ব্যাংকে আমানতের প্রবৃদ্ধিতে বড় ধস

ব্যাংকে আমানতের প্রবৃদ্ধিতে বড় ধস

জিয়াদুল ইসলাম

ব্যাংক খাতে আমানতের প্রবৃদ্ধি কমে যাচ্ছে। গত বছরের ডিসেম্বরে এ খাতে বার্ষিক আমানতের প্রবৃদ্ধি নেমে এসেছে মাত্র সাড়ে ৫ শতাংশে। এটি বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বনিম্ন। গত দেড় বছর ধরে আমানতের প্রবৃদ্ধি নিম্নমুখী প্রবণতায় রয়েছে। বিষয়টি নিয়ে উদ্বিগ্ন ব্যাংকাররা। কারণ এমন এক সময় আমানতের প্রবৃদ্ধি কমে যাচ্ছে, যখন ব্যাংকে তারল্য সংকট ও বেসরকারি খাতে ঋণের চাহিদা বাড়ছে। আমানতের প্রবৃদ্ধি কমে যাওয়ার কারণ হিসেবে উচ্চ মূল্যস্ফীতি, ডলার সংকট ও রেমিট্যান্সের পতনকে দায়ী করা হচ্ছে। এ ছাড়া সম্প্রতি কয়েকটি ইসলামী ব্যাংকের ঋণ অনিয়মের ঘটনা সামনে আসার পর আস্থার সংকটেও আমানত তুলে নেওয়ার ঘটনা বেড়ে যায়, যার প্রভাব পড়েছে সার্বিক আমানতের প্রবৃদ্ধিতে।

দেশে করোনার আঘাত আসার পর সাধারণ ছুটি ও কয়েক দফার লকডাউনে মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব পড়ে অর্থনীতিতে। অনেকের রুটি-রুজির পথ বন্ধ হয়ে যায়। চাকরি হারিয়ে বেকার হন অনেকেই। আবার কাজ থাকলেও বেতন কমে যাওয়া বা বেতন বন্ধ হয়ে যাওয়ার ঘটনাও ঘটে। এতে ব্যাংক খাতে আমানত কমার আশঙ্কা থাকলেও বিনিয়োগে ধীরগতি ও রেমিট্যান্সের জাদুতে ওই সময় সেটি হয়নি। কিন্তু করোনার পরিস্থিতি উন্নতি হওয়ার পর থেকে আমানতের প্রবৃদ্ধি টানা কমছে। এর জন্য রেমিট্যান্সের টানা পতন, উচ্চ মূল্যস্ফীতি এবং টাকার অবমূল্যায়ন ও ডলার সংকটকে দায়ী করছেন অর্থনীতিবিদসহ সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, ডলার সংকটে টাকার অস্বাভাবিক মূল্য কমেছে। এতে আমদানি ব্যয় ও পণ্যের দাম বেড়েছে। ফলে ভোক্তাকে বেশি দামে পণ্য কিনতে হচ্ছে। আবার করোনার পর অর্থনৈতিক মন্দায় ভোক্তার আয় বাড়েনি। উল্টো মূল্যস্ফীতির কারণে নতুন সঞ্চয় কমে গেছে। বিদ্যমান সঞ্চয়ও ভেঙে খাচ্ছেন কেউ কেউ। ফলে ব্যাংকে আমানত কমে গেছে।

