মুক্তিযোদ্ধাদের নামে ২৭০ সংগঠন

মুক্তিযোদ্ধাদের নামে ২৭০ সংগঠন

উৎপল রায়

কাগজে-কলমে ঠিকানা আছে, তবে অনেক সংগঠনের স্থায়ী বা অস্থায়ী কার্যালয় নেই। অথচ নিবন্ধন নেওয়া হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সব স্তরে ছড়িয়ে দেওয়া, বীর মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের পরিবারের কল্যাণ সাধন এবং তাদের পুনর্বাসনের উদ্দেশ্যে। দিবসীয় কিছু কার্যক্রম ছাড়া এসব সংগঠনের তৎপরতা চোখে পড়ে না খুব একটা। এরা নামে আছে, কাজে নেই।

অনেক সংগঠনের বিরুদ্ধে অনৈতিক কর্মকান্ড ও আচরণের অভিযোগ রয়েছে। গত ১৬ বছরে জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল (জামুকা) থেকে বিভিন্ন নামে ঢাকা ও ঢাকার বাইরের জেলা, উপজেলায় ২৭০টি সংগঠন নিবন্ধন নিয়েছে। বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিলসহ হাতেগোনা কয়েকটি ছাড়া এসব সংগঠনের উদ্দেশ্য নিয়েই প্রশ্ন উঠেছে।

মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষকরা ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা এদের কর্মকান্ডে ক্ষুব্ধ। তারা বলেছেন, জামুকার আশকারায় মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও বীর মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে এরা ব্যবসা খুলে বসেছে। ঠিকানাহীন এসব সংগঠনকে নিয়ে অস্বস্তিকর ও বিব্রতকর পরিস্থিতিতে রয়েছে জামুকা। তারা শিগগির এ বিষয়ে করণীয় নির্ধারণ করবে বলে জানা গেছে।

মুক্তিযুদ্ধ গবেষক ও সুশীল সমাজের আপত্তি : ২০০২ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত জামুকা ঢাকা ও ঢাকার বাইরের যেসব সংগঠনকে অনুমোদন দিয়েছে সেগুলোর নাম নিয়েও আপত্তি তুলেছেন সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা। মুক্তিযুদ্ধকে জানো, মুক্তিযোদ্ধা চিত্তবিনোদন ক্লাব, মুক্তিযোদ্ধা ফ্রেন্ডস অ্যাসোসিয়েশন, ঢাকা মেট্রোপলিটন মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ পরিষদ, মুক্তিযোদ্ধা পুনর্বাসন ও বিনোদন কেন্দ্র, বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা উন্নয়ন সোসাইটি, সবুজ বাংলা মুক্তিযোদ্ধা পরিষদ, নিউ মুক্তিযোদ্ধা পুনর্বাসন বহুমুখী সমবায় সমিতি, বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা অরোরা ফাউন্ডেশন, ১৯৭১ সালে ভারতে ট্রেনিংপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা পরিষদ, বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা উন্নয়ন ফোরাম, বাংলাদেশ ক্ষতিগ্রস্ত ও শ্রমিক মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড বহুমুখী সমবায় সমিতি, বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ রিসার্চ ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা মহাজোট, সিটি মুক্তিযোদ্ধা পুনর্বাসন বহুমুখী সমবায় সমিতি, বাংলাদেশ ফ্রিডম ফাইটার ডেভেলপমেন্ট সোসাইটি এমনসব নামে নিবন্ধন নেওয়া হলেও এসব সংগঠনের কোনো কার্যক্রম নেই। ঢাকার যে ঠিকানায় নিবন্ধন নেওয়া হয়েছে সেখানে এদের অস্তিত্ব মেলেনি।

মুক্তিযুদ্ধের গবেষক, সাংবাদিক শাহরিয়ার কবির দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘জামুকার কাজ মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাইয়ে সহযোগিতা করা। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার রূপায়ণের ও মুক্তিযোদ্ধাদের কল্যাণের দায়িত্ব তাদের দেওয়া হয়নি। অথচ তারা মুক্তিযুদ্ধের নামে এসব দোকানপাট খোলার অনুমতি দিয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা মানে হচ্ছে ৭২-এর সংবিধান; বঙ্গবন্ধুর আদর্শ। তার রূপায়ণে জামুকা কিছু করেছে বা বলেছে বলে আমাদের জানা নেই। মুক্তিযোদ্ধাদের চিত্তবিনোদনের জন্য ক্লাব লাগবে কেন? এসব আসলে মুক্তিযুদ্ধের নামে ব্যবসা। এসব করে মুক্তিযোদ্ধাদের অপমান করা হচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধকেও হেয় করা হচ্ছে। এর দায় জামুকাকেই নিতে হবে।’

