জাহিদুর রহমান
রিখটার স্কেলে ৬ দশমিক ৭ মাত্রার ভূমিকম্পে ২০১৬ সালের ৪ জানুয়ারি কেঁপে ওঠে বাংলাদেশ। এ ঘটনায় শুধু আতঙ্কেই মারা যান ছয়জন। এভাবে ১৫ বছরে ছোট-বড় ভূমিকম্পে ১৪১ বার কাঁপে দেশ। যখন ভূমিকম্প হয়, তখনই মানুষের মনে ক্ষণিকের ভীতি ভর করে। তৎক্ষণাৎ নড়েচড়ে বসে সংশ্নিষ্ট সরকারি সংস্থাগুলোও। তবে সেই দৌড়ঝাঁপ থেমে যায় কয়েকদিনের মধ্যেই। আবার বড় আরেকটি ভূমিকম্প আঘাত হানলে ফের শুরু হয় শোরগোল।
গতকাল সোমবার তুরস্কে শক্তিশালী ভূমিকম্পে অনেক প্রাণহানির পর নতুন করে আবার আলোচনায় বাংলাদেশের ঝুঁকির বিষয়টি। আগের ছোট ও মাঝারি মাত্রার ভূমিকম্পে রক্ষা পেলেও সামনে বাংলাদেশের বড় ঝুঁকি দেখছেন বিশেষজ্ঞরা। তাঁরা বলছেন, সরকারের সব সংস্থাকে কাজে লাগিয়েও রানা প্লাজায় উদ্ধারে সময় লাগে প্রায় এক মাস। এখনও বড় মাত্রার ভূমিকম্পের পর উদ্ধার প্রস্তুতিতে অনেকটাই পিছিয়ে বাংলাদেশ। বহু পুরোনো ভবন, অপরিকল্পিত ভবন নির্মাণ, বিল্ডিং কোড অনুসরণ না করা, সরু গলি- ভূমিকম্প ঝুঁকি কয়েক গুণ বাড়িয়ে দিয়েছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
বেসরকারি সংগঠন ডিজাস্টার ফোরামের তথ্য বলছে, ২০০৮ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত দেশে ১০ বছরে ৮৭ বার ভূকম্পন হয়। এ সময় মারা যান ১৫ জন। এর মধ্যে ১৩ জনেরই মৃত্যু আতঙ্কিত হয়ে। প্রাণহানিসহ ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ শহরাঞ্চলেই বেশি। ২০১১ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর সারাদেশে ৬ দশমিক ৯ মাত্রার ভূমিকম্প অনুভূত হয়, যার উৎপত্তিস্থল ছিল ঢাকা থেকে ৪৯৬ কিলোমিটার দূরের সিকিম-নেপাল সীমান্ত। ১৮৫০ সালের পর ঢাকার এত কাছে আর কোনো ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল ছিল না।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের দেওয়া তথ্য বলছে, ২০১৮ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত ৫৭টি ভূমিকম্পের প্রভাবে কেঁপেছে বাংলাদেশ। সর্বশেষ গত ৫ ডিসেম্বর সকাল ৯টা ২ মিনিট ৫৩ সেকেন্ডে ভূমিকম্পে কাঁপে দেশ। রিখটার স্কেলে ৫ দশমিক ২ মাত্রার এই ভূমিকম্পের উৎসস্থল ছিল বঙ্গোপসাগর। ২০২১ সালের ২৯ মে এক দিনেই টানা ছয় দফা মৃদু ভূমিকম্পে সিলেট শহরসহ আশপাশের এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। এসব কম্পন বড় ভূমিকম্পের ইঙ্গিত দিচ্ছে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক মেহেদী আহমেদ আনসারি বলেন, গত দু-তিন বছরে দেশে ভূমিকম্প অনেক বেড়েছে। আবার ১০০ বছরের মধ্যে আমাদের এখানে তেমন বড় ভূমিকম্প হয়নি। এটা আতঙ্কের বিষয়, তার মানে ছোট এসব কম্পন শক্তি সঞ্চয় করছে। ফলে সামনে বড় ভূমিকম্পের শঙ্কা আছে। তিনি বলেন, তুরস্কে যে ভূমিকম্প হয়েছে, এর চেয়ে ছোট মাত্রার ভূমিকম্প হলেও শুধু ভবন ধস নয়, ঢাকার অপরিকল্পিত বিদ্যুৎ সঞ্চালন ও গ্যাসলাইন এ নগরকে একটি অগ্নিকূপে পরিণত করতে পারে।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) থেকে বিভিন্ন সময়ে করা জরিপে দেখা যায়, ঢাকায় ১৩ লাখ, চট্টগ্রামে ৩ লাখ ও সিলেটে ১ লাখ বহুতল ভবন রয়েছে। এসব ভবনের ৭৫ শতাংশ হচ্ছে ছয়তলা বা তার চেয়ে বেশি। ৭ মাত্রার ভূমিকম্প হলে এই ভবনগুলো ও এর বাসিন্দারা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। সরকারের সমন্বিত দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্মসূচির সমীক্ষাতেই বলা হয়েছে, ৭ দশমিক ৫ মাত্রার ভূমিকম্প হলে রাজধানীতে প্রায় ৭২ হাজার ভবন ধসে পড়তে পারে।
