এম এ মাসুম
সাধারণত যখন কোনো দেশের ব্যালেন্স অব পেমেন্টে বড় রকমের ঘাটতি তৈরি হয় তখন তারা আইএমএফের দ্বারস্থ হয়। অর্থাৎ আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যের ক্ষেত্রে যখন কোনো দেশ ঘাটতিতে পড়ে। যখন বৈদেশিক মুদ্রা, বিশেষত ডলারের ঘাটতি তৈরি হয় তখন আইএমএফ ঋণ দিয়ে থাকে। আইএমএফ তাদের কার্যক্রমের আওতাভুক্ত দেশগুলোকে দীর্ঘ মেয়াদে ঋণ দেয় এবং ঋণ পরিশোধ সক্ষমতা বাড়াতে দেশগুলোর নেওয়া উদ্যোগগুলো পর্যালোচনা করে। বিশেষ করে রাজস্ব বাড়ানো এবং ব্যয় কমিয়ে অর্থনীতির সক্ষমতা বাড়াতে পরামর্শও দেয়।
বিশ্বের প্রায় সব দেশই মার্কিন ডলারে বেশি রিজার্ভ রাখে। আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম বাড়ায় প্রায় সব দেশের আমদানি ব্যয় বেড়েছে। অর্থনৈতিক মন্দায় রপ্তানি আয় ও রেমিট্যান্স কমেছে। একই সঙ্গে কমেছে বিনিয়োগ। এসব কারণে রিজার্ভও কমেছে।
স্বাধীনতার পর থেকে ১৯৮৩ সালের ১১ জানুয়ারি পর্যন্ত বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক লেনদেনে মধ্যবর্তী মুদ্রা ছিল ব্রিটিশ পাউন্ড স্টার্লিং। তখন পর্যন্ত বিনিময় হার ওঠানামা করত পাউন্ডের বিপরীতে। এর পর থেকে বাংলাদেশ মধ্যবর্তী মুদ্রা হিসেবে পাউন্ডের পরিবর্তে বেছে নেয় ডলারকে। সেই শুরু ডলারের ওপর নির্ভরতা। সেই ডলারই এখন বিশ্বের সবচেয়ে বেশি ব্যবহূত মদ্রা। নানা সময়ে ডলারের আধিপত্য ভাঙা নিয়ে আলোচনা ও উদ্যোগ হয়েছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আরো শক্তিশালী হয়েছে এই মার্কিন মুদ্রা। আর এই শক্তিশালী মুদ্রাই বর্তমান অর্থনৈতিক সংকটকে আরো তীব্র করেছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, বাংলাদেশের বৈদেশিক বাণিজ্যের ৯৮ শতাংশই ডলারে সম্পন্ন হয়। তাই ডলারই নির্ধারণ করে দেয় দেশের অর্থনীতির গতিপ্রকৃতি। বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেল ও খাদ্যপণ্যের দাম বাড়ায় গত বছরের মার্চ থেকে ডলারের সংকটে পড়ে বাংলাদেশ। দেশের রপ্তানি ও প্রবাসী আয় যা হয়, তার চেয়ে আমদানি খরচ বেড়ে যায়। এর ফলে ডলারের সংকট হয়ে দাম বেড়ে যায়, যার প্রভাবে বেড়ে যায় মূল্যস্ফীতিও।
গত এক বছরের ব্যবধানে ডলারের দাম বেড়েছে প্রায় ২১ টাকা। বাণিজ্যিক ব্যাংকের হিসাবে কোনো কোনো ক্ষেত্রে আরো বেশি বেড়েছে। ডলারের দাম বৃদ্ধিতে আমদানি ব্যয় বেড়ে রিজার্ভে চাপ সৃষ্টি করেছে। যা পুরো অর্থনীতিকে এলোমেলো করে দিয়েছে। ডলারের চাপ কমাতে বিকল্প মুদ্রায় এলসি খোলার উদ্যোগ নিলেও সাফল্য আসেনি। অন্য দেশগুলো নিজেদের মুদ্রাকে অবমূল্যায়ন করে প্রবাসী ও রপ্তানি আয় বাড়ানোর উদ্যোগ নেয়। তবে এ পথে না গিয়ে বাংলাদেশ টাকাকে শক্তিশালী করে রাখে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ঠিকই টাকা মান হারায়। যার ফলে সংকট আরো প্রকট হয়। ডলারের দাম ৮৫ থেকে বেড়ে হয়েছে ১০৭ টাকা।
