রাষ্ট্রব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন আনতে ২৭ দফা ‘রাষ্ট্রকাঠামো মেরামতের রূপরেখা’ ঘোষণা করেছে বিএনপি। এতে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রিসভার নির্বাহী ক্ষমতার ভারসাম্য আনা, পরপর দুই মেয়াদের অতিরিক্ত কেউ রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন না করা, উচ্চকক্ষের আইনসভা প্রবর্তন, ন্যায়পাল নিয়োগ, বাংলাদেশ ভূখ-ের মধ্যে কোনো সন্ত্রাসী তৎপরতা বরদাশত না করাসহ গুরুত্বপূর্ণ সংস্কারের কথা বলা হয়েছে। গতকাল সোমবার রাজধানীর গুলশানের ওয়েস্টিন হোটেলে এক সংবাদ সম্মেলনে রূপরেখাটি তুলে ধরেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন।তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, দেশের চলমান পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রের সংস্কার প্রয়োজন হলেও তার আগে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য হতে হবে; না হলে এর বাস্তবায়ন সম্ভব নয়।সম্প্রতি ঢাকাসহ ১০ বিভাগে গণসমাবেশ করে বিএনপি। সর্বশেষ গত ১০ ডিসেম্বর রাজধানীর গোলাপবাগ মাঠে ঢাকার বিভাগীয় গণসমাবেশ থেকে এই রূপরেখা দেওয়ার কথা জানানো হয়েছিল। এর আগে গত আগস্ট মাস থেকে এই রূপরেখা প্রণয়নে বিএনপি সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর কয়েক দফা সংলাপও করে। এরই আনুষ্ঠানিক ঘোষণা এল গতকাল।বিএনপির ২৭ দফা রূপরেখা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) বদিউল আলম মজুমদার আমাদের সময়কে বলেন, ‘আমাদের তো সব প্রতিষ্ঠান ভেঙে পড়েছে, নিয়মনীতি সব অকার্যকর। আমাদের ভোটাধিকার হরণ করা হয়েছে। সবকিছু তো এখন ভঙ্গুর, দুর্নীতিগ্রস্ত ও অকার্যকর। এ অবস্থায় আমাদের সুদূরপ্রসারী সংস্কার দরকার। আমরাও (সুজন) ২১ দফা প্রস্তাব করেছি। রাষ্ট্রের সংস্কার করতে গেলে আমাদের রাজনৈতিক ঐকমত্য দরকার। বিএনপি চাইলেও একা পারবে না; আওয়ামী লীগ একা চাইলেও পারবে না। সবাই মিলে একত্রিত হয়ে এসব সংস্কার করতে হবে। তা না হলে এটা সম্ভব নয়। এ ব্যাপারে নির্বাচনের আগেই ঐকমত্যে পৌঁছা দরকার। তার ভিত্তিতে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন হতে হবে।’ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ আমাদের সময়কে বলেন, বিরোধী দলে থাকলে অনেকে অনেক কিছু বলে, ক্ষমতায় গেলে এগুলো বাস্তবায়ন করে না। বিএনপি যে ২৭ দফা দিয়েছে তা আপাতত দৃষ্টিতে সম্ভব নয়। কারণ এ ক্ষেত্রে বৃহৎ জনগোষ্ঠীর সম্পৃক্ততা প্রয়োজন।
বিএনপির রূপরেখা ঘোষণার পর সরকারের দিক থেকে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করা হয়েছে। গতকাল সচিবালয়ে মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির (ডিআরইউ) নবনির্বাচিত কমিটির সঙ্গে মতবিনিময় শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তথ্যমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ড. হাছান মাহমুদ বলেন, ‘বিএনপি যে রাষ্ট্র সংস্কারের কথা বলছে, দেশকে তারা জিয়াউর রহমানের মার্শাল ডেমোক্রেসিতে নিয়ে যেতে চায় কিনা, সেটিই হচ্ছে আমার প্রশ্ন।’গতকাল সংবাদ সম্মেলনে রাজনীতিবিদ, পেশাজীবী ও সাংবাদিকদের উপস্থিতিতে ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বিএনপির ২৭ দফার রূপরেখা তুলে ধরেন। এ সময় জানানো হয়, রূপরেখাকে আরও সমৃদ্ধ করতে সবার গঠনমূলক পরামর্শ গ্রহণ করা হবে। সে অনুযায়ী পরবর্তী সময়ে অন্যান্য বিষয়ভিত্তিক সংস্কার প্রস্তাব ও উন্নয়ন কর্মসূচিও প্রকাশ করা হবে।
