প্রদান করা ঋণের ৪ দশমিক ৪০ শতাংশ।
আলোচিত সময়ে বিশেষায়িত তিনটি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ হয়েছে ৪ হাজার ১৯৪ কোটি টাকা। এ অঙ্ক তাদের বিতরণ করা ঋণের ১১ দশমিক ৭৪ শতাংশ। তারা বিতরণ করেছে মোট ৩৫ হাজার ৭২৯ কোটি টাকা।