দেশে ডলার-সংকট মেটাতে আমদানি ঋণপত্র খোলার ক্ষেত্রে কড়াকড়ি আরোপ করা হয়। ফলে দেশে এখন প্রতি মাসে গড়ে যে পরিমাণ রপ্তানি ও প্রবাসী আয় আসছে, আমদানি খরচ হচ্ছে তার চেয়ে কম। এরপরও সংকট রয়ে গেছে। কারণ, আমদানির জন্য বিদেশি ব্যাংকগুলো আগে যে অর্থায়ন করেছে, তার দায় এখন শোধ করতে হচ্ছে। এতে সুদও বেড়ে গেছে। আবার সরকারি-বেসরকারি খাতে ঋণ পরিশোধ, বিদেশি কোম্পানির মুনাফা প্রত্যাবাসন, বিমানভাড়া, চিকিত্সা সেবাসহ নানা খরচ রয়েছে। ফলে বাংলাদেশ ব্যাংককে প্রতিনিয়ত রিজার্ভ ডলার বিক্রি করতে হচ্ছে। আবার এখন যারা ঋণপত্র খুলছে, তাদের বেশির ভাগ দায় পরিশোধে ছয় মাস পর্যন্ত সময় নিচ্ছে। সুতরাং শিগিগরই সংকট কেটে যাবে, এমন সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না।
২০২২ সালে রিজার্ভ থেকে ১২ দশমিক ৬১ বিলিয়ন ডলার বিক্রি করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। আমদানি দায় মেটাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এখন প্রতিনিয়ত রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করছে। গত জুলাই ২০২২ থেকে জানুয়ারি ২০২৩ পর্যন্ত সাত মাসে রিজার্ভ থেকে ৯২০ কোটি ডলার বিক্রি করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। দেশের ইতিহাসে এর আগে পুরো এক অর্থবছরেও রিজার্ভ থেকে এত পরিমাণ ডলার কখনো বিক্রি করা হয়নি। এর আগে ২০২১-২২ অর্থবছরের পুরো সময়ে রিজার্ভ থেকে ৭৬২ কোটি ডলার বিক্রি করা হয়েছিল।
গত ৫ জুলাই ২০২২ এলসি খোলার ওপর কড়াকড়ি আরোপ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। সব ধরনের মোটরকার, হোম অ্যাপ্লায়েন্স হিসেবে ব্যবহূত ইলেকট্রিক্যাল এবং ইলেকট্রনিকস সামগ্রী, প্রসাধনী, স্বর্ণালঙ্কার, তৈরি পোশাক, গৃহস্থালি বৈদ্যুতিক সামগ্রী বা হোম অ্যাপ্লায়েন্স, পানীয়সহ বেশকিছু পণ্য আমদানিতে ব্যাংক থেকে কোনো ধরনের ঋণ সুবিধা পাবেন না আমদানিকারকরা। এসব পণ্যের আমদানি ঋণপত্র খোলার ক্ষেত্রে শতভাগ নগদ মার্জিন সংরক্ষণ করতে হবে। তবে শিশুখাদ্য, জ্বালানিসহ অত্যাবশ্যকীয় খাদ্যপণ্য, জীবন রক্ষাকারী ওষুধ, স্থানীয় ও রপ্তানিমুখী শিল্প এবং কৃষিখাত সংশ্লিষ্ট পণ্য আমদানি ছাড়া অন্য সব পণ্য আমদানির বিপরীতে ঋণপত্র স্থাপনের (এলসি) নগদ মার্জিন হার ন্যূনতম ২৫ শতাংশ সংরক্ষণের জন্য ব্যাংকগুলোকে নির্দেশ দেওয়া হয়।
আমদানি ব্যয়ের লাগাম টেনে ধরায় কমতে শুরু করেছে পণ্য আমদানির ঋণপত্র বা এলসি খোলার পরিমাণ। বাংলাদেশ ব্যাংকের পণ্য আমদানির হালনাগাদ তথ্যে দেখা গেছে, চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে (জুলাই-ডিসেম্বর) পণ্য আমদানিতে ঋণপত্র বা এলসি খোলা কমেছে ২৬ দশমিক ৫০ শতাংশ। আর একই সময়ে নিষ্পত্তি কমেছে ১ দশমিক ৫৬ শতাংশ। রিজার্ভের ওপর চাপ কমাতে আমদানির দায় কমানোর উদ্যোগ নিয়েছে সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক। নতুন এলসি কমলেও আগের দায় পরিশোধের চাপের কারণে বৈদেশিক মুদ্রার খরচ কমেনি।
বাংলাদেশের আমদানিকারকরা গত কয়েক মাস ধরেই অভিযোগ করেছেন, ডলার-সংকটের কারণে একাধিক ব্যাংকে যোগাযোগ করেও তারা ঋণপত্র বা এলসি খুলতে পারছেন না। ফলে অনেক জরুরি পণ্য আমদানি কমে যাওয়ায় দেশের বাজারে এগুলোর দাম বাড়ছে।
গত এক দশক ধরে ফরেন এক্সচেঞ্জ নিয়ে এই ধরনের সমস্যার মুখোমুখি হয়নি বাংলাদেশ। কারণ এই সময়ে রেমিট্যান্স এবং রপ্তানি—দুটোই কম বেশি ভালো ক