রূপরেখা বর্ণনা করে খন্দকার মোশাররফ বলেন, ‘বর্তমান কর্তৃত্ববাদী সরকার বাংলাদেশের রাষ্ট্র কাঠামোকে ভেঙে চুরমার করে ফেলেছে। এই রাষ্ট্রকে মেরামত ও পুনর্গঠন করতে হবে। দেশের জনগণের হাতে দেশের মালিকানা ফিরিয়ে দিতে একটি অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ, গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনে জয়লাভের পর সরকার হটানোর আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী রাজনৈতিক দলসমূহের সমন্বয়ে একটি ‘জনকল্যাণমূলক জাতীয় ঐকমত্যের সরকার’ প্রতিষ্ঠা করা হবে। এই ‘জাতীয় সরকার’ রাষ্ট্র রূপান্তরমূলক সংস্কার কার্যক্রম গ্রহণ করবে।’ তিনি জানান, প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ঘোষিত ১৯ দফা এবং সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া ঘোষিত বিএনপির ভিশন-২০৩০ এর আলোকে এ রূপরেখা প্রস্তুত করা হয়েছে।
গুলশানের ওয়েস্টিন হোটেলে এই রূপরেখার ঘোষণার আগে লন্ডন থেকে স্কাইপেতে যুক্ত হয়ে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান আগামীতে জাতীয় সরকার গঠন এবং দলের প্রণীত রূপরেখাটি সুধী-সমাজের কাছে তুলে ধরেন।
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিতি ছিলেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকার, গয়েশ্বরচন্দ্র রায়, ড. আবদুল মঈন খান, নজরুল ইসলাম খান, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, সেলিমা রহমান, ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু, বিএনপি নেতা আবদুল্লাহ আল নোমান, ব্যারিস্টার শাহজাহান ওমর বীরউত্তম, বরকত উল্লাহ বুলু, মোহাম্মদ শাহজাহান, আবদুল আউয়াল মিন্টু, শামসুজ্জামান দুদু, এজেডএম জাহিদ হোসেন, জয়নাল আবেদীন, নিতাই রায় চৌধুরী, আমান উল্লাহ আমান প্রমুখ।
রূপরেখা তুলে ধরে ড. মোশাররফ হোসেন বলেন, বিগত এক দশকের বেশি সময় ধরে আওয়ামী লীগ ক্ষমতা কুক্ষিগত করতে অনেক অযৌক্তিক মৌলিক সাংবিধানিক সংশোধনী এনেছে। এ জন্য একটি ‘সংবিধান সংস্কার কমিশন’ গঠন করে বিতর্কিত ও অগণতান্ত্রিক সাংবিধানিক সংশোধনী ও পরিবর্তনসমূহ পর্যালোচনা করে তা রহিত বা সংশোধন করা হবে। একই সঙ্গে সংবিধানে গণভোট ব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তন করা হবে। প্রতিহিংসা ও প্রতিশোধের রাজনীতির বিপরীতে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক, বৈষম্যহীন ও সম্প্রীতিমূলক ‘রেইনবো নেশন’ প্রতিষ্ঠা করা হবে। এ লক্ষ্যে নতুন ধারার ‘সামাজিক চুক্তি’তে পৌঁছতে একটি ‘ন্যাশনাল রিকনসিলিয়েশন কমিশন’ গঠন করা হবে।রূপরেখার দফাগুলো তুলে ধরে বিএনপির এই স্থায়ী কমিটির সদস্য জানান, গণতন্ত্র ও ভোটাধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠায় এবং স্বচ্ছ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে স্থায়ী রূপ দিতে ‘নির্বাচনকালীন দলনিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার’ ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হবে। প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রপতি, সরকারের প্রধানমন্ত্রী এবং মন্ত্রিসভার নির্বাহী ক্ষমতায় ভারসাম্য আনা হবে। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার ভারসাম্য প্রতিষ্ঠায় নির্বাহী বিভাগ, আইন বিভাগ ও বিচার বিভাগের ক্ষমতা, দায়িত্ব ও কর্তব্যের সুসমন্বয় করা হবে। পরপর দুই মেয়াদের বেশি কেউ রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করতে পারবেন না। বিদ্যমান সংসদীয় ব্যবস্থার পাশাপাশি বিশেষজ্ঞ জ্ঞানের সমন্বয়ে রাষ্ট্র পরিচালনার লক্ষ্যে দেশের প্রথিতযশা শিক্ষাবিদ, পেশাজীবী, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, সমাজবিজ্ঞানী ও প্রশাসনিক অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ব্যক্তিদের সমন্বয়ে ‘উচ্চকক্ষ বিশিষ্ট আইনসভা’ প্রবর্তন করা হবে।