সরেজমিনে যা দেখা গেল : ঢাকায় জামুকার নিবন্ধিত অন্তত আটটি সংগঠনের দেওয়া ঠিকানায় গিয়ে খোঁজ নিয়েছেন দেশ রূপান্তরের এ প্রতিবেদক। বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা উন্নয়ন ফোরাম নামের সংগঠনের ঠিকানা দেওয়া হয়েছে বায়তুল খায়ের; ৪৮-এ-বি, কক্ষ নম্বর-১১০৭, পুরানা পল্টন। ওই ঠিকানায় গিয়ে এমন কোনো কার্যালয় দেখা যায়নি। ওই ভবনসংশ্লিষ্ট একাধিক ব্যক্তির সঙ্গে কথা বললে তারা জানান, ১৩-১৪ বছর আগে এ নামে কিছুদিন একটি অফিস ছিল। ৫৯ (দ্বিতীয়তলা), পুরানা পল্টনের ঠিকানা দেওয়া বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ অরোরা ফাউন্ডেশনের খোঁজে সেখানে গেলে বেশ কয়েকজন ব্যবসায়ী বলেন, কয়েক বছরের মধ্যে এই নামে কোনো সংগঠন তারা এখানে দেখেননি।

বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা মহাজোটের ঠিকানা ১৪/২ তোপখানা রোড। সেখানে একটি পুরনো ও রং জ¦লে যাওয়া সাইনবোর্ড থাকলেও ভবনের নিচে হাসপাতালের স্বাস্থ্যকর্মীদের পোশাক সরবরাহকারী ব্যবসায়ী মো. হাসান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘এই নামে এখানে কোনো সংগঠনের কার্যালয় আছে গত এক যুগে শুনিনি।’ মুক্তিযোদ্ধা পুনর্বাসন ও বিনোদন কেন্দ্র নামের সংগঠনের ঠিকানা ৩৩, তোপখানা রোডের মেহেরবা প্লাজা। ভবনের দায়িত্বরতরা বলেন, ‘এ ধরনের একটি কার্যালয় এখানে ছিল। কিছুদিন আগে অফিসটি বন্ধ হয়ে গেছে।’

মুক্তিযোদ্ধা চিত্তবিনোদন ক্লাবের ঠিকানা ৫৬৭/সি কামারপট্টি রোড, খিলগাঁও বাজার। সেখানে গিয়ে এমন কোনো সংগঠনের অস্তিত্ব মেলেনি। স্থানীয় সেলুন ব্যবসায়ী টিটু দাস বলেন, ‘প্রায় ১৩ বছর ধরে এখানে কাজ করছি; মুক্তিযোদ্ধাদের কোনো কার্যালয় কখনো দেখিনি।’ বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে গুলিস্তান কমপ্লেক্স ভবনের সপ্তমতলায় বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ রিসার্চ ফাউন্ডেশন নামের সংগঠনের ঠিকানায় গিয়ে এ নামে কোনো সংগঠনের খোঁজ পাওয়া যায়নি। বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ের ১৬/এ, ওয়াজা ভবনের চতুর্থতলার ঠিকানায় গিয়ে ন্যাশনাল এফএফ ফাউন্ডেশন নামে সংগঠনের বিষয়ে জানতে চাইলে ভবনের কেউ কিছু বলতে পারেননি।