মেহেদী আহমেদ আনসারী বলেন, দ্রুত দেশের ২০ লাখ বহুতল ভবনের সবক’টিকে ভূমিকম্প সহনশীল করতে হবে। সেটা করার মতো কারিগরি দক্ষতা এবং সামর্থ্য বাংলাদেশের আছে। তবে এ জন্য সরকারের জরুরি উদ্যোগ দরকার। সারাদেশে বড় বড় শহরে সিটি করপোরেশনের মাধ্যমে সেখানকার বাসাবাড়ি ভূমিকম্পন সহনীয় কিনা, সেটা যাচাই করা যেতে হবে। কোনো বাসা খারাপ থাকলে মজবুত করার ব্যবস্থা করতে হবে। কারণ, ভূমিকম্পে ৯০ শতাংশ মানুষ মারা যায় ভবন ধসে। এ জন্য সেখানে ভবনগুলো শক্তিশালী করাই হবে প্রথম পদক্ষেপ।
৭ মাত্রার ভূমিকম্পে শত শত ভবন ধসে পড়লে তা উদ্ধারে তেমন কিছু করার থাকবে না বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। তাঁরা বলছেন, আধুনিক যন্ত্রপাতির সংকট তো রয়েছেই, এর ওপর ঢাকার রাস্তাগুলোর যে অবস্থা, বড় ভূমিকম্প হলে অনেক এলাকায় উদ্ধার কার্যক্রম দূরের কথা, সরু রাস্তার কারণে উদ্ধারকর্মীদের ঢোকার মতো পরিস্থিতি থাকবে না। ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স জানিয়েছে, ঢাকায় ৭৬ শতাংশ রাস্তা সরু হওয়ায় উদ্ধার তৎপরতা চালানো কঠিন। ৬০ শতাংশ ভবন মূল নকশা বদলে গড়ে উঠেছে।
ঘনবসতির ঢাকা নগরে ঝুঁকি কমাতে এ পর্যন্ত বিভিন্ন প্রকল্প ও পরিকল্পনা বাস্তবায়নের কথা বলা হলেও এর অধিকাংশই আলোর মুখ দেখেনি। তবে নানা উদ্যোগের কথা জানিয়ে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. মো. এনামুর রহমান বলেন, প্রতিটি দুর্যোগ থেকেই আমরা শিক্ষা নিচ্ছি। সে অনুযায়ী নানা পদক্ষেপ নিচ্ছি। তবে রাতারাতি সব বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। বাংলাদেশকে ভূমিকম্প সহনীয় দেশ হিসেবে গড়ে তুলতে জাপানের সঙ্গে চার দফা বৈঠক হয়েছে। একটি সমঝোতা স্মারক তৈরি হয়েছে। সেই অনুযায়ী তিন ধাপে বাংলাদেশকে ভূমিকম্প সহনীয় রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলা হবে। ফোকাল পারসনও নিয়োগ হয়েছে। প্রথম দফায় সচেতনতা বাড়ানো হবে, দ্বিতীয় দফায় ১০০-২০০ বছরের পুরোনো ভবন ধ্বংস করে ভূমিকম্প সহনীয় ভবন নির্মাণ করা হবে। এ ছাড়া সম্প্রতি যেসব ভবন তৈরি হয়েছে, তা পরীক্ষা করে সংস্কার করা হবে। কত দিনে এসব কাজ শেষ হবে- এমন প্রশ্নে মন্ত্রী বলেন, জাপানে এ কাজটি করতে ৩০ বছর লেগেছে। আমাদের সে ক্ষেত্রে হয়তো ৫০ বছর লাগবে। তবে এটি স্থায়ী ব্যবস্থা।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় জানায়, ভূমিকম্প ঝুঁকিপ্রবণ এলাকায় ভলান্টিয়ার দল তৈরি করে তাদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। এ ছাড়া দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার রয়েছে। বড় পরিসরে ন্যাশনাল ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার (এনওইসি) করা হচ্ছে, তেজগাঁওয়ে জমিও নেওয়া হয়েছে।