ভারতের শীর্ষ রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক স্টেট ব্যাংক ইন্ডিয়া (এসবিআই) বাংলাদেশের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যিক লেনদেনে মার্কিন ডলার ও প্রভাবশালী অন্যান্য মুদ্রা ব্যবহার না করতে সেই দেশের রপ্তানিকারকদের প্রতি অনুরোধ জানিয়েছে। এসব মুদ্রার পরিবর্তে ভারতীয় রুপি ও বাংলাদেশি টাকায় লেনদেন করতে রপ্তানিকারকদের অনুরোধ জানিয়েছে ব্যাংকটি। সংশ্লিষ্ট সূত্রের বরাত দিয়ে বার্তা সংস্থা রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে এসব তথ্য জানানো হয়েছে।
এসবিআই সম্প্রতি তাদের বিভিন্ন শাখায় পাঠানো এক নির্দেশনায় বলেছে, আমদানি ব্যয় বৃদ্ধি ও সাম্প্রতিক সময়ে ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়নের কারণে বাংলাদেশে আমদানি ব্যয় বেড়ে গেছে। ফলে দেশটি এখন বৈদেশিক মুদ্রার ঘাটতির আশঙ্কায় রয়েছে।
তা ছাড়া রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে জ্বালানি ও খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি বড় উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। চলতি বছর বিশ্বজুড়ে ডলারের দর ২০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। তাতে বাংলাদেশের মতো ভারতও বিপাকে পড়েছে। কমছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ ও ভারতের মতো কিছু দেশ ডলারের পরিবর্তে অন্য মুদ্রায় বাণিজ্যের চিন্তা করছে। সেই চিন্তা থেকেই বাংলাদেশের সঙ্গে লেনদেনে ডলার ও অন্যান্য বৈদেশিক মুদ্রার ব্যবহার কমানোর কথা ভাবা হচ্ছে বলে এসবিআইয়ের নির্দেশনায় বলা হয়।
এসবিআইয়ের একটি সূত্র নাম প্রকাশ না করার শর্তে রয়টার্সকে জানান, ‘বাংলাদেশের সঙ্গে লেনদেনে ঝুঁকি বৃদ্ধি করতে চাচ্ছে না এসবিআই। বর্তমানে বাংলাদেশের আমদানিকারকদের কাছে আমাদের পাওনা প্রায় ৫০ কোটি ডলার। বাংলাদেশের অর্থনীতি-সংক্রান্ত নানা খবরের পরিপ্রেক্ষিতে আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি, এটা আর খুব বেশি বাড়তে দেওয়া যাবে না। প্রয়োজনে কমিয়ে আনা হবে।’
এদিকে রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়া (আরবিআই) গত জুলাইয়ে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে রুপির ব্যবহারের বিষয়ে একটি নির্দেশনা জারি করেছে। এতে বলা হয়, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে, বিশেষ করে রপ্তানিতে গতি আনতেই এমন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
এসবিআইয়ের নির্দেশনার বিষয়ে প্রথম আলোর নয়াদিল্লি প্রতিনিধি আইওএন এক্সচেঞ্জ (ইন্ডিয়া) লিমিটেডের ভাইস প্রেসিডেন্ট এম জে শেখের সঙ্গে কথা বলেন। সংস্থাটি বাংলাদেশের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য করে। ১০ বছর ধরে তাদের সহযোগী প্রতিষ্ঠান আইওএন এক্সচেঞ্জ (বাংলাদেশ) এ দেশে কাজ করছে। এম জে শেখ প্রথম আলোকে বলেন, দুই-তিন বছর ধরে ভারত এই ব্যবস্থায় বাণিজ্যের জন্য বাংলাদেশকে বলছিল। তবে বাংলাদেশ রাজি হয়নি। করোনা ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বাংলাদেশের অর্থনীতি কিছুটা সংকুচিত হয়েছে। টাকার অবমূল্যায়ন হয়েছে। ডলারের রিজার্ভ কমেছে বেশ কয়েক শ কোটি ডলার। এ অবস্থায় বাংলাদেশ পরীক্ষামূলকভাবে রুপি-টাকায় বাণিজ্য করে দেখতে পারে, এতে অর্থনীতির লাভ হচ্ছে কি না।
ভারতের সঙ্গে আমদানি-রপ্তানির কত ডলারের পরিবর্তে রুপি-টাকায় করা যাবে, তা প্রশ্নসাপেক্ষ। কারণ, বিদায়ী ২০২১-২২ অর্থবছরে বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা ১৯৯ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি করে ভারতে। তার বিপরীতে ভারত থেকে আমদানি হয়েছে ১ হাজার ৬১৯ কোটি ডলারের পণ্য। তাতে দেশটির সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্যঘাটতি ১ হাজার ৪২০ কোটি ডলারে দাঁড়িয়েছে।
এ বিষয়ে ভারত-বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (আইবিসিসিআই) সভাপতি আবদুল মাতলুব আহমাদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা যে পরিমাণ অর্থের পণ্য রপ্তানি করি, সমপরিমাণ অর্থের পণ্য যদি রুপিতে আমদানি করা যায়, তাহলেও কিছু ডলার বাঁচবে।’ এসবিআইয়ের নির্দেশনার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘ডলার-সংকটের শুরু থেকেই আমরা রুপি ও টাকায় লেনদেন করার দাবি করে আসছিলাম। চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহে প্রধানমন্ত্রীর সফরের সময়েও এ বিষয়ে কথা হয়েছে। মঙ্গলবার এসবিআইয়ের ঢাকা কার্যালয়ের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা হয়েছে। ওই কর্মকর্তা জানিয়েছেন, এসবিআইয়ের নির্দেশনার বিষয়টি কার্যকরের আগে আরবিআইতে পাঠানো হয়েছে। সেখান থেকে মতামত আসার পরই রুপি-টাকায় লেনদেন শুরু হতে পারে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকেরও অনুমোদন লাগবে।’অবশ্য ভারতের সঙ্গে আমদানি-রপ্তানিতে রুপি-টাকায় লেনদেনের জন্য বিশেষ উদ্যোগ নিতে হবে বলে মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা। তাঁরা বলেছেন, এখন পর্যন্ত ভারতের কোনো ব্যাংক থেকে আবেদন বা অনুরোধ আসেনি। তা ছাড়া ভারতীয় মুদ্রা রুপি এখন আইএমএফের স্পেশাল ড্রয়িং রাইটসের (এসডিআর) ঝুড়িতে যুক্ত হয়নি। এসডিআর ঝুড়িতে রয়েছে ডলার, ইউরো, ইউয়ান, জাপানের ইয়েন ও পাউন্ড। আইএমএফের সদস্যদেশের মধ্যে সহজে ও নিরাপদ লেনদেনের জন্যই পাঁচটি মুদ্রায় স্বীকৃত। ফলে অন্য কোনো মুদ্রায় লেনদেন করতে হলে বিশেষ নীতি সিদ্ধান্তের প্রয়োজন হবে।