যেভাবে নিবন্ধন দেয় জামুকা : জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল আইন, ২০০২-এর ৭(ঙ) ধারা এবং মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধা সংগঠন নিবন্ধন বিধিমালা, ২০০২ অনুযায়ী মুক্তিযোদ্ধা সমিতি/সংগঠন নিবন্ধনের জন্য জামুকা ১৮টি শর্ত পূরণ করতে বলে স্থায়ী ও অস্থায়ী কার্যালয় থাকা, সংগঠনে শুধু বীর মুক্তিযোদ্ধাদের অন্তর্ভুক্তি, সংগঠনের নামে ব্যাংক হিসাব থাকা, সংগঠনের স্বার্থপরিপন্থী কোনো কাজ না করা, জামুকার নির্ধারিত চাঁদা পরিশোধ করা প্রভৃতি। জামুকার সংশ্লিষ্ট শাখার তথ্যমতে, ২০০২ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত রাজধানীসহ সারা দেশ থেকে নিবন্ধন পেতে ৫৫৫টি সংগঠন আবেদন করে। বিভিন্ন সময়ে ২৭০টি সংগঠনকে অনুমোদন দিয়েছে জামুকা। এসবের মধ্যে ঢাকায় ১৩৫টি। সংগঠনের নামের বিষয়ে জামুকার কোনো নির্দেশনা নেই। নিবন্ধিত সংগঠনগুলোর মধ্যে সক্রিয় মুক্তিযোদ্ধা কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিল জামুকার আগেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

২০০২ সালের অক্টোবর থেকে ২০০৬ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ৬৮টি সংগঠনকে নিবন্ধন দেয় জামুকা। ২০০৭ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত নিবন্ধন দেওয়া বন্ধ ছিল। ২০১০-এর মে মাস থেকে ২০১৯ সালের মে মাস পর্যন্ত ২০২টি সংগঠনকে নিবন্ধন দেওয়া হয়। জামুকার ঊর্ধ্বতন কর্তারা বলেন, সংগঠনের স্বার্থবিরোধী কর্মকা- ও নিষ্ক্রিয়তায় বিভিন্ন সময়ে ছয়টির নিবন্ধন বাতিল করা হয়েছে। সেগুলো হলো ঢাকার মুক্তিযোদ্ধা পুনর্বাসন সংস্থা, বগুড়ার আদমদীঘির শহীদ যুদ্ধাহত অসচ্ছল মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ সমিতি, নওগাঁ জেলার অসচ্ছল মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ সমিতি, খুলনা মুক্তিযোদ্ধা প্রজন্ম কল্যাণ ও পুনর্বাসন, ঢাকার জাতীয় সম্মিলিত মুক্তিযোদ্ধা ফাউন্ডেশন ও ঢাকার ৭১-এর সহযোগী মুক্তিযোদ্ধা পরিষদ। এ ছাড়া ‘আমরা মুক্তিযোদ্ধার সন্তান’ নামে দুটি সংগঠন থাকায় এদের নিবন্ধন স্থগিত রাখা হয়েছে। জামুকার নিবন্ধিত সংগঠন এখন পর্যন্ত ২৬২টি।

জামুকার সহকারী পরিচালক (রেজিস্ট্রেশন ও সার্টিফিকেট) মো. আবদুল খালেক দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘১০০ সংগঠনের সঙ্গে তাদের দপ্তরের কোনো যোগাযোগ নেই। তাদের কার্যক্রম সম্পর্কে জানার চেষ্টা করেও সম্ভব হয়নি। চিঠি দিলে উত্তর আসে না। কার্যক্রম দেখতে চাইলে সাড়া পাওয়া যায় না। প্রায়ই কমিটি নিয়ে দলাদলিসহ নানা অভিযোগ আসে।’ ৫০টির মতো সংগঠনের কার্যক্রম রয়েছে বলে তিনি দাবি করেন।

জামুকার মহাপরিচালক মো. জহুরুল ইসলাম রোহেল দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তিকে জাগ্রত রাখাসহ যে উদ্দেশ্যে নিবন্ধন দেওয়া হয়েছিল দেখা যাচ্ছে অনেকে সংগঠনই তা করে না। লোকবলের স্বল্পতার কারণে এত সংগঠনের কার্যক্রম তদারকি করাও কঠিন। তাই নতুন করে নিবন্ধন দিচ্ছি না।’ তিনি বলেন, ‘সংগঠনগুলোর সঙ্গে একেবারেই যে যোগাযোগ নেই, এমনও নয়। আমরা নিয়মিত পরিদর্শনে যাচ্ছি। অনেকের হয়তো তৎপরতা নেই। অভিযোগ আমরা পর্যালোচনা করে দেখছি। কীভাবে সংগঠনগুলোকে আরও গতিশীল করা যায় সে চেষ্টা আমাদের রয়েছে।’

মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী ও জামুকার চেয়ারম্যান আ ক ম মোজাম্মেল হক দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘এক বা দুটির অস্তিত্ব আছে। বাকিগুলো কাজ করে বা করে

Others