রূপরেখায় আরও বলা হয়, আস্থা ভোট, অর্থবিল, সংবিধান সংশোধনী বিল এবং রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার প্রশ্ন জড়িত- এমন সব বিষয় ছাড়া অন্য সব বিষয়ে সংসদ সদস্যদের স্বাধীনভাবে মতামত প্রদানের সুযোগ নিশ্চিত করতে সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ সংশোধন বিষয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখা হবে। নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন গঠন করতে বিদ্যমান প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ আইন সংশোধন করা হবে। ইভিএম নয়, পেপার-ব্যালটে ভোট প্রদান নিশ্চিত করা হবে। গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) ও রাজনৈতিক দল নিবন্ধন আইন সংস্কার করা হবে। স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দলীয় প্রতীক ব্যবহার বাতিল করা হবে।
এ ছাড়া দলীয়করণ বন্ধ করে জবাবদিহি ও বিশ্বাসযোগ্যতা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে সব প্রতিষ্ঠান পুনর্গঠন করা হবে। সংসদীয় কমিটির ভেটিংসাপেক্ষে সব প্রতিষ্ঠানের সাংবিধানিক ও গুরুত্বপূর্ণ পদসমূহে নিয়োগ দেওয়া হবে। বিচারব্যবস্থার সংস্কারের জন্য একটি ‘জুডিশিয়াল কমিশন’ গঠন করা হবে। বিচার বিভাগের জন্য সুপ্রিমকোর্ট নিয়ন্ত্রণাধীন পৃথক সচিবালয় থাকবে। বিচারপতিদের অভিশংসন প্রশ্নে সংবিধানে বর্ণিত পূর্বেকার ‘সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল’ ব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তন করা হবে। বিচারপতি নিয়োগের লক্ষ্যে সংবিধানের ৯৫ (গ) ধারা অনুযায়ী ‘বিচারপতি নিয়োগ আইন’ প্রণয়ন করা হবে। দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ পরিষেবা, জনপ্রশাসন ও পুলিশ বিভাগ গড়ে তুলতে যোগ্য, অভিজ্ঞ ও প্রাজ্ঞ ব্যক্তিদের সমন্বয়ে একটি ‘প্রশাসনিক সংস্কার কমিশন’ গঠন করে প্রশাসন পুনর্গঠন করা হবে।
রূপরেখায় মিডিয়া কমিশন ও অর্থনৈতিক সংস্কার কমিশন গঠনসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সংস্কারের কথা রয়েছে। এ ছাড়া সবার জন্য স্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে যুক্তরাজ্যের ‘এনএইচএস’ আদলে সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা প্রবর্তন, শিক্ষিত বেকারদের বেকার ভাতা প্রদান, আন্তর্জাতিক মানদ- অনুযায়ী সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বৃদ্ধি করার কথা বিবেচনা করা হবে।
রূপরেখায় উল্লেখ করা হয়, বৈদেশিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থকে সর্বোচ্চ প্রাধান্য দেওয়া হবে। বাংলাদেশ ভূখ-ের মধ্যে কোনো কোনো সন্ত্রাসবাদী আশ্রয়-প্রশ্রয় পাবে না। সন্ত্রাসবাদ, জঙ্গিবাদ ও উগ্রবাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সন্ত্রাসবিরোধী আইনের অপব্যবহার ও সন্ত্রাসবাদকে রাজনৈতিক ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে ভিন্নমতের বিরোধী শক্তি দমনের অপতৎপরতা বন্ধ করা হবে।সংবাদ সম্মেলনে সমমনাদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন নাগরিক ঐক্যের মাহমুদুর রহমান মান্না, গণফোরামে মোস্তফা মোহসিন মন্টু, অধ্যাপক আবু সাইয়িদ, সুব্রত চৌধুরী, গণঅধিকার পরিষদের রেজা কিবরিয়া, কল্যাণ পার্টির সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম, গণসংহতি আন্দোলনের জোনায়েদ সাকি ছাড়াও ভাসানী অনুসারী পরিষদ, জাতীয় পার্টি (কাজী জাফর), এলডিপি, এনপিপি, লেবার পার্টি, জাতীয় দল, ইসলামী ঐক্যজোট, জাগপা, ন্যাপ-ভাসানী, ডিএল, মুসলিম লীগ, পিপলস লীগ, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম, ও বাংলাদেশ ন্যাপের শীর্ষ নেতারা উপস্থিত ছিলেন।
পেশাজীবীদের মধ্যে অধ্যাপক মাহবুব উল্লাহ, অধ্যাপক সদরুল আমিন, অধ্যাপক আফম ইউসুফ হায়দার, অধ্যাপক তাজমেরি এসএ ইসলাম, অধ্যক্ষ সেলিম ভুঁইয়া, রফিকুল ইসলাম, চিত্রনায়ক আশরাফ উদ্দিন উজ্জ্বল, জাহানারা বেগম, সম্মিলিত পেশাজীবী পরিষদের কাদের গনি চৌধুরী, সাংবাদিক সোহরাব হাসান, এম আবদুল্লাহ, আবদুল হাই শিকদার, কামাল উদ্দিন সবুজ, মোস্তফা কামাল মজুমদার, সৈয়দ আবদাল আহমেদ প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।