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম  বলেন, আমানত কমে যাওয়ার অন্যতম কারণ মূল্যস্ফীতির তুলনায় আমানতের সুদ কম হওয়া। বর্তমানে মূল্যস্ফীতির হার প্রায় ৯ শতাংশের কাছাকাছি। কিন্তু আমানতে সুদ মিলছে ৬ শতাংশেরও কম। মূল্যস্ফীতি বিবেচনায় ব্যাংকে রাখলে লাভ তো হচ্ছেই না, উল্টো লোকসান হয়ে যাচ্ছে। ফলে মানুষ টাকা রাখতে আগ্রহ হারাচ্ছে। আবার মূল্যস্ফীতির বাড়ার কারণে সংসারের খরচ বেড়েছে। ফলে মানুষের সঞ্চয়প্রবণতা কমে গেছে। আরেকটি কারণে আমানত কমতে পারে, সেটি হলো রেমিট্যান্সের প্রবাহ কমে যাওয়া।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, দেশে করোনা আঘাত আসার আগে ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে বার্ষিক আমানতের প্রবৃদ্ধি ছিল ১২ দশমিক ৮২ শতাংশ। সেই প্রবৃদ্ধি বাড়তে বাড়তে ২০২১ সালের মে মাস পর্যন্ত সর্বোচ্চ ১৪ দশমিক ৪৭ শতাংশে ওঠে। কিন্তু এরপর থেকেই টানা কমছে আমানতের প্রবৃদ্ধি। সর্বশেষ গত বছরের ডিসেম্বরে আমানতের বার্ষিক প্রবৃদ্ধি কমে দাঁড়িয়েছে মাত্র ৫ দশমিক ৬৬ শতাংশ, যা ইতিহাসে এ যাবৎকালের সর্বনিম্ন প্রবৃদ্ধি। এর আগে ২০১৮ সালের এপ্রিলে ব্যাংকগুলোর আমানতের বার্ষিক প্রবৃদ্ধি নেমে আসে ৫ দশমিক ৯৮ শতাংশে। প্রাপ্ত তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, গত বছরই সবচয়ে কম বেড়েছে আমানত। করোনা মহামারির বছর ২০২০ সালে ব্যাংক খাতে আমানত বেড়েছিল ১ লাখ ৫৩ হাজার ৪৯২ কোটি টাকা। বার্ষিক প্রবৃদ্ধি হয়েছিল সাড়ে ১৩ শতাংশ। তার পরের বছর ২০২১ সালে আমানত বেড়ছিল ১ লাখ ১৮ হাজার ৮৭০ কোটি টাকা বা ৯ দশমিক ২১ শতাংশ। সেখানে গত বছর বেড়েছে মাত্র ৭৯ হাজার ৮২৬ কোটি টাকা বা ৫ দশমিক ৬৬ শতাংশ।

অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) সাবেক চেয়ারম্যান ও বেসরকারি মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের এমডি সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, আমানতের প্রবৃদ্ধিটা কোথা থেকে হবে। একদিকে নতুন আমানত আসা কমে গেছে, অন্যদিকে বিদ্যমান আমানতও তুলে নেওয়ার ঘটনা ঘটছে। এতে ব্যাংক খাতের উদ্বৃত্ত তারল্য ব্যাপকহারে কমেছে। মূল্যস্ফীতি ও রেমিট্যান্সের পতন আমানতের প্রবৃদ্ধি কমার অন্যতম কারণ। কেননা মূল্যস্ফীতির কারণে মানুষের সঞ্চয়প্রবণতা কমে গেছে। আবার মূল্যস্ফীতির সঙ্গে সমন্বয় করে আমানতের সুদও বাড়েনি। এ কারণে অনেকে বিকল্প উৎসে টাকা খাটাতে পারে। এ ছাড়া সম্প্রতি বিভিন্ন ঘটনায় ব্যাংকের ওপর মানুষের আস্থার অভাবও পরিলক্ষিত হয়েছে। আমানতের প্রবৃদ্ধি কমে যাওয়া ব্যাংক খাতে দীর্ঘমেয়াদে কোনো শঙ্কা তৈরি করবে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমানতের প্রবৃদ্ধি কমে যাওয়া অবশ্যই শঙ্কার কারণ। আমরা বিষয়টি নিয়ে উদ্বিগ্ন।

এদিকে ব্যাংকে আমানতের প্রবৃদ্ধি কমলেও ঋণের প্রবাহ বাড়ছে। গত বছরের ডিসেম্বর শেষে বেসরকারি খাতে ঋণের স্থিতি বেড়ে হয়েছে ১৪ লাখ ২৬ হাজার ১৩৩ কোটি টাকা। যা ২০২১ সালের ডিসেম্বরে ছিল ১২ লাখ ৬৩ হাজার ২৩৭ কোটি টাকা। ফলে গত এক বছরে বেসরকারি খাতে ঋণ বেড়েছে ১ লাখ ৬২ হাজার ৮৯৬ কোটি টাকা বা ১২ দশমিক ৮৯ শতাংশ। আর ব্যাংক খাতে আমানতের চেয়ে ঋণের প্রবাহ বেশি বাড়ায় তারল্য সংকট প্রকট হয়েছে। ফলে প্রতিদিনই ব্যাংকগুলোকে বড় অঙ্কের তারল্য সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

অর্থ বাণিজ্য